চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
॥ দুই ॥
আর আমি আমার দুআ কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের উদ্দেশ্যে মূলুবী রেখেছি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৯। ইমাম নববী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন- অর্থাৎ, এই হাদীসে উম্মতের প্রতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ মায়া-মমুা ও দরদের কথা এবং তাদের কল্যাণসাধনে তাঁর প্রচেষ্টার কথা ফুটে উঠেছে। তাইতো তিনি এই উম্মতের জন্য তাঁর বিশেষ দুআ তাদের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য তুলে রেখেছেন।
যার মমতার বিস্তৃতি এত তাঁর জন্য তো মনের চাওয়া- তোমার চরণতলে জীবন সঁপে দিই, এই তো হৃদয়ের আশা আকুলতা । উম্মতের প্রতি নবীজী কী পরিমাণ দয়ার্দ্র ও অনুগ্রহশীল ছিলেন- এখানে তার কিঞ্চিতই বিবৃত হল। আল্লাহ তাআলা এককথায় বড় সুন্দরভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন- (হে মানুষ!) তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসুল এসেছে। তোমাদের যেকোন কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু। -সুরা তাওবা (৯) : ১২৮। তো যেই নবী উম্মতের জন্য এতটা মহানুভব ছিলেন; সেই নবীর প্রতি উম্মতের আচরণ কেমন হওয়া চাই!
নবীজীর প্রতি ভালবাসা মুমিনের ঈমান: মুমিনের জীবনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বতের গুরুত্ব অপরিসীম। মহব্বতে রাসুল তো ঈমানের রূহ, মুমিনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই ইশ্ক ও মহব্বত ছাড়া না ঈমানের পূর্ণতা আসে, আর না তার স্বাদ অনুভূত হয়। আর নিছক ভালবাসাই যথেষ্ট নয়, বরং পার্থিব সমস্ত কিছুর উপর এই ভালবাসাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে ভালবাসার প্রকাশ ঘটতে হবে। হযরত আনাস রা. বলেছেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষ থেকে প্রিয় হব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫। এ শুধু নীতিবাক্য নয়; বাস্তবেই মুমিনকে পৌঁছাতে হবে নবীপ্রেমের এ স্তরে। সকলের উপর, সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিতে হবে আল্লাহ-আল্লাহর রাসুলকে; এমনকি নিজের জানের উপরও। শুনুন ওমর রা.-এর ঘটনা- আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম রা. বলেন- একদিন আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। নবীজী ওমর রা.-এর হাত ধরা ছিলেন। ওমর রা. বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমার কাছে সবকিছু থেকে প্রিয়, তবে আমার জান ছাড়া। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না ওমর, এতে হবে না। যে সত্তার হাতে আমার জান তাঁর কসম! (ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না,) যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার জানের চেয়েও প্রিয় না হই। পরক্ষণেই ওমর রা. বললেন, হাঁ এখন তা হয়েছে; আল্লাহর কসম! (এখন থেকে) আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও প্রিয়। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ ওমর! এখন হয়েছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬৩২। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের ভালোবাসা যদি সবকিছুর উপরে না হয় তাহলে মুমিন পথ চলবে কীভাবে? আল্লাহ ও আল্লাহ্র রাসুলের আদেশের সামনে সমর্পিত হবে কীভাবে? আজ বাধা হবে সন্তান, কাল স্ত্রী, পরশু পিতা। কখনো বা জানের মায়ায় লংঘিত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ। আর মুমিন তো সেই, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মহব্বত ও নির্দেশের সামনে সবকিছু পিছে ঠেলতে জানে।
নবীজীর প্রতি ভালবাসা মুমিনের সম্বল: মুমিনের সবচে বড় দৌলশ ঈমান। এই মহা দৌলতের স্বাদ যার নসীব হয়, সমস্ত দুঃখ কষ্ট তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। মহব্বতের কারণে সকল তিক্ত মিষ্টে পরিণত হয়। আর এই স্বাদ সে-ই পায়, যার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে থাকে। হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- অর্থাৎ, তিনটি গুণের অধিকারী ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করবে। তন্মধ্যে প্রথম হল, যার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সবচেয়ে প্রিয় হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৭। ঈমানের স্বাদ আস্বাদনের নগদ ও সবচেয়ে বড় ফায়দা হল ইবাদত ও আনুগত্যে আগ্রহ লাভ হওয়া। বরং ইবাদতই তখন প্রশান্তির কারণ হয়ে যায়। অর্থাৎ, হৃদয়ে যখন ঈমানের মিষ্টতা সঞ্চারিত হয়, তখন ইবাদতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উদ্যমী হয়ে ওঠে।
নবীজীর প্রতি ভালবাসা যেমনিভাবে ঈমান ও আমলে উৎকর্ষ লাভের উপায়, তেমনি তা আখিরাতে মহাসাফল্য অর্জনের সম্বল। আর প্রত্যেক মুমিনের কাক্সিক্ষত সে সাফল্য হল আখিরাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গলাভ। স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন- অর্থাৎ, ব্যক্তি যাকে ভালবাসে তার সাথেই তার হাশর হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৪০।
এ সম্পর্কে বড়ই শিক্ষণীয় ও চমৎকার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন হযরত আনাস রা.। তিনি বলেছেন- অর্থাৎ, এক ব্যক্তি রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল : ইয়া রাসুলাল্লাহ! কিয়ামু কবে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কী প্রস্তুতি নিয়েছ কিয়ামতের? সে জবাব দিল, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালবাসা। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালবাস, (কিয়ামতের দিন) তার সাথেই থাকবে। হযরত আনাস রা. বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমাদের কাছে সবচে’ খুশির বিষয় ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথা- ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালবাস, (কিয়ামতের দিন) তার সাথেই থাকবে।’
আনাস রা. বলেন, আর আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসি। আবু বকর ও উমরকেও। তাই আশা রাখি, আখেরাতে আমি তাঁদের সাথেই থাকব, যদিও তাঁদের মতো আমল আমি করতে পারিনি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৩৯। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সবাইকে আখিরাতে তাঁর রাসুলের সঙ্গ দান করেন- আমীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।