Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে প্রতিবন্ধীদের

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

মহান আল্লাহ পৃথিবীর প্রথম মানব আদি পিতা আদম (আ.) এবং হাওয়া (আ.)-কে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি মানব জাতিকে ভিন্নতা দান করেছেন। মানুষের মধ্যে কাউকে কিছু বিশেষ শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা এবং ক্ষমতা দান করেছেন, আবার কাউকে এসব দান করেননি। মানুষের মধ্যে থাকে অক্ষম, প্রতিবন্ধী অথবা শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ। এরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। কর্মক্ষেত্রে তাদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না অথবা সম্পূর্ণভাবে চাকরিতে অগ্রাহ্য করা হয়। অথচ ইসলামে অক্ষম/প্রতিবন্ধী ও বিকলাঙ্গদের জন্য রয়েছে বিশেষ অধিকার। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠি সম্পর্কে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্ববোধের পরিবর্তন লক্ষণীয়। সাম্প্রতিকালে বিভিন্ন দেশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠির কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিবন্ধী বিষয়ক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের অঙ্গীকার প্রদান করছে। তবুও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠি সাধারণত সমাজের অনগ্রসর ও পরনর্ভিরশীল অংশ হিসেবেই রয়ে গেছে। এক আয়াতে আল্লাহ বলেন: যারা দুর্বল, অসুস্থ এবং যারা অর্থ সাহায্যে অসমর্থ তাদের কোনো অপরাধ নেই; যদি আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি অবিমিশ্রিত অনুরাগ থাকে। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে অতি সুন্দর কাঠামো ও অবয়বে সৃষ্টি করেছেন বলে আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন। তিনিই আবার অন্ধ, মূক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সৃষ্টি বা কোনো ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী করার পেছনে আল্লাহর একটি মহৎ পরিকল্পনা রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা আদম সন্তান হিসেবে সকল মানুষকে সম্মানিত করেছেন এবং তাঁর নিকট সম্মানের মানদণ্ড হিসেবে তাকওয়া (আল্লাহভীতি)-কে নির্ধারণ করেছেন। ধন-সম্পদ ও মানব মর্যাদার অধিকারীগণ যদি তাদের অন্তরে আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি আকর্ষণ ও ভয়-ভীতি না রাখে, তাহলে আল্লাহর দরবারে তাদের কপর্দক মাত্র মূল্যায়ন হবে না, যদিও লোকচক্ষে তারা বড় সম্মানী ও নেতৃস্থানীয় বলে বিবেচিত হয়। অপরপক্ষে যদি কেউ অর্থ সম্পদে লোক সমাজে দুর্বল বলে প্রতিপন্ন হয়, তবুও শুধুমাত্র আখিরাত ও আল্লাহভীতির কারণেই সে আল্লাহর নিকট সম্মানের পাত্র হিসাবে বিবেচিত হবে। তাই প্রতিবন্ধীরাও আল্লাহ ও তাঁর রসূল স.-এর প্রতি সাধ্যমত আনুগত্য প্রদর্শন করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত হতে পারে। প্রতিবন্ধীদের যু’আফা [য’য়ীফ এর বহুবচন] হিসেবে কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। শারীরিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক অপূর্ণাঙ্গতাকে ইসলাম যথাযথ গুরুত্ব, মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করেছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-এর জন্য সপ্তম আকাশের উপর থেকে রাসূল স.-কে সতর্ক করা হয়েছে এবং তার শানে পবিত্র কুরআনে ১৬টি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পাওয়া যায়, যারা তাদের পূণ্যময় কীর্তির কারণে পৃথিবীতে চিরদিনের জন্য ভাস্কর হয়ে থাকবেন।

কুরআন মাজীদ বিশ্বমানবতাকে প্রতিবন্ধীদের সাথে হৃদ্যতামূলক আচরণ করতে এবং তাদেরকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিতে উৎসাহিত করেছে। তাদের প্রতি অনীহা বা তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করতে বারণ করেছে। ইসলামপূর্ব যুগে লোকেরা প্রতিবন্ধীদের পাশে বসে আহার করতে সংকোচবোধ করত। কারণ, প্রতিবন্ধীদের অযাচিত হস্তপদ সঞ্চালনের কারণে তাদের মাঝে ঘৃণার উদ্রেক হতো। আবার অনেকে তাদের পাশে আরামে বসতে না পারার কারণে আহার করা থেকে বিরত থাকত। সাঈদ ইবনে যুবায়ের ও যাহহাক রহ. প্রমুখ বলেন: খঞ্জ, অন্ধ ও রুগ্ন ব্যক্তিরা সুস্থ ব্যক্তিদের সাথে সাথে বসে আহার করা থেকে বিরত থাকত। কারণ তারা অনুধাবন করতে পেরেছিল, মানুষ তাদের সাথে বসে আহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। অন্ধ ব্যক্তি মনে করত, আমার সাথী কম খাওয়ার কারণে আমার খাবারের পরিমাণ বেশি হয়ে যাবে। খঞ্জ মনে করত, আমার কারণে সুস্থদের বসতে অসুবিধা হয়, আমার বসতে প্রায় দুজনের সমান জায়গার প্রয়োজন হয়। তখন আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করে এ সমস্যার অপনোদন করেন এবং ঘোষণা করেন, সুস্থদের সাথে আহার গ্রহণ করতে কোনো ক্ষতি নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন: অন্ধের জন্য কোনো অপরাধ নেই, খঞ্জের জন্য কোনো অপরাধ নেই এবং পীড়িতদের জন্য কোনো অপরাধ নেই এবং তোমাদের নিজেদের জন্যও আহার করতে তোমাদের নিজেদের গৃহে অথবা তোমাদের পিতৃগণের গৃহে অথবা তোমাদের মাতৃগণের গৃহে, ভ্রাতৃগণের গৃহে, ভগ্নিগণের গৃহে, মামাদের গৃহে, খালাদের গৃহে অথবা ঐসব গৃহে যার মালিক তোমরা অথবা তোমাদের বন্ধুদের গৃহে। তোমরা একত্রে আহার কর অথবা পৃথক পৃথকভাবে আহার কর, তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ নেই। ইমাম কুরতুবী বলেন: প্রতিবন্ধীদের প্রতি অনীহা পোষণ করা, তাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা জাহেলী যুগের স্বভাব এবং অহংকারের নিদর্শন।

কুরআন মাজীদ প্রতিবন্ধীদের সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার প্রতিও সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। যেহেতু আল্লাহর নিকট মানুষের মর্যাদার মানদণ্ড হচ্ছে বিশুদ্ধ ঈমান ও আমল। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা মর্যাদার মানদণ্ড নয়। তাই কারো দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা বড় অন্যায়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন- কেউ যেন অন্যকে নিয়ে কোনো বিষয়ে উপহাস না করে। কারণ হতে পারে, তার মর্যাদা আল্লাহর নিকট উপহাসকারীর চেয়ে বহুগুণ বেশি। অনুরূপ কুরআন মাজীদে মানুষকে তাচ্ছিল্য করে মন্দ নামে ডাকতেও নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে; কারণ হতে পারে যাকে নিয়ে উপহাস করা হয় উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম এবং কোনো নারী যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস না করে; কারণ হতে পারে যাকে নিয়ে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম। তোমরা একে অপরকে দোষারোপ করো না এবং মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর মন্দ নামে ডাকা অতি মন্দ কাজ। যারা তওবা না করে তারাই জালিম। কাজেই কাউকে লেংড়া, খোঁড়া, কানা, বধির, বেটে ইত্যাদি বলে ডাকা- যদি সে ঐ নামে ডাকা অপছন্দ করেÑ সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয। তাদের উপস্থিতিতে যেমন তাদেরকে এমন বিশেষণে বিশেষায়িত করা নাজায়েয, অনুরূপ তাদের অনুপস্থিতিতেও নাজায়েয। কারণ অনুপস্থিতিতে তাকে উপরোক্ত বিশেষণে বিশেষায়িত করলে তা গীবত বা পরনিন্দায় পরিণত হবে। যেহেতু গীবত হলো, এমন ভাষায় কারো আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। সাইয়িদুনা আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন: তোমরা কি জান- গীবত কী? সাহাবায়ে কেরাম উত্তর দিলেন: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন তিনি স. বললেন: এমনভাবে তোমার ভাইয়ের আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। উপস্থিতদের মধ্য হতে একজন প্রশ্ন করলেন: আমি যা বলছি তা যদি বাস্তবেই আমার ভাইয়ের মাঝে থেকে থাকে, তাহলেও কি গীবত হবে? রাসূল স. বললেন: তুমি যা বলছ তার মাঝে যদি সে দোষ বাস্তবেই থাকে, তাহলেই তো তুমি তার গীবত করলে, আর যদি না থাকে তাহলে তুমি তার প্রতি অপবাদ দিলে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন: তোমাদের একে অপরের নিন্দা যেন না করে। ইমাম তাবারী রহ. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, তোমাদের কেউ যেন কারো অনুপস্থিতিতে এমন কথা না বলে, যা সে শুনতে অপছন্দ করে। সুতরাং যদি তোমার পাশ দিয়ে কোনো বধির হেঁটে যায় আর তুমি বললে, বধির যাচ্ছে, তাহলে তুমি তার গীবত করলে।

ইসলাম প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন লোকদের দায়িত্ব লাঘব করেছে। তাদের সামর্থ্যরে কথা বিবেচনা করে তাদের প্রতি সাধ্যাতীত কোনো দায়িত্ব আরোপ করেনি। সেই ধারাবাহিকতায় তাদের থেকে জিহাদের মত গুরুত্বপূর্ণ ফরয বিধান রহিত করেছে। মুহাম্মদ আলী আস-সাবূনী রহ. বলেন এ প্রকারের লোকদের জিহাদে অংশগ্রহণ না করায় কোনো গুনাহ নেই। কারণ তারা স্পষ্ট অপরাগতার শিকার।

আল্লাহ তাআলা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে আল-কুরআনের বহু আয়াত নাযিল করেন। এর দ্বারা তাদের মর্যাদার বিষয়টি অতি স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। এমন কিছু আয়াত নিম্নে তুরে ধরা হচ্ছে: মুআয ইবনে জাবাল রা. একজন অত্যন্ত উচুঁ মাপের সাহাবী ছিলেন। তিনি খঞ্জ ছিলেন। একবার তিনি এবং ছা’লাবা বিন ‘উসমা রা. এ দুই আনসারী সাহাবী নবী স. এর নিকট চাঁদের আবর্তনরহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! চাঁদ সূতোর ন্যায় চিকন হয়ে উদিত হয়। এরপর বাড়তে বাড়তে অনেক বড় ও বৃত্তাকার হয়ে আবর্তিত হয়। অতঃপর আবার সরু হয়ে ছোট হতে থাকে এবং পূর্বের আকার ধারণ করে। কখনোই অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে না। এর কারণ কী? এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। লোকেরা আপনাকে চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলুন, তা মানুষ ও হজ্জের জন্য সময় নির্দেশক। আমর ইবনুল জামূহ রা. একজন সম্পদশালী বয়োবৃদ্ধ আনসারী সাহাবী ছিলেন। তিনিও খঞ্জ ছিলেন। একবার তিনি রাসূলুল্লাহ স. এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কী সদকা করবো? কাদের প্রতি সদকা করবো? তার এ জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়: লোকেরা আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য। উত্তম কাজের যা কিছুই তোমরা কর না কেন, আল্লাহ তো সে সম্বন্ধে অবহিত। এছাড়াও আরো অনেক আয়াত তাদের জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে। এসব কিছুর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, আল-কুরআন প্রতিবন্ধীদেরকে পূর্ণ মানবিক মর্যাদা দিয়েছে। তাদের মর্যাদা অন্য সকল মানুষের মতই। বরং দেখা যায়, তাদের প্রাপ্য সুবিধা ও অধিকার সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় বেশি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রতিবন্ধী

১৪ মার্চ, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন