পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা শুধু মাত্র বাংলাদেশেই নয়, বাংলাদেশের বাইরেও ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। আজ যারা বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আলোচনা করছেন তারা কিন্তু কেউ আওয়ামী ঘরানার নন। তারা কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী ঘরানার সমর্থক। তেমনি অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত একজন বাংলাদেশী, যিনি জাতীয়তাবাদী ঘরানার সমর্থক তিনি এসম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখেছেন।
নিবন্ধে তিনি বলেন, বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব দুর্বল এবং যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম। তাদের বয়স যতই বাড়ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ততই কমছে। তারা দল থেকে পদত্যাগও করবেন না অথবা সংগ্রামেও ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। বাংলাদেশের বাইরের অধিকাংশ বিএনপি নেতা মনে করেন যে, মহাসচিব হিসাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম একজন ফ্লপ। তিনি প্রতিদিন সেমিনার বা মানববন্ধনে বক্তৃতা করেন। কিন্তু তার বক্তৃতায় থাকে না উদ্দীপক কিছু । তার বক্তৃতা শুনে মানুষ ¤্রীয়মান হয়।
বিএনপির খেতাবপ্রাপ্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রশ্ন করেন , আসলে বিএনপি কোথায়? এখন কি আর শুধুমাত্র বিবৃতি পড়ার সময়? অতীতে তো বটেই, সাম্প্রতিক সময়েও দলটি আন্দোলন করার সুবর্ণ সুযোগ হারিয়েছে এবং এখনো হারাচ্ছে। ঐ অধ্যাপক মনে করেন , এই সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্যর্থ, অতীতে ভারতের কাছে একাধিকবার নতজানু হওয়ার পর এবার প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির উৎপাটনের কথা বলেন। কিন্তু তার দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক এব্যাপারে হিমালয়ান ব্যর্থতা নিয়ে বসে আছে। আলোচক অধ্যাপক মরহুম জিয়াউর রহমানের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। বলেছেন, স্যার দেশে ফিরে আন্দোলন শুরুর অক্ষমতার জন্য আমাকে মাফ করে দিন।
তার মতে, এই মুহূর্তেই বিএনপির রাস্তায় নামা উচিত। রাস্তায় নামলে সরকারের অনুগত পুলিশ হয়তো তাদের সামনে ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি এই মুহূর্তে এমন গনগনে যে সেই গরম আগুনে হাত দিলে পুলিশেরও হাত পুড়ে যাবে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ঐরঃ ঃযব ওৎড়হ যিবহ রঃ রং যড়ঃ. অর্থাৎ লোহা যখন তাতানো থাকে তখনই সেটি বাঁকাও। লোহা তাতানো আছে, কিন্তু বিএনপি সেটি বাঁকানোর কোনো চেষ্টাই করছে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, জনগণ শেখ হাসিনার শাসনকে ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছে। তারা মনে করে যে, শেখ হাসিনা যতদিন সক্ষম আছেন ততদিন তিনি শাসন করে যাবেন। এটিই হলো ইতিহাসের স্ববিরোধীতা।
বিএনপির এই স্থবিরতা সম্পর্কে স্থায়ী কমিটির মেম্বার গয়েশ^র চন্দ্র রায় বলেন ড. কামালের নেতৃত্বে বিএনপির ক্ষতি হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ড. কামালের নেতৃত্বের চলে বিএনপির উপকার নয় বরং ক্ষতি হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনকে ইঙ্গিত করে গয়েশ্বর বলেন, যিনি খালেদা জিয়াকে উন (ড়হি) করেন না, যিনি বিএনপির আবেগ উন করেন না, যিনি জিয়াউর রহমানকে উন করেন না, তাকে সামনে রেখে পথ চললে সেই পথ অতিক্রম করা সম্ভব? এটা আমি তো মনে করি না। তিনি বলেন, আমরা একসঙ্গে হয়ে নির্বাচনে গেলাম বলেই খালেদা জিয়ার জন্য জেলখানা চিরস্থায়ী হয়ে গেল। আমরা যদি ওই সময় নির্বাচনের বিষয় প্রাধান্য না দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি প্রাধান্য দিতাম, তাহলে কাজটা খুব কঠিন হতো বলে আমার মনে হয় না।
দুইবার পূর্ণ মেয়াদে দেশ শাসন করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। তৃতীয়বার স্বল্প মেয়াদে। তার মেয়াদে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অন্যন্য সাধারণ নজির স্থাপন করে গেছেন তিনি। এখনো তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। আজও যদি তিনি জেলের বাইরে থাকতেন এবং জনগণকে মাঠে নামার ডাক দিতেন তাহলে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো জনগণ পিল পিল করে রাস্তায় নেমে আসতো। অথচ গভীর পরিতাপের বিষয়, জনপ্রিয় নেত্রী ১ বছর ৯ মাস হলো কারার নির্জন প্রকোষ্ঠে অসহায় বন্দী জীবন যাপন করছেন। এই ১ বছর ৯ মাসে বিএনপি তার মুক্তির জন্য সংবাদপত্রে বিবৃতি আর দু চারটি আলোচনা সভা ছাড়া একটি বারের জন্যও জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহবান জানায়নি।
ক্যাসিনো কান্ড নিয়ে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি প্যান্ডোরার বাক্সের মতো বেরিয়ে পড়ছে, আবরার হত্যায় ছাত্র সমাজ গর্জে উঠেছে। দুইজন ভিসিকে দুর্নীতির দায়ে কেটে পড়তে হয়েছে। আরেক জন ভিসিকে সরকার প্রটেকশন দিচ্ছে তারপরেও তাকে টিকিয়ে রাখা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ এতগুলো ঘটনার পরেও বিএনপি কোনোই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি। বালিশ কান্ড, পর্দা কান্ড থেকে শুরু করে কয়লা কান্ড- কত কান্ডই না এই সরকার করেছে। অথচ বিএনপি জনগণের মাঝে সরকারের এইসব মহাদুর্নীতি ভালো ভাবে প্রচারও করতে পারেনি।
দুই
একটি বিশাল রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির ব্যর্থতার তালিকাও বিশাল। বিগত ১ বছর ৯ মাসের কথা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু তার আগেই বা বিএনপি কি করতে পেরেছে? ২০০৯ সাল থেকে দেখুন। যখন অসাধারণ জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বাসার সামনে ইট এবং বালির বস্তা দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয় তখনও কিছুই ঘটে না। যখন বেগম জিয়াকে দীর্ঘদিন ধরে বাস করা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয় তখনও কিছু ঘটে না। যখন শাপলা চত্বরে অবস্থান গ্রহণ করা লক্ষ লক্ষ হেফাজতে ইসলাম কর্মী ও সমর্থকদের সমর্থনে বিএনপি কর্মীদেরকে তাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর আহবান জানানো হয় তখন বিএনপির কাউকে পাশে যাওয়া যায়নি। যখন বছরের পর বছর ধরে বেগম জিয়া আদালতে আসা যাওয়া করতে থাকেন তখনও কিছু ঘটেনি। যখন ২০০৯ সালে দেশের অর্ধ শতাধিক সেনা অফিসারকে বিডিআর ক্যাম্পে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তখনো কিছু ঘটেনি। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে যখন দুইবার দুই রকম কায়দায় অভুতপূর্ব নির্বাচনী কারচুপি ঘটে তখনও কিছু ঘটেনি। বিগত ১০ বছরে দেশে ঘটেছে অসংখ্য হত্যাকান্ড, ধর্ষণ এবং অপহরণ। কিন্তু কিছুই ঘটেনি। বাকস্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীন মত প্রকাশের কন্ঠরোধ করা হয়েছে, তখনও কিছু ঘটেনি।
১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেটি ছিলো শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ। ১৯৯৬ সালে যে নির্বাচন হয় সেটিও ছিলো অবাধ ও নিরপেক্ষ। ২০০১ সালে যে নির্বাচন হয় সেটিও ছিলো অবাধ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ। কিন্তু তারপরেই অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং তারপর ২০১৮ সালের তথাকথিত নির্বাচন। ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এসে বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেন। সেদিন যে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছিলো তার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটে। তারপর ২০১৮ সালের নির্বাচন। দিনের ভোট রাতে হওয়ার এই নির্বাচন সম্পর্কে সকলেই এতই বেশি ওয়াকেফহাল যে সসম্পর্কে নতুন করে আর কিছু বলার প্রয়োজন নাই।
২০১৪ সালেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। যারা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বরং সরাসরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কট্টর বিরোধীতা করেছিলেন সেই ইনু, মেনন প্রমুখকে কাছে টেনে নেওয়া হয়। কিন্তু কেউ কিছু বলেনা। তার আগে মতিয়া চৌধুরীকে শুধু আওয়ামী লীগের নেতাই করা হয় না, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করা হয় তখনও কিছুই ঘটে না।
তিন
বিগত দেড় দুই বছরে বিএনপি ১১টি ভুল করেছে। এগুলো যে সে ভুল নয়। একেবারে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। প্রথম ভুল, কোনোরূপ আদর্শের বন্ধন ছাড়াই ড. কামালের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টে যোগদান। দ্বিতীয় ভুল হলো, ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে সাইড লাইনে ফেলে দেওয়া। তৃতীয় ভুল হলো, নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে, ড. কামাল হোসেন চিঠি লিখে শেখ হাসিনার সাথে আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ। চতুর্থ ভুল হলো, কোনো রকম পূর্বশর্ত ছাড়াই নিঃশর্তভাবে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের সাথে আলোচনায় বসা। পঞ্চম ভুল হলো, সরকার ঐ আলোচনায় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের একটি দাবিও না মানা সত্তে¡ও নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। ষষ্ঠ ভুল হলো, নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও কর্মীদের ওপর সরকারের জেল জুলুম ও ধরপাকড়। তারপরেও বিএনপি ও জোট নির্বাচন থেকে সরে আসেনি। সপ্তম ভুল হলো, ২৭ ডিসেম্বর যখন জানা গেলো যে পুলিশ প্রশাসন ও বেসামরিক প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ভোট হবে, তখনও নির্বাচন থেকে বিএনপির উইথড্র না করা। অষ্টম ভুল হলো, যখন ৩০ ডিসেম্বর দিনের পরিবর্তে ২৯ ডিসেম্বর রাতেই প্রশাসনের সহায়তায় নৌকার বাক্সে ৫০ শতাংশ ভোট পড়ে গেলো, তখনও নির্বাচন থেকে বিএনপির সরে না আসা। নবম ভুল হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন ভোট হওয়া সত্তে¡ও বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট তার প্রতিবাদে কোনো কর্মসূচি না দিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েই তাদের কর্তব্য সম্পাদন করে রাখলো। দশম ভুল হলো, ঐক্যফ্রন্ট থেকে এই মহা ভোটডাকাতির প্রতিবাদে লাগাতার তিন দিনের হরতাল দেওয়ার কর্মসূচি প্রস্তাব করা হলেও তা অগ্রাহ্য করা। একাদশ ভুল হলো, বেগম জিয়ার গ্রেফতার হওয়া থেকে শুরু করে আজ এই ২১ মাস ধরে কোনো রকম কর্মসূচি দান থেকে বিরত থাকা এবং এই চরম নিষ্ক্রিয়তার ফলে বেগম জিয়ার স্থায়ী কারাবাস নিশ্চিত করা।
যতগুলো ভুল সিদ্ধান্তের কথা ওপরে উল্লেখ করা হলো সেগুলো কে গ্রহণ করলো, কারা গ্রহণ করলো, নেপথ্যে কোনো অনুঘটক ছিলো কিনা, আজও সেই রহস্য উদঘাটিত হয়নি। এই এগারোটি ভুলের পাশাপাশি একথাও ঠিক যে, আজ বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ, পুলিশ প্রশাসন এবং বেসামরিক প্রশাসন যেভাবে একাট্টা হয়েছে তেমন গাটছাড়া অতীতে কোনো কালে দেখা যায় নাই। এই ত্রয়ীর মুষ্টিবদ্ধ লৌহকঠিন শাসন বিরোধী দলকে চুরমার করে দিয়েছে।
তারপরেও বলবো ঐ এগারোটি ভুলের সংশোধন করে বিএনপি যদি এখনো পূর্ণ শক্তি দিয়ে রাস্তায় নামে তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন টালমাটাল হয়ে উঠবে।
Email: journalist [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।