Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে আর কত সময় লাগবে?

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

রাজধানীসহ দেশজুড়ে সরকারের বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের কাজ বছরের পর বছর ধরে চলছে। রাজধানীতে রয়েছে আটটির মতো প্রকল্প। এগুলোর মধ্যে মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপেস ওয়ে, বিআরটি, ঢাকা-অশুলিয়া এক্সপ্রেস ওয়ে, কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন কেন্দ্র করে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব, বৃত্তাকার সড়ক ও রেলপথ, হাইস্পীড ট্রেন, বিমানবন্দর গোলচত্ত¡রে আন্ডারপাস প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। এসব প্রকল্পের কোনোটার নির্মাণ কাজ চলছে, কোনোটার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ করার নির্ধারিত মেয়াদ থাকলেও তা শেষ হয় না। যে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় পাঁচ বছর তা শেষ করতে লেগে যাচ্ছে দশ বছর। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে ছোট-বড় যেসব প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়, তা কোনো কালেই ঐ মেয়াদে শেষ হয় না। এমনকি যে বাজেট ধরা হয়, তাও ঐ বাজেটে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং বাড়তেই থাকে। আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রকল্পের কাজ দ্রæত সময়ে এবং নির্ধারিত বাজেটের মধ্যে শেষ করা জরুরি, সেখানে সময় ও অর্থ দুটোই বাড়ানো হয়। এর কারণ কি? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, প্রথমত প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পরিকল্পনার অভাব। দ্বিতীয়ত প্রকল্পের সময় ও অর্থ বাড়িয়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করা। যেকোনো প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে যথাযথ পরিকল্পনার অভাব থাকে, তা প্রকল্পের কাজ দেখলেই বোঝা যায়। কাজ শুরু হলেও তার গতি যে এত ধীর হয়ে পড়ে, তা কবে শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারে না। প্রকল্পের সুফল পেতে পেতে এক জেনারেশন চলে যায়। তাদের দেখে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। আবার দেখা যায়, কিছুদিন কাজ চলে থেমে থাকে। এই ধীর গতি ও থেমে থাকা থেকেই কারো বুঝতে বাকি থাকে না, এ প্রকল্পে গলদ রয়েছে। যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া এবং সময় ও বাজেট বৃদ্ধি থেকে একজন সাধারণ মানুষও বোঝে এর পেছনে দুর্নীতির বিষয়টি রয়েছে। সাধারণত গড় হিসেবে প্রকল্পের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও তা এক যুগেও শেষ হয় না। যেমন এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। এটি চালু হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। এ সময়ের মধ্যে শেষ না হওয়ায় ৯ বছর বাড়িয়ে ২০২২ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। ভাবা যায়, তিন বছরের একটি প্রকল্পের কাজ বাড়িয়ে ১২ বছর করা হয়েছে? তাহলে, শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদ কোন হিসেবে তিন বছর ধরা হয়েছিল? কেন এ সময়ের মধ্যে শেষ করা যায়নি? প্রকল্পের সময় যদি বৃদ্ধি করাও হয়, তাহলে তা কি এক যুগ বৃদ্ধি করতে হবে? এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নে নিযুক্ত তারা সঠিকভাবে পরিকল্পনা করতে পারে না। কত সময়ে ও কিভাবে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে, এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। বলা বাহুল্য, যেকোনো প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি মানে ব্যয় বেড়ে যাওয়া। ব্যয় বৃদ্ধি মানে দুর্নীতির পথও প্রশস্ত হওয়া। দেশে এমন কোনো বড় প্রকল্প নেই যা নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হয়েছে বা হবে। গত এক যুগে পদ্মাসেতুসহ যেসব মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে, সেগুলোর প্রত্যেকটিরই মেয়াদ ও বাজেট বাড়ানো হয়েছে। সরকার এসব প্রকল্পকে উন্নয়নের মহাসড়ক হিসেবে বিবেচনা করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই মহাসড়কে উঠবে কবে?

রাজধানীতে যেকোনো ছোটখাটো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলে তার ভোগান্তির শেষ থাকে না। এক সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতেই মহাদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় যখন মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের মতো বিশাল প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়, তখন ভোগান্তি কোন পর্যায়ে পৌঁছে, তা নগরবাসী হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। এই যে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের কাজ চলছে, তার ভোগান্তি বছরের পর বছর ধরে চলছে। প্রকল্প দুটির নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোর প্রায় পুরো অংশ দখল করা হয়েছে। এতে যান চলাচলের কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা ভুক্তভোগী নগরবাসী ভালো করেই জানে। সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, উন্নয়নের সুফল পেতে হলে ভোগান্তি সহ্য করতে হবে। জনগণও উন্নয়নের বিপক্ষে নয়। তবে উন্নয়নের নামে যে ভোগান্তি তা কাহতক সইতে হবে? এর সময়সীমা কত? এসবের তো কোনো হিসাব-নিকাষ নাই। যদি এমন হতো, প্রকল্পের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে এবং তা ঐ সময়ের মধ্যে শেষ হবে, তাহলে জনগণের তা মেনে নিতে সমস্যা নেই। অনির্দিষ্ট কাল ধরে যদি চলতে থাকে তা কি মেনে নেয়া যায়? এর উপর একটির কাজ শেষ না হতেই আরেকটির কাজ ধরা হচ্ছে। অর্থাৎ উন্নয়ন কাজের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয় নেই। পৃথিবীর কোনো দেশে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে এমন সমন্বয়হীনতা দেখা যায় না। উন্নত বিশ্বে একটি প্রকল্পের মেয়াদ দশ বছর ধরলে দেখা যায়, তারা তা তিন বছরে শেষ করে। আর আমাদের দেশে উল্টো কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর ধরলে তা শেষ করতে এক যুগ লাগিয়ে দেয়া হয়। এই যে এক যুগ ধরে প্রকল্পের কাজ চলতে থাকে, এতে এক জেনারেশনের মানুষ যেমন চলে যায়, তেমনি জনগণের বিপুল অর্থের অপচয় হয়। তাদের ভোগান্তির সীমা-পরিসীমা থাকে না। সাধারণত যেকোনো প্রকল্পের কাজ ধরার আগে এর কারণে কি কি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে এবং তা কিভাবে সমাধান করা হবে, তার পরিকল্পনা থাকা জরুরি। আমাদের দেশে উন্নয়ন প্রকল্পে এর কোনো কিছুই বিবেচনা করা হয় না। প্রকল্প নিয়েই তা শুরু করা হয়। এই যে রাজধানীতে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে, তাতে জনগণের কি ধরনের ভোগান্তি ও সমস্যা হতে পারে, তা আগেভাগে চিন্তা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। একের পর এক সড়ক দখল করে নির্মাণ কাজ শুরু করে দেয়া হয়েছে। যানবাহন কিভাবে চলবে এবং যানজট কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তার কোনো পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। দেখা যাচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যানজটসহ মানুষের জীবনযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে আটকে পড়ে মানুষের শারিরীক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি অপরিমেয় অর্থের অপচয় হচ্ছে। তাছাড়া, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে যে ধুলোবালি সৃষ্টি হচ্ছে, তা পুরো রাজধানীকে ধুলার নগরীতে পরিণত করেছে। বায়ু দূষণে ঢাকাকে এক নম্বর দূষিত নগরীতে পরিণত করছে। ধুলার কারণে মানুষ নানা রোগ-বালাইতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বছর অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। যে উন্নয়ন মানুষের জীবন ক্ষয় করে দেয় এবং তার সুফল পেতে পেতে পৃথিবী থেকেই চলে যেতে হয়, সে উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। যানজট নিয়ন্ত্রণে যেসব ফ্লাইওভার রয়েছে, সেগুলোও এখন আর কাজ করছে না। যানজট এখন নিচ থেকে উপরে উঠে গেছে। প্রায় প্রতিটি ফ্লাইওভারে যানজট সৃষ্টি হওয়া এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ফ্লাইওভারও উন্নয়নের একটি অংশ। দেখা যাচ্ছে, এই উন্নয়ন এখন কোনো কাজে আসছে না।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতেই হবে। তবে এ সংক্রান্ত যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেগুলো যত দ্রæত বাস্তবায়িত হবে, উন্নয়নও তত দ্রæত হবে। দেখা যাচ্ছে, একের পর এক প্রকল্প নেয়া হলেও তা যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। এই শেষ না হওয়ার কারণে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় হচ্ছে, তেমনি বিপুল অর্থও ব্যয় হচ্ছে। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগকৃত লাখ লাখ কোটি টাকা উঠে এসে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হতে যে যুগের পর যুগ চলে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। অথচ সমন্বয় করে এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে আমরা যে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠার কথা বলছি, তাতে দ্রæত উঠা যেত, উন্নয়নও ত্বরান্বিত হতো। দুঃখের বিষয়, এ কাজটি করা হচ্ছে না। একের পর এক উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে ঠিকই, তবে সমন্বয় না থাকায় এগুলো এখন উন্নয়নের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে জনভোগান্তি থেকে শুরু করে অর্থ ও সময়ের ব্যাপক অপচয় হচ্ছে। এসব প্রকল্পের সুফল অনেকে পাবে কিনা বা দেখে যেতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। আমরা মনে করি, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। তবে এসব প্রকল্প যাতে সুসমন্বয় ও সুপরিকল্পনা মাফিক করা হয়, সবার আগে এ বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অপরিকল্পিতভাবে শুরু করলে তাতে যেমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তেমনি সময় ও অর্থ দুটোরই অপচয় হয়। সরকারের উচিৎ যেকোনো প্রকল্প যাতে সময়মতো ও বাজেট অনুযায়ী শেষ করা যায়, তা নিশ্চিত করা। তা নাহলে দেখা যাবে, সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে, প্রকল্প আর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। উন্নয়নের মহাসড়কে উঠার পথটিও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হয়ে উঠবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মহাসড়ক

২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
২১ ডিসেম্বর, ২০২২
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন