পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ২৭ মার্চ শনিবার থেকে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন শুরু হয়েছে। ওরা এটাকে রাজ্য বিধানসভা বলে। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগলিক আয়তন ৩৪ হাজার ২৬৭ বর্গ মাইল। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ২০ হাজার বর্গ মাইল ছোট। আয়তনে দুই তৃতীয়াংশেরও কিছু কম। জনসংখ্যার ক্ষেত্রেও তাই। ২০১১ সালে তাদের আদমশুমারী হয়েছে। আমাদেরও একই সালে। আমরা বলি, আমাদের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। এটি অনুমান নির্ভর। ওরা বলে, ওদের জনসংখ্যা ১০ কোটি। সেটিও অনুমান নির্ভর। এই অনুমানের ওপর নির্ভর করেই আমরা বলি, ওদের জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে প্রায় ৭ কোটি কম। ১০ বছর পর পর আদমশুমারী হয়। সেই হিসাবে, এ বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে বাংলাদেশের আদমশুমারী হবে। আবার ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গেও আদমশুমারী হবে।
যে রাজ্যটি বাংলাদেশের দুই তৃতীয়াংশের সমান, যার জনসংখ্যা আমাদের অর্ধেকের চেয়ে ৩ কোটি বেশি সেখানে ভোট হবে ৮ পর্বে। গত ২৭ মার্চ শুরু হয়েছে নির্বাচন। ২৯ এপ্রিল শেষ হবে। ২ মে ইলেকশনের রেজাল্ট বের হবে। আমাদের ভৌগলিক আয়তন তাদের চেয়ে বেশ বড় এবং জনসংখ্যাও ৭ কোটি বেশি হওয়া সত্তেও আমাদের ইলেকশন হয় এক দিনে। এবং দিন শেষে রাতেই নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশিত হয়। দুই দেশে দুই সিস্টেম। জানি না কোনটি বেটার। একদিন নয়, কয়েকদিন ধরে কয়েক পর্বে ইলেকশন হলে সেটিকে বলা হয় ‘স্টেগার্ড ইলেকশন’। আমার ব্যক্তিগত মতে বাংলাদেশে ভোট ডাকাতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে এই ধরণের ‘স্টেগার্ড ইলেকশন’ হওয়া দরকার।
পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে মোট ২৩ টি জেলা। এগুলো হলো (১) কলকাতা (২) উত্তর চব্বিশ পরগনা (৩) দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা (৪) হাওড়া (৫) নদিয়া (৬) মুর্শিদাবাদ (৭) পুরুলিয়া (৮) বীরভূম (৯) বাঁকুড়া (১০) পূর্ব বর্ধমান (১১) পশ্চিম বর্ধমান (১২) হুগলি (১৩) পূর্ব মেদিনীপুর (১৪) পশ্চিম মেদিনীপুর (১৫) কোচবিহার (১৬) কলিংপঙ (১৭) আলিপুরদুয়ার (১৮) দার্জিলিং (১৯) জলপাইগুড়ি (২০) ঝাড়গ্রাম (২১) উত্তর দিনাজপুর (২২) দক্ষিণ দিনাজপুর এবং (২৩) মালদহ।
রাজ্য বিধানসভায় রয়েছে ২৯৪ টি আসন। সর্বাধিক আসনের মধ্যে উত্তর চব্বিশ পরগনায়, ৩৩ টি। তারপরেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ৩১ টি আসন। সবচেয়ে কম আসন কলিংপঙে। মাত্র একটি আসন। প্রাদেশিক পরিষদ বা রাজ্যবিধান সভার মেয়াদ ৫ বছর। বর্তমান বিধান সভার মেয়াদ শেষ হবে ৩০ এপ্রিল। বর্তমান বিধান সভায় দলওয়ারী শক্তি : (১) তৃণমূল কংগ্রেস ২১১, (২) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ৪৪, (৩) বাম জোট ৩৩, (৪) বিজেপি ৩, (৫) ভারতীয় জনমুক্তি মোর্চা ৩।
বর্তমান বিধান সভায় বিভিন্ন দলের আসন সংখ্যা দেখলে মনে হবে যে, এখনও পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জী তথা তৃণমূল অপ্রতিদ্ব›দ্বী অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু সেটি ঠিক নয়। ২০১৬ সালের তিন বছর পর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ভারতে লোকসভার নির্বাচন হয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লোকসভায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় সেই দল ভারতের কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সরকার গঠন করে। লোকসভার সদস্য সংখ্যা ৫৪৩। প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে সেই রাজ্যের লোকসভার আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয়। লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের আসন ৪২। ২০১৬ সালে বিজেপি সেখানে বিধান সভায় পায় মাত্র ৩ টি আসন।
সেখানে ৩ বছর পর বিজেপি লোকসভায় পায় ১৮ টি আসন। আর তৃণমূল পায় ২২ টি আসন। অথচ তার আগের লোকসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জী পান ৩৪ টি আসন। আর বিজেপি মাত্র ২টি আসন। অথচ ৫ বছর পর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জীর আসন ৩৪ থেকে কমে হয় ২২ টি আসন। অর্থাৎ মমতা হারান ১২টি আসন। পক্ষান্তরে, বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যেখানে পায় মাত্র ২টি আসন। সেখানে ৫ বছর পর ২০১৯ সালে তারা পায় ১৮ টি আসন। অর্থাৎ বৃদ্ধি ১৬ টি আসন।
দুই
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির এই অবিশ্বাস্য বিজয় তাদেরকে অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তারা ধরে নেয় যে, পশ্চিমবঙ্গে মমতা তথা তৃণমূলের জনপ্রিয়তা মারাত্মক হ্রাস পেয়েছে এবং বিজেপির জনপ্রিয়তা দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধারণায় চাঙ্গা হয়ে তারা এবার রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বিজেপি নির্বাচনে বরাবরের মত হিন্দু ধর্মকেই তাদের ইলেকশনের প্রধান পূঁজি হিসাবে ব্যবহার করছে। তারা দেখেছে, অতীতে এই চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাই তাদেরকে রাজনীতিতে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিতই নয়, একেবারে দিল্লীর মসনদে আসীন করেছে। যেখানে ৮০ এর দশকের শেষে বিজেপি লোকসভায় পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন সেখানে শুধুমাত্র হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়িয়ে এবং ভগবান রামের বিশাল ছবিসহ ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করে তারা হিন্দুদের হিন্দুত্ব জাগ্রত করেছে এবং লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দুই মেয়াদে দিল্লীর ক্ষমতায় আছে। ভারতের সুপ্রীম কোর্টকে প্রভাবিত করে তারা শত শত বর্ষের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সপক্ষে রায় আদায় করেছে। অত:পর সেই মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে রাম মন্দির নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যেই শুরু করেছে। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রচন্ড ঢেউয়ে ভেসে গেছে কংগ্রেসও। তাই রাম মন্দিরের শিলান্যাসে (ভিত্তি প্রস্থর স্থাপনে) রূপার ইট নিয়ে এসেছেন কংগ্রেস নেতা নেহ্রুর নাতির ছেলে (প্রোপুত্র) রাজীব গান্ধীও। তবে এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী জিগিরে ভেসে যাননি মমতা ব্যানার্জী। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য বিজেপি যেখানে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য দলীয় শ্লোগান তুলেছে ‘জয় শ্রীরাম’, সেখানে মমতা ব্যানার্জী নির্বাচনে দলীয় শ্লোগান তুলেছেন, ‘জয় বাংলা’। মমতা ব্যানার্জীর যুক্তি, তিনি পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দিয়েছেন ‘বঙ্গ’ বা ‘বাংলা’। সুতরাং তাঁরা যখন জয় বাংলা বলেন, সেটা ‘জয় পশ্চিম বাংলাই’ বোঝায়।
তিন
হিন্দু ধর্ম এবং তার দেব-দেবীকে রাজনীতির ইস্যু বানিয়ে মমতাকে কুপোকাত করার লড়াইয়ে মাঠে নেমেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ প্রমুখ। বলা হয় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবার ঢাকা এসে রথ দেখা এবং কলা বেচা দুটোই করে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকা থেকেই জানা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে নাকি ৩ কোটি (মতান্তরে ২ কোটি) মতুয়া সম্প্রদায়ের লোক বাস করে। এরা নমশুদ্র শ্রেণীর। এদের বসবাস বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলিতে। বাংলাদেশে হিন্দুদের দুটি মন্দির রয়েছে। একটি হলো, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ইশ্বরীপুর গ্রামের যশোরেশ্বরী কালি মন্দির। আরেকটি হলো, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির ওড়াকান্দিতে ঠাকুর বাড়ির মতুয়া মন্দির। মতুয়া অর্থ হলো মাতোয়ারা হওয়া। হরিনামে যারা মেতে থাকেন তারাই মতুয়া। মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হরিচাঁদ ঠাকুর। ১৮১১ সালে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানির ওড়াকান্দিতে জন্ম নেন হরিচাঁদ ঠাকুর। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া নয়, সমগ্র বিশ্বের কয়েক কোটি মতুয়ার তীর্থক্ষেত্র হলো কাশিয়ানির এই মন্দির এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ঐ মন্দির। সকাল সাড়ে ১০ টায় হেলিকপ্টার যোগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শ্যামনগরে পৌঁছেন। সেখানে পৌঁছে তিনি সাড়ে ৪০০ বছরের পুরানো ঐতিহাসিক কালি মন্দিরে যান এবং পূজা অর্চনা করেন।
পরে তিনি স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে মত বিনিময় করেন। এরপর আসেন গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে। সেখানে তিনি শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পূজা অর্চনা করেন। ওড়াকান্দিতেও তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মত বিনিময় করেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলেন যে, ভারতের মত এত বিশাল দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের শ্যামনগর এবং ওড়াকান্দির মত প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া শুধুমাত্র পূজা অর্চনার জন্যই নয়। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক অভিসন্ধি। সেটি হলো, বাংলাদেশের মতুয়া মন্দিরে আরাধনা করে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে মত বিনিময় করে পশ্চিমবঙ্গের চলমান বিধান সভা নির্বাচনে সেখানকার ২ থেকে ৩ কোটি মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সহানুভ‚তি উদ্রেক এবং তাদের ভোট আদায় করা।
চার
বাংলাদেশের গন্ডগ্রামে নরেন্দ্র মোদির পদধুলির পেছনে যে ছিল পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন সেটি ধরে ফেলেছেন মমতা ব্যানার্জী। মোদি যখন ওড়াকান্দির ঠাকুর বাড়িতে তখন মমতা ব্যানার্জী পশ্চিম মেদেনীপুরে এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। তিনি মোদিকে প্রশ্ন করেন, যখন পশ্চিমবঙ্গে ভোট হচ্ছে তখন আপনি বাংলাদেশে কেন? আপনি যদি ভোট চলাকালীন বাংলাদেশে একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষের জন্য ভোট চাইতে যান তাহলে আপনার ভিসা পাসপোর্ট কেন বাতিল হবে না? শুধু বাংলাদেশ নয়, মার্কিন নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠান নিয়েও নরেন্দ্র মোদির তীব্র সমালোচনা করেন মমতা ব্যানার্জী।
পশ্চিমবঙ্গের ভোটযুদ্ধ জমে উঠেছে। একদিকে রুদ্রাক্ষের মালা, চন্দন চর্চিত তিলক আর গেরুয়া বসনের সুতীব্র হিন্দুত্ববাদী শ্লোগান ‘জয় শ্রীরাম’, অন্যদিকে বিজেপি, কংগ্রেস ও বাম ফ্রন্টের বিরুদ্ধে তাঁতের শাড়ী, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ ও পদযুগলে সাধারণ চপ্পল বা স্যান্ডেল পরা মমতার উচ্চকণ্ঠ শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ (জয় পশ্চিম বাংলা)। ২ মে দেখা যাবে কলকাতার তখতে তাউসের শিকাটি কার ভাগ্যে ছিঁড়ে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।