শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বাংলা কথাসাহিত্যের ধারাবাহিকতায় হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ, শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দিন, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, মোহিত কামালসহ আরও অনেকেই বাংলা উপন্যাসকে আরো সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হন।
জনপ্রিয়তার ধারায় এক্ষেত্রে আজ যাঁর নামটি বিশেষভাবে উলেখ করতে চাই; তিনি হলেন হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২)। দীপ্যমান এক অভিনব কণ্ঠস্বর নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে প্রবেশ করে নিজের জাত সার্থকভাবে পরিচয় করে দিতে সক্ষম হন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই ১৯৭০ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ (১৯৭২)। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে এটি আর বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর প্রথমে ‘মুখপত্র’ নামে একটি সংকলনে প্রকাশিত হয় ‘নন্দিত নরকে’ । এ উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধ হন- আহমদ ছফা। তিনিই এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা সাহিত্যের তৎকালীন শক্তিমান লেখকের স্পর্শ পেয়েছেন। যা একজন লেখক হয়ে উঠার পেছনে অগ্রণী ভ‚মিকা রাখে। এক্ষেত্রে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ‘হুমায়ূননামা : স্বল্প পরিচয়ে যতটুকু জানা’ লেখায় উলেখ করেন- ‘
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ বলতে গেলে খুব কম ছিল।... হুমায়‚নকে আলোয় নিয়ে আসেন ম‚লত প্রয়াত লেখক আহমদ ছফা। নন্দিত নরকে বইটির জন্য তাকে প্রকাশক খুঁজে দিয়েছেন ছফা ভাই। হুমায়‚নকে সব রকম সহযোগিতাও দিয়েছেন। একজন তরুণ লেখকের উঠে আসার জন্য তখন দরকার ছিল এ রকম একজন বড় সাহিত্যিকের সহযোগিতা। হুমায়ূনের বইটি পড়ে আহমদ ছফা বুঝেছিলেন যে এই তরুণকে সহযোগিতা করলে তিনি অনেকদ‚র যাবেন। এখন বোঝা যায়, স্পষ্টভাষী লেখক-সমালোচক আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্যের জন্য উপকারই করেছেন। তার ওইদিনের সাহায্যের ফলে আমরা আজকের হুমায়‚নকে পেয়েছি যিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের হাসি-কান্নার কথা লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন। বইটার মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন প্রয়াত ড. আহমদ শরীফ। তিনিও স্পষ্টভাষী লেখক-সমালোচক হিসেবে সুপরিচিত। তার মুখবন্ধটি বইয়ের ওজন বাড়িয়েছে। প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন শিল্পী কাইয়‚ম চৌধুরী। সব মিলিয়ে হুমায়‚ন বড়মাপের লেখক-শিল্পীদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন প্রথম বইতেই। বাংলা সাহিত্যের জন্য এটা ফলদায়ক হয়েছে।’
হুমায়‚ন আহমেদের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির সম্পর্কে ধারণা সুস্পষ্ট। তিনি তাঁর সামগ্রিক লেখনীতেই তা উপস্থাপন করেছেন। বলা যায়, বাঙালির এ শ্রেণির চাওয়া-পাওয়ার জায়গা থেকেই তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হন- ‘নন্দিত নরকে’। পারিবারকে আর্থ-সামাজিকতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তিনি এ উপন্যাসের পরিমার্জিত একটি পরিপ‚র্ণ চিত্র অঙ্কন করতে সার্থক হন। ড. আহমদ শরীফ বইটির ভ‚মিকায় লেখেন- “মাসিক মুখপত্রে’র প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় গল্পের নাম ‘নন্দিত নরকে’ দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কেননা ঐ নামের মধ্যেই যেন একটি নতুন জীবনদৃষ্টি, একটি অভিনব রুচি, চেনতার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। লেখক তো বটেই, তাঁর নামটিও ছিল আমার সম্প‚র্ণ অপরিচিতি। তবু পড়তে শুরু করলাম ঐ নামের মোহেই। পড়ে আমি অভিভ‚ত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূ²দর্শী শিল্পীর; একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারের এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম। জীবনের প্রাত্যহিকতার ও তুচ্ছতার মধ্যেই যে ভিন্নমুখী প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির জটাজটিল জীবনকাব্য তার মাধুর্য, তার ঐশ্বর্য, তার গ্লানি, তার দুর্বলতা, তার বঞ্চনা ও বিড়ম্বনা, তার শ‚ন্যতার যন্ত্রণা ও আনন্দিত স্বপ্ন নিয়ে কলেবরে ও বৈচিত্র্যে স্ফীত হতে থাকে, এত অল্প বয়সেও লেখক তাঁর চিন্তা-চেতনায় তা ধারণ করতে পেরেছেন দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত।... হুমায়‚ন আহমেদ বয়সে তরুণ, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবন-রসিক, স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকার। ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট জীবনশিল্পী হবেন-এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করব।” আহমদ শরীফের ভ‚মিকার ভেতর দিয়ে পরিপ‚র্ণ হুমায়‚নের অবস্থান নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে।
উপন্যাসে লেখক যে সমাজের চিত্র অঙ্কন করেছেন, সেখানে তাঁর চরিত্রের বড় বড় চাওয়া নেই, তারা ছোট ছোট চাওয়াতেই তৃপ্ত। যেমন- একগ্ল্লাস দুধ, পুরান খাতা, ভাইয়ের ছোট হয়ে যাওয়া জামা, একটি ময়না পাখি। এভাবেই লেখক বিচিত্র ও মানবিক জীবনের মধ্যে যে ছাপ রয়েছে, তা পোক্ত হাতেই তার উপন্যাসে তুলে ধরেন। তিনি তাঁর ক্ষুদ্র পরিসরের জায়গাগুলো বৃহত্তর করতেও সক্ষম হন; অনেক চরিত্রের ভিড়ে। বলা যায়, এসব কারণেই হুমায়ূন আহমেদের নাম বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।