পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এখন ফেব্রুয়ারী মাস চলছে। আর বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারী এলেই সবার মনে পড়ে যায় ভাষা আন্দোলনের কথা। একুশে ফেব্রুয়ারী এদেশের শফিক-সালাম-জব্বার প্রমুখ তরুণের তাজা রক্তে রাজপথ রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে। বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দানের দাবীতে সেই যে সেদিন রক্তাক্ত হয়ে ওঠে রাজপথ, তারপর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীর প্রতি কেউ আর অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে পারেনি। একুশে ফেব্রুয়ারীর সে মহান ঘটনার স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার মধ্যদিয়ে।
আর জাতীয় ইতিহাসের নিরিখে বলা যায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য এখানে যে, এই আন্দোলনের সূত্র ধরেই আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে পেয়েছি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন না হলে এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জোরদার না হয়ে উঠলে আমরা যে আজ বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক, এই গৌরব বোধও আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠতো না।
এত সব কিছুর পরও আমরা অনেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কিভাবে কোন্ পটভূমিতে শুরু হয় তা জানি না। এটা যে আমাদের জন্য কতটা দু:খজনক ও দুর্ভাগ্যজনক তাও আমরা জানি না, বুঝি না। অথচ একুশে ফেব্রুয়ারীর আগের রাতে বারোটা বাজার পর কে কার আগে ভাষা শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে যাব তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি, এজন্য আমাদের সামান্যতম দু:খ বা অনুতাপ বোধ আসে না। এর চাইতে দু:খের বিষয় আর কী হতে পারে?
এ কারণেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঠিক ও পুর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী ও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এ ইতিহাস জানা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠেছে আরও এ কারণে যে ভাষা আন্দোলনের এ ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস সঠিকভাবে জানতে হলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক ইতিহাস জানা যে কতটা জরুরী তা বলার পর এবার রাষ্টভাষা আন্দোলন কোন্ ঐতিহাসিক পটভূমিতে শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে এবার আলোকপাত করতে যাচ্ছি।
তার আগে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি দুর্ভাগ্যজনক বিষয়ের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশেই একদা সা¤্রাজ্যবাদী বৃটেনের পদানত ছিল। এবং সে দুর্ভাগ্য শুরু হয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর পতনের মধ্যদিয়ে। তবে ১৭৫৭ সালে পলাশীতে জাতির সে ভাগ্য বিপর্যয়কে একদিনের জন্যও মেনে নিতে পারেননি আমাদের সেদিনের দেশপ্রেমিক পূর্ব পুরুষরা।
তারা ১৭৫৭ সালের পর প্রায় একশত বছর ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান মজনু শাহেব নেতৃত্বাধীন ফকীর আন্দোলন, হাজী শরীয়তউল্লা-দুদুমিয়া প্রমুখের নেতৃত্বাধীন ফারায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের নেতৃত্বাধীন বাঁশের কেল্লা আন্দোলন, বিভিন্ন কৃষক আন্দোলন প্রভৃতির মাধ্যমে সংগ্রাম চালিয়ে যান স্বাধীনতা ফিরে পেতে। কিন্তু প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের অসহযোগিতা এবং ইংরেজদের সঙ্গে জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখের গোপন যোগাযোগ এবং সর্বশেষে নবাবীর লোভ দেখিয়ে সিরাজউদ্দৌলার নিকটাত্মীয় ও প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁকে হাত করে নিতে সক্ষম হওয়ায় তাদের এসব স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থতায় পর্যবিসিত হয়।
সাম্রাজ্যবাদী বৃটেন শুধু এ করেই ক্ষান্ত হয়নি। নবাবী আমলে মুসলমানদের মধ্যে যাদের জমিদারী আয়মাদারী ছিল তাদের কাছ থেকে সেসব ছিনিয়ে নিয়ে ইংরেজ-অনুগত হিন্দু নেতাদের মধ্যে দিয়ে বিলিয়ে পলাশী যুদ্ধের অল্পদিনের মধ্যে পূর্বের ভূমি ব্যবস্থা বদলিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্থা নামে এক নতুন ভূমিব্যবস্থা প্রবর্তন করেন যার ফলে ইংরেজ অনুগত হিন্দু নেতাদের হাতে দেশের সিংহভাগ জমিদারী চলে যায়। দেশে এ অবস্থা চলতে থাকে পাকিস্তান আমলে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পূর্ব পর্যন্ত।
ইংরেজ শাসনকে এদেশের মুসলিম জনগণ একদিনের জন্যও খুশী মনে মেনে নিতে পারেননি, একথা আগেই বলেছি। কিন্তু প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের ইংরেজ-প্রীতির কারণে মুসলিম নেতৃবৃন্দের ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলন সফল হয়ে উঠতে পারেনি। পর পর পরাজয়ের ফলে মুসলিম নেতৃবৃন্দের অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে ওঠে। ফলে মুসলিম জনগণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান, বাংলার নওয়াব আবদুল লতিফ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সাময়িকভাবে হলেও ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে সম্প্রীতি স্থাপনের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষায় মুসলমানদের শিক্ষিত ও উন্নত করে তুলতে প্রয়াস পান। এই লক্ষ্যে স্যার সৈয়দ আলীগড়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার নওয়াব আবদুল লতিফ সেরকম কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম না হলেও সরকারী হিন্দু কলেজকে প্রেসিডেন্সী কলেজে রূপান্তরিত করে মুসলমানের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন।
এসব প্রচেষ্টার ফলে ধীরে ধীরে হলেও মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও উন্নত হওয়া অনেকটা সহজ হয়ে ওঠে। মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজ বিরোধী মনোভাব হ্রাস পাচ্ছে মনে করে এসময় এক শ্রেণীর খৃস্টান পাদ্রী ইসলামের নবী ও ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফ নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে ইসলাম বিরোধী আবহ সৃষ্টির অপচেষ্টা শুরু করে দেন। দেশে তখন আলেম-ওলামার অভাব ছিল না, কিন্তু তারা কেউ এসবের প্রতিবাদে এগিয়ে না আসায় যশোহরের এক গ্রাম্য দরজী এর প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন, যিনি মুন্সী মেহেরুল্লাহ নামে ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছেন ।
খৃস্টান পাদ্রীরা আশা করেছিল অর্ধ শিক্ষিত গ্রাম্য দরজীকে তারা সহজেই পরাজিত করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু একের পর এক বাহাস (প্রকাশ্য তর্ক যুদ্ধ)-এ তারা মুন্সী মেহেরুল্লাহর কাছে পরাজিত হয়ে শেষ দিকে তাঁর মোকাবেলা করা থেকে পিছিয়ে যান।
এর মধ্যে ইংরেজ শাসকদের সমর্থক আরেক নেতা ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর দাবীর মুখে ঢাকায় সরকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে রাজী হলে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তার তীব্র বিরোধিতা করা হয়। ফলে নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি। কারণ তিনি প্রাণত্যাগ করেন ১৯১৫ সালে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯২১ সালে। তাছাড়া ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শুধু ঢাকা শহরের কলেজগুলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকায় পূর্ব বাংলার অন্যসব জেলার কলেজও হাইস্কুল সমূহ আগের মত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই থেকে যায়।
এই দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা থেকে পূর্ববাংলার বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত কলেজ ও হাইস্কুলসহ মুক্তি পায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছিল আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অতিগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪০ সালের নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মর্মানুসারে। ঐ প্রস্তাব উত্থাপন তৎকালীন বাঙ্গালী মুসলমানদের অবিসমাদিত নেতা শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক, যদিও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ।
বর্তমানে আমরা যে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক, তার ভিত্তি ছিল ঐ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। সে নিরিখে বলা যায় ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব ছিল অত্যন্ত বাস্তবধর্মী। কারণ দেড় হাজার মাইনের ব্যবধানে অবস্থিত ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি ভূভাগ নিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে প্রায় নেই বললেই চলে।
তবে আরেকটি বিষয়ও এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানীসহ সেনা বাহিনী, নৌবাহিনী ও এয়ারফোর্সসহ সমগ্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদরদপ্তরই ছিল তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে এনিয়ে একটা হতাশা বোধ কাজ করছিল। এর আরেকটি কারণও ছিল। ১৯৪৬ সালের যে সাধারণ নির্বাচনে উপমহাদেশের মুসলমানরা অখÐ ভারতের সমর্থক, না পাকিস্তানের সমর্থক এ প্রশ্নের জবাবে একমাত্র তৎকালীন বাংলার মুসলমানরাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে ভোট দিয়ে হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা গঠনে সক্ষম হয়।
এভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাংলার মুসলমানদের ঐতিহাসিক অবদান থাকায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে তাদের প্রত্যাশা ও ছিল অত্যধিক। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রাজধানীসহ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রভৃতি পশ্চিম পাকিস্তানে অধিষ্ঠিত হওয়ায় পর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে একটা হতাশা বিরাজ করছিল।
এসবের সাথে যুক্ত হয়েছিল নতুন রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অবাঙ্গালী উর্দুভাষীদের আধিক্য থাহার ফলে নতুন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে চালানোর একটা অপচেষ্টা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় নতুন রাষ্ট্রের পোস্ট-কার্ড, এনভেলপ, মানি অর্ডার ফর্ম প্রভৃতিতে ইংরেজীর পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার দেখে। অথচ সে সময় সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশের জনসংখ্যার চাইতেও অধিক।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত “পাকিস্তানের রাষ্ট্র বাংলা না উর্দু’’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। অনেকেই বলা হয়েছে যারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু করেন তারা সবাই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনে কর্মী ও সমর্থক। যে পাকিস্তানের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়, তার লেখক ছিলেন তিন জন : তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাহিত্যিক ড. কাজী মোতাহার হোসেন এবং বিখ্যাত সাংবাদিক সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ।
এর মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেমের লেখায় ভাষা আন্দোলনের মূল দাবীগুলো তুলে ধরা হয় এভাবে : (এক) পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালতের ভাষা হবে বাংলা (দুই) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। (তিন) কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের ভাষা হবে দুটি : বাংলা ও উর্দু।
সমগ্র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয় এই দাবীসমূহ আদায়ের লক্ষ্যে।
কিন্তু গোড়ার দিন থেকেই এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয় যে এগুলো করেছে যারা তারা নাকি ভারতের গুপ্তচর। অথচ আগেই বলা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যারা শুরু করেন তাদের সবাই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ও কর্মী।
ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে। ১৯৪৭ সালেই ভাষা আন্দোলনের এই প্রথম সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক (পরে ড.) নূরুল হক ভূইয়াকে আহবায়ক করে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক কর্মীদের নিয়ে গঠিত ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই তমদ্দুন মজলিসের সুচিত ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেয়। ভাষা আন্দোলনে ছাত্র লীগের যোগদানের পর তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্র লীগের যৌথ সদস্য জনাব শামসুল আলমকে আহবায়ক করে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ইতোমধ্যে করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশন চলাকালে গণপরিষদের কংগ্রেস দলীয় সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত গণপরিষদের ইংরেজী ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও বক্তৃতা দানের প্রস্তাব উপস্থাপন করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এর বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ দিবস উপলক্ষে সারা পাকিস্তানে হরতাল আহবান করা হয়।
সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সফলভাবে এই হরতাল পালিত হয়। হরতালের প্রতি রেল কর্মচারীদের সমর্থন থাকায় ঐদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে কোন ট্রেন রওনা দিতেই সক্ষম হয়নি।
ঢাকার অবস্থা ছিল আরও সঙ্গীন। ঐদিন ভোর থেকে ঢাকা সেক্রেটারিয়েটের চারদিক বাংলা ভাষা সমর্থকরা ঘেরাও করে রাখার ফলে অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী সেদিন সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করতেই পারেননি। সে সময় সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে পাকা দেয়াল ছিল না। ছিল কাঁষ্ঠা তারের বেড়া। এই বেড়া ডিঙ্গিয়ে অনেকে ভেতরে প্রবেশ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এই মর্মে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করা হলে তারা তাদের পদ থেকে ইস্তফা দেবেন।
এই অবস্থায় পুলিশ চারদিকে ঘেরাওকারীদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং অনেককে গ্রেপ্তার করে। অধ্যাপক আবুল কাসেম লাঠিচার্জে আহত হন। শেখ মুজিবুর রহমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পুলিশের লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তারের পর শহর ছড়িয়ে পড়লে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক এসে অল্পক্ষণের মধ্যেই সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে প্রতিবাদী মানুষদের মহাসমুদ্রে পরিণত হয়। চারদিকে অচলাবস্থায় সৃষ্টি হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তৎকালীন চীফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ভয় পেয়ে যান। কারণ কয়েক দিনের জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আসার কথা তিনি (নাজিমুদ্দিন) ভাষা আন্দোলনকারীদের সকল দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ফলে অবস্থা আপাতত শান্ত হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।