পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিএনপির ৫ জন সদস্য শপথ নেওয়ার পরেও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নেননি। তিনি বলেছেন, ওই ৫ জনের শপথ নেওয়াটা যেমন দলীয় কৌশলের একটি অংশ তেমনি আমার শপথ না নেওয়াটাও দলীয় কৌশলের একটি অংশ। মির্জা ফখরুল শপথ গ্রহণ না করায় ৩০ এপ্রিল মঙ্গলবার তার বগুড়া-৬ আসন শূণ্য হয়েছে। সংবিধান মোতাবেক, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেখানে উপনির্বাচন হবে। বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন করবে না। তাই ধারণা করা যায় যে, বগুড়া-৬ আসনে যে উপনির্বাচন হবে সেখানে বিএনপি অংশ গ্রহণ করবে না। সেখানে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী থাকতে পারে, এরশাদের জাতীয় পার্টি থাকতে পারে এবং আওয়ামী লীগও থাকতে পারে। যেই থাকুক, বিএনপির কেউ সেখান থেকে ইলেকশন করবে না।
শপথ না নেওয়ার কারণে মির্জা ফখরুলের আসন শূণ্য হয়েছে। শপথ না নেওয়ার কারণে আমি তাকে অন্য একটি লেখায় অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। আমার বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশের একজন জাতীয় সংসদ সদস্য বা এমপি অনেক সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। এসব সুযোগ সুবিধা হলোঃ-
প্রতি মাসে ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৮শত টাকা বেতন ও ভাতা হিসাবে পেয়ে থাকেন। এসবের মধ্যে রয়েছে, (১) মাসিক বেতন (২) নির্বাচনী এলাকার ভাতা (৩) সন্মানী ভাতা (৪) পরিবহণ ভাতা (৫) অফিস খরচ (৬) লন্ড্রি ভাতা (৭) টয়লেট্রিজ, ক্রোকারিজ (৭) মাসিক ভ্রমণ (৮) টেলিফোন ভাতা ইত্যাদি। এছাড়াও আছে শুল্ক মুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা, স্বেচ্ছাধীন তহবিল বার্ষিক ৫ লাখ টাকা এবং সংসদ ভবন এলাকায় এমপি হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা। আগামী ৫ বছর ধরে এসব সুযোগ সুবিধা তারা ভোগ করবেন।
আমি লিখেছিলাম যে,এত বিপুল সুযোগ সুবিধা তিনি পায়ে দলেছেন শুধুমাত্র নীতির কারণে এবং দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। বাংলাদেশের সমসাময়িক কালে এমন নীতিনিষ্ঠতা এবং নির্লোভ মানসিকতা সচরাচর দেখা যায় না। আমার ওই লেখাটির যে অংশে মির্জা ফখরুলের প্রশংসা রয়েছে তার সাথে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেছেন এবং মির্জা ফখরুল এত নীতিনিষ্ঠ নন বলে মন্তব্য করেছেন। একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন, মির্জা ফখরুলকে প্রশংসা করার আগে ভেতরের খেলা ও পেছনের খেলাটা বোঝার চেষ্টা করুন। আরেকজন লিখেছেন, পেছনে আরও কাহিনী আছে। রোকন তালুকদার নামে একজন মন্তব্য করেছেন, তাহলে কি ঐ চারজন দলীয় সিদ্ধান্তে নয়, নিজেদের সিদ্ধান্তে যোগ দিয়েছেন? কৌশলের কথা বলা হয়েছে দলীয় নেতাদের মুখ রক্ষার জন্য এবং মুখ রক্ষার জন্যই মহাসচিব বিবৃতি দিয়েছেন। আমাকে বলা হয়েছে, আদ্যপান্ত সব পরিস্কার করুন। একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর মন্তব্য করেছেন, আপনি মির্জা ফখরুলের প্রশংসা করেছেন, এখন ওই ৫ জনের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য উপস্থাপন করুন। এই ধরণের প্রশংসা ও সমালোচনা মিলিয়ে আমার ওই লেখাটির ওপর প্রচুর মন্তব্য এসেছে।
এসব থেকে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিস্কার হয় যে, বিএনপির ওই ৫ জনের শপথের ঘটনাটি বাংলাদেশের সমাজের প্রায় সর্বস্তরে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বলা বাহুল্য, লাখ লাখ মানুষের প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক। ঘূর্ণিঝড় ফণি দুই দিনের জন্য ওই প্রতিক্রিয়াকে চাপা দিতে পেরেছিল। কিন্তু আগে যেমন ঘটনাটি ছিল টক অব দি কান্ট্রি, এখন ঘূর্ণিঝড় ফণির বিপদ কেটে যাওয়ায় আবার বিষয়টি সারফেসে এসেছে। বিষয়টির ওপর নির্মোহ ও নিরপেক্ষ আলোচনা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ হওয়া দরকার।
দুই
বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং বিস্ফোরক। যারা আমাকে সব ঘটনা পরিস্কার করে খুলে বলার জন্য অনুরোধ করেছেন অথবা যারা বলেছেন এর পেছনে অনেক বড় ঘটনা আছে, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, ঘটনার পেছনে বড় ঘটনা থাকতেও পারে। কিন্তু আসল ঘটনা আমি জানিনা। পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে যে, সিদ্ধান্তটি এসেছে লন্ডন থেকে তারেক রহমানের মাধ্যমে। কিভাবে ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠক করেন, তারা শপথ গ্রহণ সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত নেন, কিভাবে স্কাইপের মাধ্যমে তারেক রহমানের সাথে তাদের যোগাযোগ হয় এবং সব শেষে ওই ৫ এমপির সাথে তারেক রহমানের কিভাবে স্কাইপিতে কথা হয় সেসব খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে। তাই আমি সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করবো না। কিন্তু লন্ডন থেকে তারেক রহমান কি কারণে ওদের শপথ গ্রহনে সম্মত হলেন অথবা তিনি ফখরুলকে যোগদান করতে নিষেধ করলেন, সেটি ঢাকায় বসে উদঘাটন করা সম্ভব নয়। প্রকৃত সত্য জানার জন্য আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে ঢাকা থেকে লন্ডনে একাধিক ব্যক্তিকে টেলিফোন করি, যারা তারেক রহমানের আশে পাশে ঘোরাফেরা করেন। কিন্তু সেখান থেকেও এক সুরের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাই সেসব কথা আমি এখানে বলছি না। কিন্তু ঢাকার পত্রপত্রিকায় যেসব কথা এসেছে তার সবগুলিও সঠিক নয়।
আমাকে যারা এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য লিখেছেন তাদের জন্য এবং ইনকিলাবের পাঠক ভাইদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, ৫ জন সদস্যের শপথ গ্রহণের পেছনে পর্দার অন্তরালে একটা ‘ডিল’ হয়েছে বলে প্রচার প্রোপাগান্ডা চলছে সেটিও সঠিক নয়। আমার ধারণা, ওই ৫ জন সদস্যের শপথ নেওয়াটা সরকার ও বিএনপির মধ্যে কোনো সমঝোতার ফলশ্রুতি নয়। আদোতেই কোনো সমঝোতা হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে আমার পুরোপুরি সন্দেহ রয়েছে।
আওয়ামী ঘরানার মিডিয়াতে বলা হচ্ছে যে, বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পর্দার অন্তরালে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে কথা বার্তা চলছিল। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে বলে যে, বেগম জিয়াকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে যদি বিএনপির ওই ৬ জন সদস্য শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু কিভাবে তিনি মুক্তি পাবেন? প্যারোলে? না জামিনে? এই প্রশ্নটি কেউ ক্লিয়ার করেননি। বিএনপির ৫ জন তো শপথ নিলেন। কিন্তু কই, খালেদা জিয়ার মুক্তির তো কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কিসের ডিল?
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে বিএনপি আপিল করেছেন এবং একই সাথে তার জামিনও চেয়েছেন। তার আপলটি গৃহীতও হয়েছে। তবে শুনানি হবে দুই মাস পর। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আগামী দুই মাসের মধ্যে তার মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নাই। হাইকোর্ট আপিলটি গ্রহণকালে বলেছেন, আরও একটি মামলায় দন্ডিত হয়ে তিনি কারাভোগ করছেন। এই মামলায় অর্থাৎ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন পেলেও অরফানেজ মামলায় তিনি তো জেল খাটতেই থাকবেন। সুতরাং এখানে অর্থাৎ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন পেলেও বেগম জিয়া কিভাবে জেল থেকে তিনি বের হবেন? এই তথ্য থেকে এই সত্যটি বেরিয়ে আসে যে, নিকট ভবিষ্যতে আইনী প্রক্রিয়ার বেগম জিয়ার জামিন মেলা তথা জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সম্ভাবনা নাই।
অন্য একটি রাস্তা আছে প্যারোলে মুক্তি। এব্যাপারে তার পরিবার মানবিক এবং আবেগের কারণে যে কোনো মূল্যে তার মুক্তি চায়, এমনকি প্রয়োজন হলে প্যারোলেও। কিন্তু বেগম জিয়া নিজে প্যারোলে মুক্তির সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ, বেগম জিয়া জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে যে হিমালয় সদৃশ্য উচ্চতায় উঠেছেন প্যারোল নিলে সেই জনপ্রিয়তার দ্রুত পতন ঘটতে থাকবে। সুতরাং তিনি সামারিলি প্যারোল নাকচ করে দিয়েছেন। এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আপতত বেগম জিয়ার কারমুক্তির কোনো সম্ভাবনা নাই। সুতরাং পর্দার অন্তরালে একটি ডিল হয়েছে বলে যে কথাটি বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সেই কথার কোনো ভিত্তি নাই। কিন্তু এখানেই এসে পড়ে সেই বড় প্রশ্নটি। কিছুই যখন তারা পাচ্ছেন না তখন তারা সংসদে গেলেন কেন?
তিন
শূণ্য হাতে শপথ গ্রহণের ফলে বিএনপির যে কতবড় ক্ষতি হয়েছে সেটি বিএনপির হাই কমান্ড বুঝতে পেরেছেন কিনা জানিনা। অন্যেরাতো বটেই, এমনকি বিএনপি এবং ইসলামী ঘরানার লক্ষ লক্ষ মানুষ বিনা শর্তে শপথ গ্রহণে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ও ব্যাথিত হয়েছেন। আমি যে দু চার জনের সাথে কথা বলেছি। তারা প্রশ্ন করছেন, এমন শর্তহীনভাবে বিএনপির ওই ৫ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করলেন কেন? আর বিএনপি হাই কমান্ডই বা সেই আত্মসমর্পণে সম্মতি দিলেন কেন? দলের অনুমতি ছাড়াই তারা যদি শপথ নিতেন তাহলে দলের কি ক্ষতি হতো? মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ দু চার জন বলতে চান যে, যদি হাইকমান্ড তাদেরকে শপথ গ্রহণের অনুমতি না দিতো তাহলে ওই ৫ জন দলকে অমান্য করে শপথ গ্রহণ করতো এবং ফলে দলে একটি বিভাজন সৃষ্টি হতো। হতোই বা সেই বিভাজন। কিন্তু সেই বিভাজনে দলের ক্ষতি না হয়ে দলের বরং লাভ হতো। দলের আপোষহীন ভাবমূর্তি আরও সমন্বিত হতো। অতীতে মরহুম কে এম ওবায়দুর রহমানের মতো জাঁদরেল নেতাও বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ছিলেন।
সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত মরহুম আব্দুল মান্নান ভূঁইয়াসহ অনেক বড় বড় নেতা বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে বিএনপির কোনো ক্ষতি হয়নি। আসলে সাধারণ মানুষ, যারা সংখ্যায় লক্ষ লক্ষ, তারা মূল স্রোতের সাথে থাকে। আর বিএনপির মূল স্রোত হলো বেগম খালেদা জিয়া। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো মূল স্রোত এখন নাজিমুদ্দিন রোডের কারাগারে। বেগম জিয়া শপথের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে আছেন। সেই অবস্থানকে অমান্য করে যদি ওই ৫ জন শপথ নিতেন এবং দল তাদেরকে বহিস্কার করত তাহলে আওয়ামী লীগের করুণাপ্রার্থী হওয়া ছাড়া ওদের আর কোনো উপায় থাকতো না।
চার
চ্যানেল আইয়ের সাথে সাক্ষাতকারে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যে কথা বলেছেন, সেটিকেই ভেতরের খবর বলে মনে হয়। ওই ৫ জনকে বিএনপি হাইকমান্ড শপথ গ্রহণ করার পারমিশন দিয়েছে দলের বিভাজন ঠেকানোর জন্য। আলালের মতে, ভেতরে যতই হ-য-ব-র-ল থাকুক সারফেসে তো দেখানো গেছে যে, দল ঐক্যবদ্ধ। অন্য দিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই শর্তহীন আপোষ চায়নি। তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য মির্জা ফখরুলকে সংসদের বাইরে রাখা হয়েছে এবং তার আসন খালিও হয়েছে। এখন বিএনপি নেতা কর্মীরা বলতে পারবে যে, অন্যেরা শপথ নিলে কি হবে, আমাদের মহাসচিব তো শপথ নেননি। সুতরাং সমগ্র বিএনপি ওই ৫ জনের যোগদানকে অনুমোদন দিয়েছে একথা বলা যাবে না।
তারপরেও বলবো, এই নিঃশর্ত শপথের ফলে বিএনপির ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ভাবমূতি পুনরুদ্ধার করার সময় যে একেবারে চিরতরে চলে গেছে তেমন কথা বলবো না। এখনও সেই ভাবমূতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব । এটি তখনই পুনরুদ্ধার করা যাবে যখন বিএনপি সর্বশক্তি নিয়ে অর্থাৎ ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল সহ সকলকে নিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং আরও জনদুর্ভোগ ইস্যু নিয়ে মাঠে নামবে। সেই আন্দোলনকে হতে হবে দুর্বার এবং আপোষহীন কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তি পূর্ণ। নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ হলেও সেই আন্দোলনকে হতে হবে প্রচন্ড গতি সম্পন্ন এবং যে আন্দোলনে মাঠে নামবে ২০ দলের এবং ঐক্যফ্রন্টের শরীক দল ও নেতৃবৃন্দ। একমাত্র তখনই ওই ৫ জনের শপথের ইস্যুটি মূল্যহীন হয়ে যাবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।