শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
উপন্যাস মানবজীবনের দর্পণ। উপন্যাসের প্রথম ও শেষ অন্বিষ্ট মানুষ, তার জীবন। সুতরাং উপন্যাস জীবন-সংলগ্ন আলেখ্য।’ (অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় ‘আঞ্চলিক উপন্যাস’ বিষয়: প্রবন্ধ) অন্যত্র সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বাংলা উপন্যাসের কালান্তর’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘উপন্যাস সর্বগ্রাহী।... শ্রেষ্ঠ উপন্যাসকার সর্বত্রচারী।...উপন্যাস গদ্যে বর্ণিত কল্পিত আখ্যানের মাধ্যমে জীবন ব্যাখ্যা।’ এ প্রসঙ্গে অরুণ স্যানাল আরও বিস্তারিত বলেছেন, ‘উপন্যাস হচ্ছে সেই আধুনিক শিল্প-প্রতিমা যা শুধু সমগ্রতাস্পর্শীই নয়, যেখানে শিল্পীত স্বরগ্রামে প্রকাশিত হয় ঔপন্যাসিকের জীবনবোধ আর তাঁর স্বদেশ, সমাজ ও সমকাল।’
‘ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়/চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।...’ সঙ্গীতশিল্পী এস আই টুটুলের কণ্ঠে গাওয়া এই অধিক শ্রুত বিখ্যাত গানের কথাকারকে কে না চেনে? আবালবৃদ্ধবনিতার খুব পরিচিত মুখ, খুব কাছের চেনা একটি নাম। হ্যাঁ, আত্মপ্রকাশলগ্নেই যিনি সব বয়সের পাঠকের মনোযোগ কেড়েছিলেন, যাঁর প্রথম উপন্যাসই তাঁকে সর্বমহলে সাড়া ফেলেছিলো আমি সেই ‘নন্দিত নরক (১৯৭২)’সহ প্রায় তিন শতাধিক গল্প ও উপন্যাসের স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ (কাজল) (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮-১৯ জুলাই ২০১২) এর কথা বলছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে রসায়ন পাঠ ও পলিমার রসায়নের ওপর পিএইচডির পাঠ চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করেন। যদিও পরবর্তীতে লেখালেখির জন্যে অধ্যাপনা ছেড়েছিলেন। লেখক পরিচয়ের বাইরেও তিনি একজন সফল নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং চলচ্চিত্র শিল্পীও। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর সমান পারঙ্গমতা লক্ষণীয়। তাঁর সৃষ্ট ‘হিমু’ ও ‘মিসির আলি’ চরিত্রদুটো এদেশের যুবকশ্রেণির পাঠককে দারণভাবে উদ্বেলিত করেছিলো, করছে আজও। কথাসাহিত্যে লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), উপন্যাসে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), মাইকেল মধুসূদন পদক (১৯৮৭), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯২ ও ১৯৯৯), একুশে পদক (১৯৯৪) তাঁর উল্লেখযোগ্য পুরস্কার। বাবা শহিদ ফয়জুর রহমান পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং মা আয়েশা ফয়েজ। দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালে নিউইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন (৬৪ বছর)। নুহাশ পল্লীতে হয় তাঁর শেষ ঠিকানা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত অবস্থায় (১৯৭০ সালে লেখা) তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরক (১৯৭২) প্রকাশিত হয়। যা নিয়ে আমার আজকের এই নিবন্ধ রচনা। যদিওবা প্রথম লিখিত উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার। ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক মুখপত্র নামের সংকলনে প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় ছাপা হয়। পরবর্তীতে আহমদ ছফা তা গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন। মাত্র একুশ বছর বয়সে উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসটি মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রাম, হাসি, আনন্দ, বেদনা, হতাশার আবহে লেখা। খানিকটা লিবিডোতাড়িতের প্রলেপও জড়ানো। আছে নিখাদ বাৎসল্য, অভাব-সুখ-দুঃখ, প্রচ্ছন্নময় প্রেম-স্বপ্ন-পতন ও অন্ধকার, ভাইবোনের স্নেহ-ভালোবাসা-বিচ্ছেদ, আছে মধ্যবিত্তের নিত্য চেনা নানা সংকটও। একুশ বছরের দুঃসাহসকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দিবারাত্রির কাব্য গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন ‘দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫) আমার একুশ বছর বয়সের লেখা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে।’ এখানে মানিক প্রসঙ্গকে টানতেই হলো। তার কারণ, হুমায়ূনের প্রিয় লেখকদের তালিকায় ছিলেন তিনি।
আলোচিত বইয়ের প্রথম ভূমিকায় আহমদ ছফা তাঁর সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ হুমায়ূন আহমেদ বয়সে তরুণ, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবন-রসিক, স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকার। ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট জীবনশিল্পী হবেনÑ এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করব।’ তাঁর সে ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হয়ে আছে।
উপন্যাসের শুরুটাই হয়েছে সহজ অথচ কিছুটা রহস্য দিয়ে ‘রাবেয়া ঘুরে ঘুরে সেই কথা কটি’ই বারবার বলছিল।’ কী সে কথা ছিলো তা জানার জন্যে পাঠককে সামনে এগোতে বাধ্য করে রাখে। তবুও স্পষ্ট নয়, প্রচ্ছন্নভাবে জানা যায়। খুব সাধারণ এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। সে পরিবারেরই সদস্য বাইশ বছরের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বড় মেয়ে রাবেয়াকে ঘিরেই কাহিনি এগোতে থাকে। ছয় সদস্যের পরিবারটিতে আছে একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা, প্রায় সবসময় চিন্তাক্লষ্ট মা। রাবেয়া, খোকা, মন্টু, রুনুÑ ওরা চার ভাই-বোন। আর থাকেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বাবার ভার্সিটি জীবনের বন্ধু শরীফ আকন্দ। যাকে সবাই মাস্টার কাকা বলে ডাকে। অকৃতদার। স্কুল শিক্ষক। আশ্রয়ে থাকেন রাবেয়ার বাবার বাড়িতে সাথে পড়ান তার ভাই-বোনদের। আছে একটি পোষা কুকুর পলা। এমএসসি পরীক্ষার্থী খোকার ওপর পরিবারের আশা-ভরসা। রাবেয়া খোকার এক বছরের বড়। চেহারার বর্ণনায় লেখক যেভাবে বললেন, ‘রাবেয়া হয়তো ঠিক রূপসী নয়।...রঙ হালকা কালো। বড় বড় চোখ, স্বচ্ছ দৃষ্টি, সুন্দর ঠোঁট। হাসলেই চিবুক আর গালে টোল পড়ে।’ বাইরে ঘুরে বেড়ানোর সময় নানাজনে নানারকম মন্দ, ভালো বা অশ্লীল কথা বলে আর সে সেসব না বুঝেই ঘরে ফিরে জোরে জোরে বলতে থাকে। অর্থাভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা হয় না। পীর-ফকিরের ঝাড়ফুঁকই ভরসা। তাকে নিয়ে পরিবারের চিন্তা-উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। বেখেয়ালি স্বভাবের উনিশ বছরের মন্টু খোকার বাবার প্রথম বউয়ের সন্তান। অন্য চরিত্রেরা হলো পাশের ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে শীলু, হারুন, নাহার (হারুনের স্ত্রী)। রাবেয়া, রুনুর অবাধ যাতায়াত ছিলো সে পরিবারে। শীলুও আসতো এ পরিবারে। শীলু রুনু সমবয়সি। হারুন রাবেয়ার প্রতি দুর্বলতা আর শীলুর প্রতি খোকার চাপা আবেগকে গরীবের ঘোড়া রোগের মতো অধরা স্বপ্নই হয়ে থাকে। চৈত্রের এক দুপুরে রাবেয়া নিখোঁজ হলে মাস্টার কাকা তাকে স্কুল থেকে ফেরার পথে ধরে আনে। কিছুদিন পর রাবেয়ার শারীরিক পরিবর্তন মা শাহানার দৃষ্টি এড়ায় না। রাবেয়াকে শত জেরাতেও জানা যায় না সর্বনাশের হোতা কে। বাবা নিরুপায় হয়ে বিয়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টায়ও ব্যর্থ হয়। এদিকে সামাজিক লোক-লজ্জার ভয়ে একদিন ভোরে নিজের ঘরে গোপনে রাবেয়ার এবরসন করান। পরিণতি হয় ভয়াবহ। মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু। মেয়েদের জন্যে বাইরের জগত কতো ভয়ংকর তা বলতে গিয়ে খোকার ভাবনায় রুনুর ব্যাপারে লেখক বলেছিলেন, ‘...মেয়েদের মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয় ছেলেদেরও আগে। তারা তাদের কচি চোখেও পৃথিবীর নোংরামি দেখতে পায়। সে নোংরামির বড় শিকার তারাই। তাই প্রকৃতি তাদের কাছে অন্ধকারের খবর পাঠায় অনেক আগেই।’ মন্টু আর মাস্টার কাকা একসাথে সবচেয়ে ছোট ঘরে বারো বছরের বসবাস। সেই মাস্টার কাকাকে সবার সামনেই মাছকাটা বটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে। ফাঁসি হয় মন্টুর। মাস্টার কাকার খুন হওয়ায় বোঝা যায় রাবেয়ার সর্বনাশের কারণ। উপন্যাসের শেষে জেল গেটে অপেক্ষারত মন্টুর লাশ নিতে আসা অসহায় বাবা ও ভাইয়ের করুণ দৃশ্যে পাঠকের চোখ ভিজে যায়, যাবে।
একটি পরিবারকে এবং সে পরিবারের সদস্য রাবেয়াকে প্রেক্ষণবিন্দু রেখে বেড়ে ওঠা উপন্যাসে ভিন্ন কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। একটি ছিমছাম পরিবার কীভাবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে অপ্রত্যাশিত সামাজিক নোংরা জঘন্য লোলুপতার শিকারে নরকতুল্য করেছে- তারই বয়ানালেখ্য এই উপন্যাসের মূল পটভূমি। ভদ্রতার মুখোশে ঢাকা মানুষের ভেতরটা কতোটা কদর্য তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন লেখক মাস্টার কাকা চরিত্রের মধ্য দিয়ে। মেয়েরা বাইরের জগতে কতোটা অনিরাপদ তার বাস্তব রূপ তা রাবেয়ার করুণ পরিণতির এবং সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে মন্টুর ফাঁসির মধ্য দিয়ে নামকরণের সার্থকতাকেই পরিস্ফুট করেছেন। ছোটো ছোট শব্দ, কথা, বাক্য, বক্তব্য ও ইশারায় জীবনের খুঁটিনাটি সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-আবেগ, অভিমান ও বিষাদে প্রতিটি দিন-রাত্রির পরিক্রমাকে সাবলীলভাবে ব্যক্ত করার এক অসাধার জাদুময়তা পাঠককে শুরু থেকে শেষ অব্দি আচ্ছন্ন করে রাখে। আর এখানেই তিনি অন্য সকলের চেয়ে ব্যতিক্রম নিঃসন্দেহে। আর তাই তাঁর পাঠকাধিক্য আজও সমানভাবে বর্তমান। বইমেলা ও পাঠক সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে তাঁকে নিয়ে তোলা কথায় তিনি নিজেই দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলেন, ‘...পাঠক সৃষ্টিতে তার কোনো ভূমিকা নেই। তার পাঠক তারই পাঠক।’ বাঙালির সফল ও নন্দিত এই অতুল কথাকারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।