চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
বিনয় গুণটি মাথার মুকুট। মুকুট দেখেছ তোমরা? কেউ হয়তো দেখেছ, কেউবা দেখনি। আগের যুগের রাজা-বাদশাহরা মাথায় মুকুট পরত। এগুলো অনেক দামী হত। দেখতে অনেক সুন্দর লাগত, রাজা-বাদশাদের সম্মান ও সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিত। একজন মানুষের মুকুট হল বিনয়। বিনয় মানুষের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। অন্যদের চোখে সম্মানিত করে। বিনয়ী মানুষকে সবাই ভালোবাসে, আর যারা অহংকার করে, বুক ফুলিয়ে চলে তাদের কেউ দেখতে পারে না। ভালোবাসে না। ছোট্ট বন্ধুরা! আজ তোমাদেরকে নবীজীর বিনয়ের গল্প শোনাবো।
আমাদের নবীজী ছিলেন অনেক বিনয়ী। তাঁর সব কিছু ছিল সাধারণ। সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন। অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে থাকা পছন্দ করতেন না। যখন মসজিদে থাকতেন সাহাবায়ে কেরামের সাথে এমনভাবে বসতেন যে, অপরিচিত কেউ এলে জিজ্ঞেস করতে হত- তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ কে? (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩)
বড় বড় সাহেবেরা ও ধনীরা নিজ পরিবারের সাথেও কেমন আচরণ করে; ঘরে এসেও ভাবটা এমন যে, আমি অমুক অফিসার, তমুক জমিদার। কিন্তু আমাদের নবীজী ঘরে এলেও সাধারণভাবে থাকতেন। নিজের কাজ নিজেই করতেন। কাপড়ে তালি লাগাতেন। বকরির দুধ দোহন করতেন। জুতা ছিঁড়ে গেলে নিজেই তা ঠিক করতেন।
আম্মাজান আয়েশা রা.-কে একবার জিজ্ঞেস করা হল, নবীজী ঘরে কী করতেন? তিনি উত্তরে বললেন- তিনি পরিবারের কাজে সহযোগিতা করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৭৬)
দেখেছ, আমাদের নবীজী এত বড় হয়েও ঘরের কাজে সহযোগিতা করতেন! তোমরা কি আম্মুকে সহযোগিতা কর ঘরের কাজে? না করলে এসো, আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করি, এখন থেকে সবসময় ঘরের কাজে আম্মুকে সহযোগিতা করব। পানি এগিয়ে দেব। ঘর ঝাড়– দেব। রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করব। বাজার থেকে কিছু এনে দিতে বললে খুশি মনে এনে দেব এবং যথাসম্ভব নিজের কাজ নিজেই করার চেষ্টা করব।
নবীজী যেমন আল্লাহর প্রেরিত নবী ছিলেন তেমনি ছিলেন শাসক। মদীনা রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন তিনি। মানুষের সমস্যার সমাধান করতেন। অপরাধীদের বিচার করতেন। অসহায়দের পাশে দাঁড়াতেন। তবে নবীজী এক্ষেত্রেও ছিলেন বিনয়ী শাসক। অন্যান্য শাসকদের মত তার ভয়ে সবাই কাঁপতে থাকুক- তিনি তা পছন্দ করতেন না। আবু মাসউদ রা. বলেন, এক লোক নবীজীর সাথে কথা বলতে এল। তখন ভয়ে সে কাঁপছিল। নবীজী বললেন, শান্ত হও। আমি কোনো রাজা-বাদশা নই। আমি একজন সাধারণ নারীর সন্তান। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৩১২)
অনেক সময় কোনো কোনো বেদুঈন এসে নবীজীর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে বসত। নবীজী সেগুলো হাসিমুখেই সহ্য করতেন। হযরত আনাস রা. বলেন, একদিন আমি নবীজীর সাথে হাঁটছিলাম। তাঁর গায়ে ছিল মোটা পাড়ের নাজরানী চাদর। হঠাৎ এক বেদুঈন এসে প্রচ- জোরে চাদর টান দিল। আমি দেখলাম, জোরে টান দেওয়ার কারণে নবীজীর কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। এরপর বেদুঈন লোকটি বলল, তোমার কাছে আল্লাহর যে সম্পদ রয়েছে তা থেকে আমায় দিতে বল।
দেখেছ, নবীজীর কাছে সম্পদ চাইতে এল লোকটি। এক্ষেত্রে তো নরমভাবে বিনয়ের সাথে কথা বলা উচিত। আর সে কি না করে বসল এমন এক আচরণ। আমি তুমি হলে কী করতাম তখন? নিশ্চই জোরে একটা ধমক বা চড় দিতাম। কিংবা শাসন করে তাড়িয়ে দিতাম। শাসক বলে কথা!
কিন্তু নবীজী এমন কিছুই করলেন না। তিনি তো আর অন্যান্য শাসকদের মত ছিলেন না। বেদুঈনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন এবং বাইতুল মাল থেকে তাকে কিছু দিয়ে দিতে বললেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১৪৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৫৭)
মনে কর তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছ। হঠাৎ দেখা হল কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকের সাথে। মাথায় সমস্যা। কেমন সব অদ্ভুত আচরণ করে। তোমাকে ডাক দিয়ে কোনো প্রয়োজনের কথা বলল। তখন কী করবে তুমি? নিশ্চয়ই ঝামেলা ভেবে এড়িয়ে যেতে চাইবে। ভাববে, ওর কথা শুনলেই কি আর না শুনলেই কি। আমার কিছু আসে-যায়! কিন্তু আমাদের নবীজী এমন লোকদের সাথেও অনেক সুন্দর ও বিনয়ের আচরণ করতেন। হযরত আনাস রা. বলেন, এক মহিলা মানসিকভাবে একটু বিকারগ্রস্ত ছিল। সে নবীজীকে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে আমার কিছু প্রয়োজন ছিল। নবীজী তখন বললেন, হে অমুকের মা! বল, তোমার প্রয়োজন পূরণের জন্য কোথায় যেতে হবে? নবীজী তখন মহিলার প্রয়োজন পূরণ করে দেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩২৬)
নবীজী এক্ষেত্রে অন্য কাউকে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু এমন না করে নিজেই গেলেন তার সাথে। কেমন বিনয়ী-সুন্দর আচরণ! একজন মানসিক সমস্যাগ্রস্তের সাথে যদি এমন আচরণ হয় তাহলে ভেবে দেখ অন্যদের সাথে কেমন আচরণ হবে? হযরত আবু উমামা রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসহায়-দুর্বলদের সাথে গিয়ে তাদের প্রয়োজন পূরণ করে দিতেও অস্বীকৃতি জানাতেন না (এবং একে নিজের জন্য অসম্মানের মনে করতেন না)। (আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৮১০৩)
অসহায়-দুর্বলদের এতটা ভালোবাসতেন নবীজী। নিজেই যেতেন তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য। তাদের সমস্যা দূর করার জন্য। কখনো অহংকারবশত মনে করতেন না, আমি কেন যাব ওদের জন্য। অন্যভাবেও তো প্রয়োজন পূরণ করা যায়।
নিশ্চয় তোমরা জেনে থাকবে নবীজীর মক্কার জীবনের কথা। নবীজীর উপর কাফেরদের নির্যাতনের কথা। নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল মক্কার ভূমি। বাধ্য হয়ে তাঁরা হিজরত করেছিলেন মদীনায়। মাতৃভূমি ছেড়ে কার যেতে মনে চায়! তবুও তাঁরা গিয়েছিলেন। যেতে হয়েছিল তাদের। তবে একদিন বদলে গিয়েছিল সবকিছু। মক্কার আকাশে উড়েছিল ইসলামের বিজয় পতাকা। মুসলমানরা বিজয়ীবেশে প্রবেশ করেছিল মক্কায়। নিষ্ঠুর অত্যাচারী কাফেররা সেদিন ছিল অসহায়। বিষণ্নচোখে দেখছিল শুধু মুসলমানদের প্রবেশদৃশ্য। সেদিন ছিল সাহাবায়ে কেরামের জন্য শুধুই খুশির, শুধুই আনন্দের। তবে মহাবিজয়ের এ দিনেও আমাদের নবীজী ছিলেন বিনয়ী। বিজয়ীবেশে যখন মক্কায় প্রবেশ করছিলেন তখনও তাঁর চোখে-মুখে ছিল না অহংকারের ছাপ, বিজয়ী সেনানায়কদের প্রতাপ, ক্ষমতার দাপট; বরং এতটাই বিনয়ী ছিলেন যে, তাঁর চেহারায়ও তা প্রকাশ পাচ্ছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহপ্রদত্ত বিজয় দেখে বিনয়ে মাথা এত নিচু করে ছিলেন, যেন তার দাড়ি বাহনজন্তুর পিঠ স্পর্শ করছিল। (সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪০৫)
আমাদেরও হতে হবে এমন বিনয়ী। নিজের কোনো সাফল্য দেখে কিংবা পার্থিব প্রাচুর্য লাভ করে গর্ব-অহংকারে ফুলে ওঠা যাবে না। বরং মাটির মানুষকে সবসময় থাকতে হবে মাটির মত বিনয়ী। বিনয়ী হলে কিন্তু আমাদেরই লাভ। মানুষ আমাদের ভালোবাসবে। বুকে টেনে নেবে। বিনয়ী মানুষকে সবাই ভালোবাসে। আল্লাহ তাআলাও ভালোবাসেন। আর অহংকারীকে সবাই ঘৃণা করে। বিনয় হল মানুষের মাথার মুকুট। যা শোভা ও সৌন্দর্য বাড়িয়ে অন্যদের চোখে তাকে করে তোলে শ্রদ্ধাশীল ও মর্যাদাবান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।