Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানী কি এমন হতে পারে?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

রাজধানীর চিত্র দেখে একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, উন্নতি ও সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বলা যায়, রাজধানী হচ্ছে, দেশের সামগ্রিক চিত্রের নমুনা বা মুখাবয়ব। মানুষের মুখের ভাব দেখে যেমন তার রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, মান-অভিমান, হাসি-আনন্দ বোঝা যায়, তেমনি একটি দেশের রাজধানীর চেহারা দেখেও তার অবস্থা অনুমান করা যায়। সার্বিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ, তা ধনী কিংবা দরিদ্র হোক, রাজধানীর মাধ্যমে দেশের ভাবমর্যাদা তুলে ধরতে চেষ্টার ত্রুটি করে না। অর্থনৈতিক অবস্থা যেমনই হোক, রাজধানীকে একটি সুন্দর মুখ হিসেবে উপস্থাপন করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। তা নাহলে বিশ্ব দরবারে সভ্যতা ও মানসম্মান বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে নামী-দামী ব্যক্তিবর্গ ও পর্যটকরা রাজধানীতেই আসেন। রাজধানীর চেহারা দেখে তারা দেশটির উন্নতি, অগ্রগতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। তাদের মনে ইতিবাচক ধারণা জন্মালে বিশ্বে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এজন্য প্রত্যেক দেশের সরকার রাজধানীকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। আমরা যদি পর্শ্ববর্তী ভারতের কথা ধরি, তাহলে দেখা যাবে, তার রাজধানীসহ বড় বড় শহর বেশ পরিপাটি করে গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের ঝকঝকে ও চকচকে উপস্থাপন জানান দিচ্ছে ‘সাইনিং ইন্ডিয়া’। অথচ দেশটির জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ এখনও খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করে। যথাযথ স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই। শুধু রাজধানী ও কিছু শহরকে আধুনিক করে বিশ্বকে দেখাচ্ছে, তারা বিরাট উন্নতি করছে।

দুই.
একটি নগরীর জন্ম, বৃদ্ধি এবং মৃত্যু আছে। এমনকি স্থানান্তর করার নজিরও আছে। পৃথিবীতে যেমন নতুন নতুন নগরীর জন্ম হয়েছে, তেমনি অনেক নগরী ধ্বংসও হয়ে গেছে। এসব নগরী ধ্বংস হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, অপরিকল্পিত কর্মকান্ড, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে ট্রয় নগরী বারবার ধ্বংস হয়েছে। পুনরায় তা গড়ে তোলা হলেও রক্ষা করা যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডন, বার্লিন, ওয়ারস নগরী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে পড়েছিল। আবার আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে প্রথম শতকে পম্পেই নগরী পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ১৭৫৫ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামিতে পর্তুগালের লিসবন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পুনরায় তা গড়েও তোলা হয়। এসব শহর ধ্বংসের কারণ উল্লেখ করা হলো এজন্য যে, শহর বা নগর যে কোন কারণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তবে জেনেবুঝে শহর ধ্বংস করার নজির বিশ্বে নেই বললেই চলে। এ নজির সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের রাজধানীতে। এখানে যেভাবে অপরিকল্পিত কর্মকান্ড হচ্ছে, তাতে প্রকৃতির চেয়ে মানুষের দায় সবচেয়ে বেশি। এসব কর্মকান্ড প্রকৃতিকে রুষ্ট করে তুলছে এবং প্রকৃতি যদি তা ধ্বংস করে দেয়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমরা যদি ভূমিকম্পের কথাই ধরি, তাহলে এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ঢাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবল ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলের মধ্যে ঢাকা রয়েছে। তারা বলেছেন, মাঝারি আকারের ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ৭২ হাজার ভবন নিমেষে ধ্বসে পড়বে। এতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। ভূমিকম্পের এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে, অপরিকল্পিতভাবে রাজধানীর বিস্তৃতি ও অপরিনামদর্শী কর্মকান্ড। এক হিসেবে দেখানো হয়েছে, প্রতি বছর রাজধানীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এক মিটার করে নেমে যাচ্ছে। এতে মাটির নিচে যে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে নতুন পানি জমা হতে পারছে না। এর কারণ রাজধানীর অভ্যন্তরে যেসব জলাধার, খাল ও লেক ছিল সেগুলোর বেশিরভাগ দখল ও ভারাটের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঢাকার চারপাশে মিষ্টি পানির নদী প্রবাহিত হলেও সেগুলো দখল আর দূষণে মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ফলে পর্যাপ্ত পানির অভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। নগরবিদরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে ঢাকায় কোন ভূগর্ভস্থ পানি থাকবে না। এর ফলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগের আশঙ্কার মধ্যেই ঢাকাকে নিয়ে যে তুঘলোকি কান্ড চলছে, তাতে এটি এখন আর বাসযোগ্য নেই। অসভ্য ও হতাশার নগরে পরিণত হয়েছে। নিদারুণ হতাশার মধ্যেই এর বাসিন্দারা বসবাস করছেন। অথচ তারা নগরীর উন্নয়নে ট্যাক্স দিলেও সেবা পাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাদের ট্যাক্সের পয়সায় নগর কর্তৃপক্ষ ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সেবা করছে। নগরবাসীর সেবার নামে যেসব কর্মকান্ড করছে, তাতে তাদের নাভিশ্বাস অবস্থার মধ্যে রেখেছে। যানজট, পানিবদ্ধতা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ থেকে শুরু করে হেন কোনো সমস্যা নেই যার শিকার তারা হচ্ছে না। বিভিন্ন সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নের নামে নির্বিচারে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি যুগের পর যুগ ধরেই চলে আসছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু লেখালেখি হয়েছে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে শুষ্ক মৌসুমে তাদের কর্মকান্ড চালানোর পরামর্শও নগরবিদরা বারবার দিয়েছেন। এসব কথা তারা আমলে নেয়নি এখনও নিচ্ছে না। এসব কথায় কান না দিয়ে তারা তাদের সমন্বয়হীন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। উল্টো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির দায় এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের উপর চাপিয়ে এক ধরনের পারস্পরিক দোষারোপের মধ্য দিয়েই তাদের কার্যক্রম চলছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েরও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। কেন নেয় না, তা তারাই ভাল বলতে পারবে। তবে নগরিকদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল, অসময়ে এসব উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের বেশিরভাগ কার্যাদেশের সাথে সরকারি দলের লোকজন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জড়িত থাকেন। বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খুঁড়ে বৃষ্টির উছিলা দিয়ে তা যথাসময়ে শেষ করা হয় না। সময় বেশি লাগিয়ে, বাজেট বাড়িয়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করা হয় বলে নগরবিদরা মনে করেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শুষ্ক মৌসুমে উন্নয়নমূলক কর্মকন্ডে শুরুর তাগিদ তারা বরাবর দিয়ে আসছেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়, আর্থিক বছরের অর্থছাড় হতে হতে বর্ষা শুরু হয়ে যায়। ফলে বর্ষায়ই তাদের কাজ শুরু করা ছাড়া বিকল্প থাকে না। এটা এক ধরনের বাহানা ছাড়া কিছু নয়। তারা যাতে এ ধরনের বাহানা সৃষ্টি করতে না পারে এজন্য পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থবছর এমন সময়ে শুরু করা দরকার যাতে বর্ষায় উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড শুরু করতে না হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই জানুয়ারী থেকে অর্থ বছর শুরু হয়। আমাদের দেশেও অর্থ বছর এ সময়ে শুরু করা যায় কিনা, তা সরকারের বিবেচনা করা দরকার। তাহলে বর্ষার উছিলা দিয়ে উন্নয়ন কর্মকান্ডে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে অর্থের অপচয় যেমন রোধ করা যাবে তেমনি দুর্নীতির সুযোগও অনেকটাই বন্ধ হবে।

তিন.
ঢাকাকে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন ও গর্বের শেষ নেই। পৃথীবির সবচেয়ে দূষিত ও অসভ্য নগরী হিসেবে দুর্নাম হলেও, ঢাকা আমাদের প্রাণের শহর। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিকসহ সবকিছুরই প্রাণকেন্দ্র। যত সমস্যাই থাকুক ঢাকা ছেড়ে কেউ যেতে চায় না। সারা দেশের মানুষ ঢাকার দিকেই তাকিয়ে থাকে। কোনো রকমে ঢাকায় একবার থাকার মতো ব্যবস্থা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। এই প্রবণতার কারণে প্রতিদিন ঢাকামুখী মানুষের ঢল নামছে। হু হু করে বাড়ছে এর জনসংখ্যা। এখন ঢাকায় বসবাস করে সরকারি হিসেবেই প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। বেসরকারি হিসেবে আরও বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের দিকে এ জনসংখ্যা দাঁড়াবে আড়াই কোটি। হবেই বা না কেন? প্রতিদিন যদি সারা দেশ থেকে আড়াই-তিন হাজার মানুষ প্রবেশ করে, তবে ঢাকার জনসংখ্যা তিন-চার কোটিও হতে পারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা নগরীর প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় তিন হাজার লোক বসবাস করে। বিশ্বে এমন ঘন বসতিপূর্ণ শহর আর একটিও নেই। জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত এই শহরে। গাদাগাদি করে বসবাস করছে মানুষ। এই বিপুল সংখ্যক নগরবাসীর সুযোগ-সুবিধার মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ডও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। একটি আদর্শ রাজধানীর সুযোগ-সুবিধা কেমন, এ অভিজ্ঞতা ঢাকার মানুষের নেই বললেই চলে। সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত সিটি করপোরেশনসহ যেসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো পরিচালনার ট্যাক্স নগরবাসী দিলেও তার বিপরীতে যে ন্যূনতম সেবা পাওয়ার কথা, তা প্রতিষ্ঠানগুলো দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। নগরবাসীর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার দায়িত্ব যে ওয়াসার, প্রতিষ্ঠানটি তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তার সরবরাহকৃত পানি ময়লা-আবর্জনা, ঘোলা ও দুর্গন্ধযুক্ত। এ পানি পান করা দূরে থাক ঠিকমতো রান্না-বান্না, কাপড়-চোপড় ধোয়া ও গোসল করা মুশকিল। ঢাকা শহরের কতভাগ মানুষ ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি পান করে, তার পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। পরিসংখ্যান করলে দেখা যেত, শতকরা ২ ভাগ মানুষও এ পানি পান করে কিনা সন্দেহ। এই দূষিত পানিই ওয়াসা বেশ চড়া দামে নগরবাসীর কাছে বিক্রি করছে। অথচ আমাদের মতো অনেক দেশেই সরকারিভাবে যে পানি সরবরাহ করা হয়, তা নিঃশংসয়ে মানুষ পান করে। উন্নত বিশ্বের নাগরিকরা তো সরাসরি ট্যাপের পানি পান করে। পরিতাপের বিষয়, মিষ্টি পানির অফুরন্ত ভান্ডারের দেশ হওয়া সত্তে¡ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ওয়াসার কাজ শুধু বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করাই নয়, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ঠিক রাখা। ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেমের কী করুণদশা তা বোধকরি নতুন করে বলার কিছু নেই। এটা কি ভাবা যায়, রাজধানীর ৮০ ভাগ এলাকায়ই স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা নেই! ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই বেশিরভাগ সড়কে হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি জমে যায়। রাজধানীর যে চিরায়ত যানজট, এ জট তীব্র আকার ধারণ করে বৃষ্টির সময়। রাস্তায় জমে থাকা পানি দিয়ে মানুষ চলাচল দূরে থাক যানবাহনও চলতে পারে না। বাধ্য হয়ে চলতে গিয়ে খানাখন্দ ও ওয়াসার খোলা ম্যানহোলে পড়ে অনেককে হতাহতও হতে হয়। আমরা দেখেছি, ওয়াসার ম্যানহোলে শিশুর করুণ মৃত্যু, বৃষ্টির পানিতে গর্তে পড়ে মানুষের আহত হওয়া। এসবের দায়দায়িত্ব ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নেয়নি। এমনকি ন্যূনতম দুঃখও প্রকাশ করেনি। এ ধরনের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা কি সভ্যতার মধ্যে পড়ে? যানজটের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ শহর। বলা হয়, যানজটই ঢাকাকে অচল ও স্থবির একটি শহরে পরিণত করেছে। শুধু যানজটে আটকা পড়ে ঢাকা শহরে প্রতিদিন মানুষের ৩২ লাখ শ্রমঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। এই শ্রমঘন্টার মূল্যমান বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে যদি শুধু যানজটের কারণে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান হয়, তবে উন্নয়নের চাকাটি সচল থাকবে কিভাবে? যদি এ অর্থ ক্ষতি না হতো, তাহলে দেশের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো-এ চিন্তাটি কেউ করছে বলে মনে হয় না। সরকারের নীতি-নির্ধারকদেরও যেন কোনো মাথাব্যাথা নেই। যানজটে যে শুধু আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, মানুষের কাজকর্মও স্থবির করে দিচ্ছে। যে কাজ এক ঘন্টায় শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, সে কাজ করতে চার-পাঁচ ঘন্টা, এমনকি দিনও চলে যায়। এতে কর্মজীবী একজন মানুষের যে মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, এর দায় কেউই নেয় না। গুরুতর রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছানো তো এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের একমুহুর্ত বিলম্ব করার সুযোগ নেই, সেখানে যানজটে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এ দৃশ্য কোনো দেশের রাজধানীতে দেখা যায় কিনা, জানা নেই। তবে এটা জানি, আমাদের রাজধানীতে এ চিত্র নিত্যদিনের এবং অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এসব খবর খুব কমই নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছায়। অথচ যে রোগী মৃত্যুবরণ করে সে যদি একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হন, তাহলে সে পরিবারটির কী দুর্দশা হয়, তা আমরা কজনই বা খোঁজ রাখি! বলা হয়, যানজটের অন্যতম কারণ ঢাকা শহরের রাস্তা-ঘাটের স্বল্পতা। একটি আদর্শ নগরীতে সড়ক পথের জন্য শতকরা ২৫ ভাগ জায়গা থাকতে হয়। ঢাকায় আছে মাত্র ৭ ভাগ। এই সড়ক দিয়েই প্রতিদিন লাখ লাখ যানবাহন যাতায়াত করে। এই সড়কেরও একটি বিরাট অংশ বেদখল হয়ে আছে। পরিস্থিতি যদি এই হয়, তবে যানজট থেকে কোনো দিনই মুক্তি মিলবে না। বড় বড় ফ্লাইওভারগুলোও এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এখানেও যানজট। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, ৭ ভাগ সড়কও যদি যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবহার করা যেত, তাহলে যানজট অনেক সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হতো। প্রশ্ন হচ্ছে, এ কাজটি করবে কে? এ দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হলেও, তারা কি তা করতে পারছে? উল্টো এমন চিত্র দেখা যায়, সড়ক দখলমুক্ত করার পরিবর্তে সিটি করপোরেশন ফুটপাতে দোকানপাট বসা এবং মূল রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের অনুমতি দিচ্ছে। এমনকি সিটি করপোরেশন এ বিষয়টিও আমলে নিচ্ছে না যানজটের অন্যতম কারণ যে রিকসা, সেই রিকসা চলাচলে সে যে লাইসেন্স দিয়েছে, তার চেয়েও বহুগুণ বেশি রাস্তায় চলাচল করছে। তার অনুমোদিত ৮০ হাজারের জায়গায় চলাচল করছে কয়েক লাখ। এই ধীরগতির যানটি মূল সড়কে যেমন খুশি তেমনভাবে চলছে। বিশ্বের কোনো দেশে এমন দৃশ্য দেখা যায় না। ডিজিটাল যুগে এসেও যদি রাজধানীকে রিকসার রাজধানীর পরিচিতি নিয়ে থাকতে হয়, তবে এর চেয়ে পরিতাপের আর কিছু হতে পারে না। রাজধানীতে নাগরিকদের জন্য আরও যে মারাত্মক দুটি ঘাতক রয়েছে তা হচ্ছে-শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ। বায়ুদূষণে শহরটি এখন বিশ্বের এক নম্বর। এর আর্থিক ক্ষতি বছরে সোয়া লাখ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এই দূষণে যে শুধু আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, নগরবাসী মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, ক্যান্সার, অ্যাজমা ও বধিরতাসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। শব্দদূষণও সীমা ছাড়া। মানুষের শব্দের সহনীয় মাত্রা ৫০ ডেসিবল হলেও ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় তা ৯০ ডেসিবল। কোথাও কোথাও ১২০ ডেসিবল। ঢাকার এক তৃতীয়াংশ মানুষ শব্দদূষণে আক্রান্ত। এভাবে শব্দদূষণ চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে। এদের এক অংশ পুরোপুরি বধির হয়ে পড়বে। দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় যারা বসবাস করছে, তারা এক ভয়াবহ পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে।

চার.
রাজধানীকে বলা হয় দেশের মস্তিষ্ক, আত্মা বা প্রাণস্পন্দন। মস্তিষ্ক বা হার্ট ভাল না থাকলে মানুষ যেমন ভাল থাকতে পারে না, তেমনি রাজধানী ভাল না থাকলে দেশও ভাল থাকতে পারে না। রাজধানীকে সুস্থ, বাসযোগ্য ও পরিপাটি করে গড়ে তুললে তার প্রতিক্রিয়া দেশে-বিদেশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে আমাদের দেশের যে বিপুল সম্ভাবনা তাকে ‘বুস্টআপ’ করে তুলতে রাজধানীকে বাসযোগ্য ও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। একটি উন্নয়নশীল বা মধ্যম আয়ের দেশের রাজধানী কেমন হয়, তা বিবেচনায় নিয়ে এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পরও যদি তার প্রতিফলন রাজধানীর চিত্রে দেখা না যায় এবং অবাসযোগ্যই থাকে, তবে বিশ্ব ও দেশের মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। সরকার ও রাজধানী কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টি মাথায় নিয়েই নগরায়ণ ও নগর পরিকল্পনা, জনসংখ্যা ও বাসস্থান, পরিবহন ও যোগাযোগ, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, সুশাসন, গণপরিসর ও উন্মুক্ত স্থান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নগরের সক্ষমতা, অর্থনীতি ও বিনিয়োগ, নগর পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য-এসব বিষয়গুলো পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে যে কোন মূল্যে বিষয়গুলোর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। শিল্পকারখানা ও আবাসিক এলাকার পাশাপাশি অবস্থান কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশ্বের কোথাও রাজধানীতে এমন দৃশ্য দেখা যায় না। ভারি শিল্পকারখানা, গার্মেন্ট ও কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে বিকল্প শিল্পপার্কে স্থানান্তরের মাধ্যমে ঢাকাকে হালকা করা প্রয়োজন। রাজধানীকে বিকেন্দ্রিকরণ করতে হবে। বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরগুলোতে রাজধানীর মতো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। এতে ঢাকামুখী মানুষের ঢল যেমন কমবে, তেমনি ঢাকার উপর থেকে চাপ কমাসহ নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ণের কাজও সহজ হবে। ঢাকাকে কোনভাবেই অবাসযোগ্য, অচল বা মৃত নগরে পরিণত হতে দেয়া যাবে না।
[email protected]



 

Show all comments
  • jack ali ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১১:৩০ এএম says : 0
    Since liberation we didnot have a ruler who knows how to rule a country... they knows how to terrorize people in every aspect in life and also they loot our hard earned money... they why we liberate our country from Pakisthan?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজধানী

১৩ ডিসেম্বর, ২০২২
১৭ নভেম্বর, ২০২২
১১ অক্টোবর, ২০২২
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন