পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা মহামারি দেশের অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন করে দিয়েছে। মানুষের মন ও মননে এর প্রভাব পড়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশু থেকে তরুণ শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। পরিবার ও সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। পড়াশোনার ব্যস্ততা না থাকায় সন্তানদের মানসিকতা নেতিবাচক দিকে ধাবিত হচ্ছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, তাদের মানসিকতা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে, তাতে অনেক কিশোর যুক্ত হচ্ছে। পড়ালেখার ব্যস্ততা না থাকায় তারা এসব গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। খুন, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, ইভ টিজিংসহ নানা অপরাধে তারা জড়াচ্ছে। এলাকার আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এক গ্যাং আরেক গ্যাংয়ের সাথে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এই কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ ও দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও হিমশিম খাচ্ছে। এটা তাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কিশোর গ্যাংকে কাজে লাগিয়ে পুরনো সন্ত্রাসী এবং প্রভাবশালীরা তাদের স্বার্থ হাসিল করছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি ঘটছে। পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী, খোদ রাজধানীতেই প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ খুনের শিকার হচ্ছে। এর পেছনে পারিবারিক, সামাজিক কিংবা তুচ্ছ ঘটনার জেরসহ যে কারণই থাকুক না কেন, মানুষ খুন হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চিত্র শুধু রাজধানীতেই নয়, গ্রামে-গঞ্জেও এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে।
গত কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব খুন-জখমের ঘটনা ঘটছে তাতে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এসব কারণের মধ্যে অতি তুচ্ছ ঘটনা যেমন সালাম না দেয়া, থুতু ফেলা, নিয়ে খুন করার নজির রয়েছে, তেমনি পারিবারিক কলহ, অনৈতিক কাজ, প্রতিপক্ষের সাথে দ্বন্দ্বসহ রাজনৈতিক অন্তর্কোন্দলে খুন হওয়ার ঘটনা রয়েছে। দুয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে চিত্রটি বোঝা যাবে। রাজধানীতে পাড়ার সিনিয়র ভাইকে সালাম না দেয়ায় এক কিশোর খুনের শিকার হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শরাইল উপজেলায় থুতু ফেলা নিয়ে আপন চাচাতো ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছে এক তরুণ। সিলেটে শাহপরান থানা এলাকায় পারিবারিক কলহে সৎ মা ও ভাই-বোনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে এক যুবক। এসব পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণেও খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার সিলেটে ভাড়া নিয়ে বাগবিতন্ডায় অটোরিকশা চালকরা সংজ্ঞবদ্ধ হয়ে এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। গত শুক্রবার নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজারে বসুরহাটের মেয়র আব্দুল কাদের মির্জা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া ধাপে ধাপে যে পৌর মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতেও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে মানুষ নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেখা যাচ্ছে, পরিবার, সমাজ এবং রাজনীতিতে এক চরম অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান অপরাধমূলক ঘটনা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে যখন আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অপরাধীর যথাযথ সাজা না হয়, তখন পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাজনীতিতে দুর্বৃত্ত শ্রেণীর আগ্রাসন বৃদ্ধি পায়। যেসব অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে তা আইনের শাসনের দুর্বলতার কারণেই ঘটছে। এই শাসন বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সরকারের। এখানে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে খুন, ধর্ষণ, সংঘাত-সংঘর্ষসহ তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে হত্যার ঘটনা বাড়তেই থাকবে।
দেশে এখন রাজনৈতিক আন্দোলন নেই। বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধী দলের কর্মসূচি দমন থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পেয়েছে। তবে পুলিশের যে কাজ জনগণের সেবা করা, এ কাজটি তারা কতটা করতে পারছে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। পুলিশের কাজ শুধু অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর অপরাধী ধরে জেলহাজতে পাঠানো নয়। অপরাধ যাতে সংঘটিত না হতে পারে এ ব্যাপারেও তাদের ভূমিকা রয়েছে। সামাজিক এমনকি পারিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের দায়িত্ব রয়েছে। যেহেতু পুলিশকে বলা হয় জনগণের বন্ধু, তাই বন্ধু হয়ে সমাজের মানুষের খোঁজ-খবর রাখা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এর নজির আমরা করোনার সময় দেখেছি। সে সময় যখন সন্তান পিতা-মাতাকে ছেড়ে পালিয়েছে কিংবা আপনজনরা করোনাক্রান্তের পাশে দাঁড়ায়নি, তখন পুলিশ সদস্যরাই তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তখন সকলেরই মনে হয়েছে, পুলিশ সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু। তাদের এই ভূমিকা সর্বস্তরের মানুষের কাছে ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে, এর মধ্যে রাজনীতি না থাকা। আসলে পুলিশকে যদি রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং বিভাজনের কাজে ব্যবহার না করে পুলিশের মূল কাজ করতে দেয়া হয়, তবে সে যে জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, তা করোনার সময় দেখা গেছে। সে সময় দলমত নির্বিশেষে সকলের পাশেই পুলিশ দাঁড়িয়েছে। করোনাক্রান্তের পাশে যেমন তাকে দেখা গেছে, তেমনি অসহায় মানুষকে খাবার পৌঁছে দেয়ার কাজও করতে দেখা গেছে। মানুষের কাছে পুলিশ সত্যিকারের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। তবে করোনার প্রকোপ যতই কমছে এবং স্বাভাবিক সময় ফিরে আসছে পুলিশের অবস্থানও যেন সেই আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। তা নাহলে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে কেন? বলা বাহুল্য, এর জন্য পুলিশকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারের মানসিকতা দায়ী। এই যে বিরোধী দল সভা-সমাবেশ করছে, দেখা যাচ্ছে, সেখানে পুলিশ আক্রমণাত্বক হয়ে উঠছে। এর কারণ, বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দিতে সরকারের অনীহা। অথচ সরকারি দলের সভা-সমাবেশে যখন সংঘাত-সংঘর্ষ বাঁধে তখন পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে। এ থেকে বোঝা যায়, যেকোনো কাজে সরকার তার ইচ্ছামতো পুলিশকে ব্যবহার করছে। যদি পুলিশকে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতা দেয়া হতো, হস্তক্ষেপ না করত, তাহলে সংঘাত-সংঘর্ষ ও অপরাধ অনেকটাই কমে যেত। পরিবার ও সমাজে একের পর এক যেসব অস্বাভাবিক ও অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে চলেছে, তা নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হতো। পুলিশকে যদি দল-মত নির্বিশেষ যেই অপরাধ করুক তাকে আইনের আওতায় আনার পুরো স্বাধীনতা দেয়া হতো, তাহলে এমনিতেই অপরাধ অনেকাংশে কমে যেত।
পুলিশকে বলা হয়, শৃঙ্খলা ও নীতি-নৈতিকতা রক্ষার অন্যতম প্রতীক। পৃথিবীর অনেক দেশেই পুলিশ পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টি ও রক্ষায় কাজ করে। এমনকি পরিবারের কোনো সদস্য অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠলে পুলিশ গিয়ে তাকে ও তার পরিবারকে মোটিভেশনাল পরামর্শসহ কি করতে হবে তা বলে দেয়। ইউরোপ-আমেরিকায় পুলিশকে এ কাজটি করতে দেখা যায়। আমাদের দেশে স্বল্প পরিসরে হলেও এ কাজটি শুরু হয়েছে। পারিবারিক কলহ মিটাতে পুলিশের হেল্প লাইন খোলা হয়েছে। অনেকে এই হেল্প লাইনের সহায়তা নিচ্ছে। পুলিশের এই ভালো উদ্যোগটি যাতে ভয়ের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় এ বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। বলার অপেক্ষা রাখে না, পুলিশ সমাজের বাইরের কেউ নয়। তারা সমাজেই বসবাস করে এবং তাদেরও পরিবার-পরিজন রয়েছে। এই সমাজ ও পরিবারের মূল্যবোধ রক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তার উপর পড়ে। একজন পুলিশ সদস্য যে এলাকায় বসবাস করেন কিংবা দায়িত্ব পালন করেন, নিশ্চয়ই তিনি তার এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালভাবেই জানেন। সে এলাকায় অপরাধের ধরণ কি, কারা জড়িত তা তার জানা থাকে। কাজেই পুলিশ যদি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তবে সেই এলাকায় অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই যে পরিবার এবং সমাজে নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে এটাই প্রতীয়মান হয়, পুলিশ যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারছে না কিংবা করতে দেয়া হচ্ছে না। এ প্রবণতা যদি চলতে থাকে, তবে অপরাধ বৃদ্ধি ছাড়া কমবে না।
পরিবার ও সমাজে যেসব অকল্পনীয় অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেবল দাগী ও চিহ্নিত অপরাধী নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই যে কিশোর গ্যাং ভয়ংকর হয়ে উঠছে তা দমনে পুলিশকে শুধু তাদের গ্রেফতার করে জেলহাজতে নিয়ে দায়িত্ব পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এসব অপরাধীর পরিবার এবং সমাজের অভিভাবক শ্রেণীর কাছে যেতে হবে। কেন কি কারণে কিশোরটি অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, তার কারণ বের করে সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য যেসব সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে, তার কারণ উদঘাটন করে সমাজে তার প্রতিকারের মোটিভেশনাল ম্যাসেজ দিতে হবে। পুলিশকে সামাজিক এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। চিহ্নিত অপরাধীদের তো নির্মূল করতেই হবে, সেই সঙ্গে অপরাধ প্রবণতা ঠেকাতে অপরাধের ধরণ অনুযায়ী কি শাস্তি রয়েছে, তা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। জনপ্রতিনিধি ও সমাজের অভিভাবক শ্রেণীর সঙ্গে নিয়মিত ভিত্তিতে বৈঠকের আয়োজন করে সমাজ ও পরিবারের নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। তাহলে পরিবার ও সমাজে যেসব অকল্পনীয় এবং নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটছে, তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।