Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে নবীজীর স্বাস্থ্যবিধি

| প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০২০, ১২:০৬ এএম

করোনাভাইরাস এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। সর্বত্রই দেয়ালবিহীন কারাগার, নেই কারো নিস্তার! সর্বদা একটিই ভাবনা, ‘করোনা’ আর ‘করোনা’। বিশ্বব্যাপী একটিই পরিকল্পনা, করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির ভাবনা আর মহান আল্লাহ দরবারে করুণা লাভের প্রার্থনা। জনগণ আজ আতঙ্কগ্রস্ত! পেশাজীবীরা ভীতসন্ত্রস্ত! আর সব দেশের সরকার কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী হতে চলেছে? কীভাবে করবে এ বিশ্বমহামারীর মোকাবেলা? চিন্তায় দায়িত্বশীলদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। চীনের উহান শহর উৎপত্তি স্থল হলেও তা এখন বিশ্বমহামারী রূপ ধারণ করেছে। দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের অন্যতম কারণ, এটি দ্রুত সংক্রামক তথা ছোঁয়াচে রোগ। এ রোগের ভ্যাকসিন তথা প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিস্কার হয়নি।
ইসলামের কোনো বিধান বাস্তবতা পরিপন্থী নয়। মনে রাখতে হবে এ বিশ্বজগত যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই বিধাতা বিধানও দিয়েছেন। সুতরাং ইসলামের কোনো বিধানের সাথে বাস্তবতার সংঘর্ষ হবে তা অকল্পনীয়। মুমিনের বিশ্বাস হায়াত-মউত, সুস্থতা-অসুস্থতা ও ভাল-মন্দ সবকিছু তাকদিরের ফায়সালা তথা মহান রবের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন রোগ যেমন দিয়েছেন তার প্রতিষেধকও দিয়েছেন। হাদিসে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, “আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার নিরাময়ের উপকরণ ও উপাদান তিনি সৃষ্টি করেননি”-বুখারীঃ ৫৬৭৮। সুস্থতার যেমন বিভিন্ন কারণ ও উপকরণ রয়েছে তদ্রুপ অসুস্থতারও বিভিন্ন কারণ ও উপকরণ আছে। যেমন মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডায় সর্দি, জ¦র ও কাশিঁ হয়। তেমনিভাবে রোগাক্রান্ত হওয়ার এটিও একটি কারণ যে, সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসা। এটি একটি বাস্তব বিষয়। ইসলাম এ বাস্তবতাকে কখনো অস্বীকার করে না।
ইসলামী পরিভাষায় উপায়-উপকরণ অবলম্বন করাকে ‘তদবির’ বলা হয়। আর ভাগ্যের লিখনকে তাকদির বলা হয়। তদবির তথা উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা তাকদির ও বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়। কেননা তাকদিরে উপায়-উপকরণ অবলম্বনের কথাও লিখিত আছে। একবার এক সাহাবী প্রশ্ন করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যে ঝাড়ফুকঁ করে থাকি, রোগ হলে ওষুধ সেবন করে থাকি, আত্মরক্ষার জন্য উপায় অবলম্বন করে থাকি, তা কী তাকদিরের কোনো কিছুকে রদ করতে পারে? জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন তোমাদের এসব প্রচেষ্ঠাও তাকদিরের অর্ন্তভ‚ক্ত”- তিরমিজিঃ ২১৪৮।
রাসূল (সাঃ) বলেন,“যদি তোমরা শুনতে পাও যে, কোনো জনপদে মহামারী প্রার্দুভাব ঘটেছে তবে, তোমরা তথায় গমন করো না। আর তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার প্রার্দুভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হয়ো না”- বুখারীঃ ৫৭২৮। এভাবে রাসূল (সাঃ) প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে সংক্রমণ প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ তথা সাম্প্রতিক কালে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের ভাষায় ‘কোয়ারেন্টাইন’ ও ‘লকডাউন’ পদ্ধতির নির্দেশ প্রদান করেছেন। রোগাক্রান্ত হওয়ার অন্যান্য কারণ থেকে বেচেঁ থাকা যেমনিভাবে কোনো দোষের নয়, তেমনি এ ক্ষেত্রেও যথাযথ সর্তকতা অবলম্বন করা দোষের কিছু নয়। বরং হাদিসে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
অতএব, আল্লাহর ইচ্ছায় রোগাক্রান্ত হবে অন্যথায় নয়। এজন্য দেখা যায়, সংক্রামিতের সংস্পর্শে আসার পরও কেউ কেউ আক্রান্ত হলেও অনেকে কিন্তু আবার রোগাক্রান্ত হয় না। এর সঠিক জবাব কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে নেই। তবে এর জবাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে রয়েছে, “বলুন আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা ব্যতিত অন্যকোন বিপদ আসবে না”- সূরা তাওবাঃ ৫১। এ কথাটিই রাসূল (সাঃ) বলেছেন “রোগ-ব্যাধি (তার নিজস্ব ক্ষমতায়) একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রামিত হয় না”- মুসলিমঃ ৫৭৪২। বরং এখানে আল্লাহপ্রদত্ত অদৃশ্য শক্তিই ক্রিয়াশীল। উল্লেখ্য, “ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাসকে যেভাবে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না, অনুরূপভাবে আল্লাহপ্রদত্ত ক্রিয়াশীল ক্ষমতাও আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না”। বিজ্ঞানীদের মতে, করোনাভাইরাস প্রায় ৬০ বছর আগে আবিস্কৃত হয়েছে। কেনো এতদিন এ ভাইরাস এতদিন এত আক্রমনাত্বক ছিল না এর কোনো জবাব কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে নেই।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন, “সংক্রমণ, কুলক্ষণ, পেঁচা ও সফর মাস বলতে কিছু নেই, কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করো যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন করো সেভাবে”-সহিহ বুখারীঃ ৫৭০৭। এ হাদিসের শেষাংশে রাসূল (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন কুষ্ঠরোগী থেকে সেভাবে পলায়ন করো যেভাবে সিংহ থেকে পালিয়ে থাকো। যদি সংক্রামকব্যাধিকে অস্বীকার করাই নবীজীর উদ্দেশ্য হতো তাহলে নবীজী হাদিসের শেষাংশে সংক্রমণের ধারণাকে সর্মথন করে কুষ্ঠরোগী থেকে দূরে থাকার এমন নির্দেশ কেনো দিলেন? তা অবশ্যই বিবেচ্য বিষয়।
ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহর সমসাময়িক বিশিষ্ট ইসলামী পন্ডিত ইবনে কুতায়বা দিনুরী (রহঃ) তিনি পরস্পর বিরোধী হাদিস সমূহের মাঝে সমন্বয় সাধন করে একটি কিতাব লিখেছেন যার নাম “মুখতালাফুল হাদিস”। সেখানে এ হাদিসের ব্যাখায় সমন্বয় করে বাস্তবধর্মী ও বিজ্ঞান সম্মত জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘লা আদওয়া’ বলে মূলত নবীজী এখানে জাহিলী যুগের ভ্রান্তবিশ্বাসকে অস্বীকার করেছেন বাস্তবতাকে নয়। জাহেলী যুগে কেউ অসুস্থ হলে অন্যরা ভয়ে তার সংস্পর্শে আসত না। তারা মনে করত; রুগ্নব্যক্তির সংস্পর্শে গেলেই তার থেকে রোগ ছড়াবে। জাহেলী যুগের এ কুসংস্কার তথা খারাপ ধারণাটি বিলুপ্ত করতে নবীজী বলেন ‘লা আদওয়া’ সংক্রমণ নেই। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নজাগে, বাস্তবে সংক্রমণ, কুলক্ষণ, পেচাঁ ও সফর মাসের অস্তিত্ব কী পৃথিবীতে নেই? এখানে সংক্রমণ ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়নি বরং কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাসকে অস্বীকার করা হয়েছে। অনুরূপভাবে কুলক্ষণ, পেচাঁ ও সফর মাসের অস্বিত্বকে অস্বীকার করা নয় বরং এসব বিষয় নিয়ে যে, কুসংস্কার ও ভ্রান্ত আকিদা সমাজে প্রচলন আছে তাকে দূরিভ‚ত করা হয়েছে। সাথে সাথে হাদিসের শেষাংশে নবীজী কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করো বলে, সংক্রামক ব্যাধিকে সমর্থন করে সতর্ক করেছেন।
কিছু রোগ আছে, যা ভাইরাস ও জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রামিত হয়, এ ধরনের রোগী থেকে দূরে থাকতে বলেছেন, যা হাদিসের শেষাংশ দ্বারা বুঝা যায়। হাদিসের শেষাংশে বলা হয়েছে, তোমরা কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করো। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসিনগণ বলেন, হাদিসের প্রথম ও শেষ বক্তব্যটি পরস্পরবিরোধী মনে হলেও বাস্তবে তা কিন্তু নয়। জাহেলি যুগে তারা বিশ্বাস করত; রোগমাত্রই সংক্রামক। আবার বিজ্ঞানও বলছে সকল রোগ কিন্তু সংক্রামক নয়।
অতএব, সংক্রামকব্যাধি থেকে আত্মরক্ষার্থে সোশ্যাল ডিসেন্টস তথা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা ইসলামী সংস্কৃতির পরিপন্থী নয়। বরং বলা যায় এ ব্যবস্থার প্রবর্তক স্বয়ং ‘নবীজী’ (সাঃ)। হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবীজী সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেন, “তোমরা কুষ্টরোগীদের সাথে সাক্ষাৎ দীর্ঘায়িত করো না, যখন তাদের সাথে কথা বলো তখন এক বর্শা, তথা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা উচিত”- মুসনাদে আহমদঃ ৫৮১। উল্লেখিত হাদিস থেকে প্রমাণিত সংক্রামকব্যাধি থেকে বাচঁতে নিরপদ দূরত্ব বজায় রাখা, সতর্কতা অবলম্বন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় হচ্ছে ইসলামী শরীয়ার দাবী।
পরিশেষে আরেকটি বিষয় আলোকপাত করা একান্ত জরুরী। আমর ইবনে শরিদ থেকে বর্ণিত, এক হাদিসে দেখা যায় রাসূল (সাঃ) এক কুষ্ঠরোগীকে বায়াতের জন্য তার নিকটে আসতে বারণ করেছেন। আবার জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, অন্য হাদিস থেকে জানা যায় রাসূল (সাঃ) কুষ্ঠরোগীর সাথে বসে একত্রে খেয়েছেন। গবেষণা করলে দেখা যায়, “সংক্রামকব্যাধির ‘স্বাস্থ্যবিধি’ উক্ত হাদিসদ্বয়ে বিদ্যমান”।
মাওলানা এরফান শাহ্
গ্রন্থকার ও গবেষক,
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
৭-৪-২০



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নবীজীর-স্বাস্থ্যবিধি
আরও পড়ুন