পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত বৃহস্পতিবার আমরা দেখেছি, কীভাবে কোন পটভূমিতে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়। আমরা এটাও দেখেছি যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হওয়ায় আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয় ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন কর্তৃক সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত সকল দাবি দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। ফলে তখনকার মতো পরিস্থিতি শান্ত হয়ে ওঠে।
তবে অবস্থা যত সহজ মনে হয়েছিল, বাস্তবে ততটা সহজ ছিল না। এর কারণ ছিল রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে খাজা নাজিমুদ্দিনের চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে আন্তরিকতা ছিল না। তিনি শুধু পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন সফরে ঢাকার অবস্থা স্বাভাবিক দেখাতে ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এদিকে জিন্নাহ সাহেব যথাসময়ে ঢাকা আসেন। ঢাকায় এসে প্রথম রমনা রেস কোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় এবং পরবর্তীতে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দেন। উভয় স্থানে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উপর জোর দেন। উভয় স্থানে তাঁর রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বক্তব্যের প্রতিবাদ হয় উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্য থেকে। রেস কোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় কোন দিক থেকে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ ওঠে তা তিনি বুঝতে না পারলেও কার্জন হলের সীমিত সংখ্যক উপস্থিতির মধ্যে তাঁর রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বক্তব্যের বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ ওঠে, তখন তিনি অবাক হয়ে যান। কারণ এই তরুণ ছাত্রদের সমর্থন নিয়েই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে তিনি সক্ষম হয়ে ছিলেন।
তরুণ ছাত্রদের এ প্রতিবাদে তিনি বিস্মিত হয়ে কিছু ক্ষণের জন্য বক্তৃতা বন্ধ রাখেন। তারপর তিনি বক্তৃতা শেষ করে কার্জন হল থেকে বেরিয়ে যান। এরপর ছাত্র নেতাদের সাথে এ ব্যাপার তিনি ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। তবে তাঁর সঙ্গে ছাত্র নেতাদের এ বৈঠকে উভয় পক্ষ যার যার বক্তব্যে অটল থাকায় এ বৈঠক ব্যর্থ হয়। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় ছিল যে, ঐ বছরের (১৯৪৮) ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে আর কোন প্রকাশ্য বক্তব্য দেননি। বরং তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্নেল এলাহী বখসের সঙ্গে মৃত্যু শয্যায় একাধিকবার দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, অন্যের কথা বিশ্বাস করে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বক্তব্য দিয়ে তিনি মস্ত ভুল করেছেন। এটা তাঁর গণপরিষদের উপর ছেড়ে দেয়া উচিৎ ছিল। তাঁর এই ‘অন্যের কথায়’ বলতে তিনি নিশ্চয়ই খাজা নাজিমুদ্দিনকে বুঝিয়ে থাকবেন। কারণ ঢাকার নবাব বাড়ির এই সদস্য (খাজা নাজিমুদ্দিন) পারিবারিকভাবে উর্দুভাষী ছিলেন এবং মনে করতেন, পূর্ব বাংলার জনগণ নিশ্চয়ই উর্দু বোঝেন।
এর মধ্যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আর তেমন কোনো বড় বিতর্ক ওঠেনি। তবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রতি বছর ১১ মার্চ তারিখে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করে জানান দিয়ে যেতেন যে তাঁরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ভোলেননি। এর মধ্যে একবার বাংলা ভাষা উর্দু বা আরবী হরফে লেখার একটা অপচেষ্টা চালানো হলে সাপ্তাহিক সৈনিকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় তার প্রতিবাদ প্রকাশিত হলে সরকার এ ব্যাপারে পিছটান দেন।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ সাহেব যে ইন্তেকাল করেন সে কথা আগেই বলেছি। পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান নেতা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এক জনসভায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। এর পর ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা সফরে এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে ঘোষণা করে বসেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
যে নাজিমুদ্দিন পূর্ব বাংলার চিফ মিনিস্টার থাকাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি দাওয়া মেনে নিয়ে ১৯৪৮ সালে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই নাজিমুদ্দিনের এই বক্তব্যকে পূর্ব বাংলার জনগণ বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে গণ্য করে এর বিরুদ্ধে জোর আন্দোলন শুরু করে দেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের এই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের পক্ষ থেকে।
এই সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অবিভক্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম, খিলাফতে রব্বানী পার্টির নেতা, তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাসেম ও আবদুল গফুর (বর্তমান লেখক), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আবদুল মতিন প্রমুখ। এই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত হন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা কাজী গোলাম মাহবুব (পরবর্তী কালে বিএনপির অন্যতম নেতা)।
একুশে ফেব্রুয়ারি যাতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহূত প্রতিবাদ দিবস যাতে সফল হতে না পারে, সে লক্ষ্যে নূরুল আমীনের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। এ অবস্থায় কী করা হবে তা স্থির করার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সংগ্রাম পরিষদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে ছিলেন। কারণ তারা মনে করতেন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে দেশে বিশৃংখলা পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে, যা গণতন্ত্রের নিরিখে কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। অপর পক্ষে ছাত্র-তরুণদের মত ছিল পরিস্থিতি যাই হোক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতেই হবে, নইলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয় পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে সভা হবে, সেই সভায় যে সিদ্ধান্ত হয় সেটাই বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরবর্তী দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সে সভায় বক্তৃতা দেন, তবুও উপস্থিত ছাত্র তরুণদের অধিকাংশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন জোরদার করতে আহবান জানিয়ে বক্তৃতা দেন। ইতোমধ্যে ছোট ছোট গ্রুপে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার লক্ষ্যে বাংলা ভাষা সমর্থকরা বেরিয়ে যেতে থাকেন। ফলে পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে শাহাদত বরণ করেন বরকত, রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার প্রমুখ ভাষা শহীদদেরা। সে সময়ে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলছিল জগন্নাথ হলের মিলনায়তনে। সেখানে মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ প্রমুখ পুলিশের গুলিতে ছাত্র-তরুণদের শাহাদত বরণের প্রেক্ষাপটে আইন সভার অধিবেশন মূলতবী ঘোষণার দাবিতে পরিষদ বর্জন করে ওয়াক আউট করে বেরিয়ে আসেন।
এদিকে পুলিশের গুলিতে ভাষা আন্দোলনের সমর্থক তরুণদের শাহাদত বরণের সংবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সমস্ত পথ বিক্ষুব্ধ জনগণের বিভিন্ন শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। এসব শ্লোগানের ভাষা ছিল নিম্নরূপ: রাষ্ট্রাভাষা বাংলা চাই-নূরুল আমিনের কল্লা চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-নইলে বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই, বাংলা বিরোধীদের ক্ষমা নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটের উপর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বরকত, সালাম, শফিক প্রমুখের রক্তদানের ফলে সেই যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, এর পর ভাষা আন্দোলনের সমর্থকদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
এবার ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক নিয়ে কিছু কথা। উনিশ শ’ বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ঘটনাবলীর বর্ণনাসহ সাপ্তাহিক সৈনিক বের করে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করে বিশেষ সংখ্যা। বের হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেসব নিঃশ্বেষ হয়ে যাওয়ায় কিছুক্ষণ পর পুনরায় প্রকাশের প্রয়োজন হয়ে পড়ে প্রতিদিন একাধিক বার। তখন সমস্ত বাংলাভাষা সমর্থকদের যেন অস্থায়ী বাসস্থানই হয়ে ওঠে সৈনিক পত্রিকার অফিস ১৯ নং আজিমপুর রোড, যা ছিল অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসা।
ঐ বাসায় তখন আমিও থাকতাম তমদ্দুন মজলিসের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি দুই দিনই একাধিক বার পুলিশ এসে দেখে গেছে ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার স্বরূপ এই ১৯, আজিমপুর রোডের বাসা। নিশ্চয়ই উদ্দেশ্যে ছিল ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপাত্র সাপ্তাহিক সৈনিক প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করা। সাপ্তাহিক সৈনিক এর মুদ্রাকর ও প্রকাশক ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম এবং সম্পাদক ছিলাম আমি (আবদুল গফুর)। পুলিশের বার বার ১৯ আজিমপুর রোডের বাসায় আসার উদ্দেশ্যে ছিল পরিষ্কার। আমাদের গ্রেপ্তার করা। আমরাও এ ব্যাপারে কী করব, তা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা কিছুতেই ধরা দেব না।
অবশেষে উপস্থিত হল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত তিনটার দিকে পুলিশ এসে হানা দিল ১৯ নং আজিমপুর রোডের সেই বাসভবনের গেটে। পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেমের স্ত্রী মিসেস রাহেলা কাসেম গেটের ভিতরে থেকে পুলিশের এত রাতে একটি ফ্যামিলি কোয়ার্টারের গেটে আসার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তিনি বললেন এত গভীর রাতে আপনারা একটা ফ্যামিলি কোয়ার্টারে এসেছেন কেন? আপনারা কাল ভোরে আসুন। তখন আপনাদের জন্য দরজা খুলে দেব। যা বলার তখন বলবেন।
এইসব কথা বলে তিনি পুলিশের সাথে লম্বা তর্ক জুড়ে দিলেন। এই সুযোগে আমরা দু’জনে বাসার পেছনে অবস্থিত একটি গোরস্থান ও জঙ্গল পার হয়ে চলে গেলাম শেখ সাহেব বাজার রোডে আমাদের পরিচিত এক মেসের পেছনে। সেখানে মেসের সদস্য হিসেবে যাদের চিনতাম তাদের ডাকলাম। কিন্তু তারা শহরের অস্বাভাবিক অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের ডাকে সাড়া না দেয়ায় মেসের পাশে নীরবে মশার কামড় খেয়ে অপেক্ষা করতে হলো ভোর হবার জন্য।
ভোর হবার পর তাদের কাছ থেকে খড়ম নিয়ে চলে গেলাম ফজরের নামাজ পড়ার নামে দুই জন মসজিদের উদ্দেশে চলে গেলাম। সেখান থেকে আমি গেলাম ভাটি মসজিদের কাছে আমার পুরনো জাগীর বাড়ি, যেখানে আমি নিলুফার খাতুন নামের এক ছাত্রীকে পড়াতাম। অধ্যাপক আবুল কাসেম গেলেন কাছের আরেকটি পরিচিত বাড়িতে। আমি আমার পুুরনো জাগীর বাড়িতে গিয়ে উঠলে তাদের একটি গুদাম ঘরে আমার থাকার জায়গা করে দিয়ে বাহির থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হলো, যাতে বুঝা যায় এখানে কোনো লোক থাকে না, থাকে মালামাল।
আমাদের দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার ব্যবস্থা হলো আমার ছাত্রী নীলুফার খাতুনের মাধ্যমে। এরমধ্যে একদিন ঠিক হলো আমরা ঢাকা ত্যাগ করে চলে যাব জামালপুর জেলায় কাসেম সাহেবের শ্বশুর বাড়িতে। রওনা হবার আগে সেলুন থেকে একটা লোককে ডেকে এনে জীবনে একটি বারের জন্য আমার দাড়ি শেভ করে নিলাম, যাতে পুলিশকে ফাঁকি দেয়া যায়।
এরপর আমরা তেজগাঁ স্টেশন গিয়ে ট্রেনে চড়লাম, যথাসময়ে কাসেম সাহেবের শ্বশুর বাড়ি জামালপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে। যথাসময়ে আমরা কাসেম সাহেবের শ্বশুড় বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে প্রায় দু’ সপ্তাহ পার হয়ে গেল বেশ ভালভাবে। এর মধ্যে জানা গেল আমরা ঢাকা থেকে এখানে যে এসেছি তা এখানকার থানায়ও জানাজানি হয়ে গেছে।
ফলে পুনরায় বাসস্থান বদলাবার পালা। এবার আর দু’জন একসাথে নয়। কাসেম সাহেব গেলেন চট্টগ্রাম। আমি জামালপুর থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে ট্রেনে সিরাজগঞ্জ, ঈশ্বরদী, পোড়াদহ পার হয়ে কুষ্টিয়া গেলাম। সেখানে অবিভক্ত বঙ্গের অন্যতম মন্ত্রী শামসুদ্দিন আহমদের ভাই ডা. সদরুদিন আহমদের বাড়িতে একটি রুমে আমাকে আটকিয়ে রেখে ঘোষণা করে দেয়া হল, কঠিন য²া রোগী সুতরাং কেউ যেন ওদিকে না যায়। তবুও ওখানে নিরাপদ বোধ না করায় কিছু দিন পর চলে গেলাম তাদের এক নিকটাত্মীয় এডভোকেট (পরবর্তীতে ব্যারিস্টার) আবদুল হকের গ্রামের বাড়িতে যেটা অবস্থিত ছিল ভেড়ামাড়া স্টেশন থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে।
ইতোমধ্যে প্রায় দুই মাস পার হয়ে গেছে। ভাষা আন্দোলনের কারণে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের ছেড়ে দেয়া শুরু হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন করে কাউকে আর গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল না। এসব খবর জানার পর ঢাকায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঢাকায় এসে জানলাম, এডভোকেট আতাউর রহমান খানকে আহবায়ক করে নতুন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছে। ঢাকার সোওয়ারী ঘাটস্থ তাঁর বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করে জানলাম, অবস্থা এখন ভালো। সুতরাং পুনরায় স্বাভাবিক জীবন শুরু করলাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।