চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
সন্ত্রাস বর্তমান সময়ের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এটি কেবল জাতীয় সমস্যা নয়, বরং আন্তর্জাতিক ব্যাধি। যার কারণে শান্তি, স্বস্তি ও শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে। একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সন্ত্রাস। সন্ত্রাস একদিকে যেমন বিশ্বশান্তিকে হুমকির মুখে দাঁড় করে দিয়েছে, অন্যদিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সভ্যতার সৌধকে। ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন তথা সবকিছুই ক্রমাগত সন্ত্রাসের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসীদের কালো থাবা থেকে বাঁচতে পারছে না কেউ। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও শান্তি- সুখের সুশীতল পরিবেশ। বিশ্বের সর্বক্ষেত্রে কেবল অশান্তির অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। ব্যভিচার, খুন খারাবি, রাহাজানি, চুরি- ডাকাতি তথা নানা পাপ অপরাধের উৎসব বয়ে যাচ্ছে আজ সারা বিশ্বজুড়ে।
সন্ত্রাস নামক জঘণ্যতম বিষয়টি আজ সারা বিশ্বের বুকে সবচেয়ে আলোচিত, সবথেকে ঘটনাবহুল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাস নির্মূলে প্রস্তাব, পরামর্শ ও উপদেশ কম বর্ণিত হয়নি। কিন্তু দু:খজনক হলে সত্য যে, এতো প্রস্তাব, এতো আইন প্রণয়নের পরেও সন্ত্রাস মোটেই বন্ধ হচ্ছে না। যতই দিন গড়াচ্ছে সন্ত্রাস যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে সন্ত্রাস এমন মারাত্মক আকারে রুপ ধারণ করছে যে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। সকল মানুষ আজ বড়ই অসহায় জীবন যাপন করছে। সন্ত্রাসীরা গলা কেটে জবাই করছে মসজিদের ইমামকে, হত্যা করছে পাদ্রি, ঠাকুরকে। জ্বালিয়ে দিচ্ছে মন্দির, গির্জা। এমনকি মুসলমানদের মিলন কেন্দ্র মসজিদও রেহাই পাচ্ছে না সন্ত্রাসীদের আক্রমণ থেকে। সন্ত্রাসীদের আগুনে সমাজ আজ দাউ দাউ করে জ্বলছে। পুড়ে ছাই হচ্ছে সারা বিশ্ব। জর্জরিত হচ্ছে প্রতিটি রাষ্ট্র। এই সন্ত্রাসীরা দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু ও ইসলামের শত্রু। দেশপ্রেমী সব নাগরিকের দায়িত্ব এসব সন্ত্রাসীর শিকড় সমূলে উপড়ে ফেলা।
সন্ত্রাসীদের ভয়ে মানুষ এখন রাতে ঘুমাতে পারে না এবং দিনে সন্ত্রাসীদের ভয়ে পথ চলতে পারেন না। আজ যানবাহনে সন্ত্রাস, রাস্তাঘাটে সন্ত্রাস, প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায় সন্ত্রাস, ঘরে ঘরে সন্ত্রাস এবং শিক্ষাঙ্গনে তথা যেখানে সুশিক্ষা অর্জন করে দেশ ও জাতির কল্যানের কাজ করা যায় আজও সেখানে সন্ত্রাসের কালো থাবায় জর্জরিত প্রত্যেকে প্রতিষ্টান। আর সেই সাথে অহরহ চলছে খুন , নৃশংসতা ও ধর্ষণের মতো বর্বরোচিত লোমর্শ ঘটনা। সন্ত্রাসের কবলে পুরো বিশ্ব আজ। মনে আজ একটাই প্রশ্ন কি করে আজ সন্ত্রাস দমন সম্ভব? কোন পথে অবলম্বনে সন্ত্রাস দূর করত: শান্তির সমাজ গঠন সম্ভব? জাতি কি পাবে মুক্তি, সন্ত্রাসীদের কবল থেকে? সন্ত্রাস মুক্ত সমাজ গড়তে উত্তম পন্থা কোনটি?
বর্তমান সময়ে সন্ত্রাস দমনে সহজ উপায় কেউই দিতে পারে নি, কিন্তু সন্ত্রাস দমনের উৎকৃষ্ট পন্থা ইসলামেই রয়েছে। ইসলাম শব্দটি আরবি ভাষার। অর্থ আত্মসমর্পণ করা। স্রষ্টার সামনে সৃষ্টজীবের আত্মসমর্পণে শান্তি বিরাজ করবে, এটাই সত্য স্বাভাবিক। কেননা আল্লাহ তায়ালা তো সমগ্র বিশ্বকে লালন-পালন করেন, রিজিক দেন, শান্তি দেন। ইসলাম শব্দটি ‘সিলম’ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ শান্তি নিরাপত্রা। আল্লাহর হুকুম ও রাসুলে পাক (সা:)-এর তরিকায় জীবনযাপনে ইহকাল ও পরকালের শান্তি নিশ্চয় বিদ্যমান। এটাই বাস্তব। কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী ইসলাম ও সন্ত্রাসকে একাকার করে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। ইসলামে নিরপরাধ মানুষ হত্যা হারাম। রক্তপাত, খুনখারাবি, বোমাবাজি, গুপ্তহত্যা, আত্মঘাতী হামলাসহ যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- ইসলামে নিষিদ্ধ। মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক, কোনো মানুষের জানমালের ক্ষতিসাধন ইসলাম সমর্থন করে না। রাসুলে পাক (সা:) এরশাদ করেন- ‘মুমিন মুসলমান তো সেই ব্যক্তি যার ব্যাপারে মানুষ নিজেদের জানমালের বিষয়ে নিরাপদ থাকে।’ (তিরমিযি শরীফ ) অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, রাসুলে পাক (সা:) এরশাদ করেন- ‘জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একখানা গোশতের টুকরা আছে। যদি ঐ গোশতের টুকরা কলুষমুক্ত থাকে তাহলে সমস্ত শরীর কলুষমুক্ত থাকবে। আর যদি ঐ গোশতের টুকরা বিনষ্ট হয় তবে সমস্ত শরীরও বিনষ্ট হয়ে যাবে। জেনে রাখ, ঐ গোশতের টুকরাই হচ্ছে মানুষের ক্বলব বা অন্তর ।’অন্তর কে প্রশান্তি দিতে হলে, অন্তরকে কলুষমুক্ত রাখতে হলে আল্লাহর জিকিরে নিজেকে মত্ত রাখতে হবে। সর্বাস্থায় রাব্বে কারিমের ভয় অন্তরে বিরাজমান রাখতে হবে। আর রাব্বে কারিম কে স্মরণই হচ্ছে পাপমুক্ত রাখার একমাত্র উত্তম পন্থা।
আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে এরশাদ করেন- অন্যের ক্ষতিসাধন ও সন্ত্রাসের ব্যাপারে একাধিকবার ধমক দিয়েছেন এবং নিষেধ করেছেন। তোমরা মানুষের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না এবং পৃথিবীতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করো না। (সুরা : শুআরা, আয়াত-১৮৩), যারা আল্লাহর অঙ্গীকারকে সুদৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক বজায় রাখতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে সন্ত্রাসী করে- এসব লোকের জন্যই রয়েছে লা’নত এবং রয়েছে কঠিন শাস্তি। (সুরা রা’দ, আয়াত-২৫), অন্য স্থানে রাব্বে কারিম এরশাদ করেন- তোমরা ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে ঠিকভাবে পরিমাপ করো ও ওজন দাও এবং মানুষকে তাদের বস্তু কম দিও না এবং পৃথিবীতে সন্ত্রাস করো না। (সুরা : হুদ, আয়াত-৮৫), অপর আয়াতে, আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো এবং দুনিয়ায় সন্ত্রাসী করো না। (সুরা : আ‘রা ,আয়াত-৭৪), অন্য আয়াতে বর্ণিত যে, তোমরা আল্লাহর দেয়া রিজিক খাও, পান করো, আর দুনিয়ার বুকে সন্ত্রাসী করে বেড়িও না। (সুরা : বাকারা, আয়াত-৬০) অন্য বর্ণনায় রাব্বে কারিম এরশাদ করেন- নামায কায়েম কর, নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও মন্দকর্ম থেকে বিরত রাখে, আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ। (সূরা: আনকাবুত, আয়াত-৪৫)। একজন নামাযী লোক কখনো মিত্যাবাদী হতে পারে না, একজন নামাযী লোক সন্ত্রাসী হতে পারে না, অশ্লীল কাজে ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা করতে পারে না। আর সন্ত্রাস দমনের সর্বোত্তম পন্থাই হচ্ছে নামায।
ইসলাম মানেই শান্তি । ইসলাম অনুসারীরা মুসলিম। মুসলিম মানেই শান্তিকামি। প্রত্যেক মুসলিম শান্তিকামনা করে। মুসলমান সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে না। একজন মুসলমান কখনো সন্ত্রাস উপাধি লাভ করতে পারে না। এব্যাপারে রাসুল (সা:) এরশাদ করেন- মুসলমান ঐ ব্যক্তি, যার মুখ এবং হাতের দেয়া কষ্ট থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। একজন মুসলমান সন্ত্রাসী হতে পারে না, এক মুসলমান ভাই অপর মুসলমান ভাই কে হত্যা করতে পারে না, এ ব্যাপারে রাসুল (সা:) কঠোর হূশিয়ারি করেন- মুসলমান কে গালি দেয়া ফাসেকী এবং হত্যা করা কুফুরী। ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। ইসলামে সন্ত্রাসবাদের কোন স্থান নেই। ইসলাম সন্ত্রাস দমন করার কোঠর নির্দেশনা দিয়েছে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করা মহাপাপ। কেননা রাসুল (সা:) এরশাদ করেন- ‘যে অবৈধ পন্থায় রক্তপাত ঘটায় সে কখনো ঈমানদার হতে পারে না।’(সহীহ বুখারী)। সন্ত্রাসের ব্যাপারে ইসলামে কঠিন শাস্তির বিধান আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলে পাক (সা:)-এর সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং পৃথিবীতে সন্ত্রাসী করতে সচেষ্ট হয় তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটা হলো তাদের জন্য দুনিয়াবী লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি (সুরা : মায়িদা, আয়াত-৩৩)।
ইসলাম মানব জাতিকে সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাতের সেরা জীব। ইসলামই মানবাত্মাকে পবিত্র ঘোষণা করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সমগ্র মানব জাতি একই পরিবারভুক্ত তাই একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে সমগ্র মানবকে হত্যা করা হয়েছে বলে দরে নেয়া হবে এবং অনুরূপ পাপ হত্যাকারির উপর অর্পিত হবে। সমাজ থেকে সকল প্রকার সন্ত্রাস দমন করে সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করাই হচ্ছে ইসলামের মূলনীতি। মানুষ কে হত্যা করা হচ্ছে মহাপাপ। এই মহা অপরাধের শাস্তির বিধান সম্পর্কে রাব্বে কারিম এরশাদ করেন- ‘কেউ সেচ্ছায় কোনো মুমিন কে হত্যা করলে তার শাস্তি চির জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর রব তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্থি প্রস্তুত রেখেছেন। (সূরা: আন-নিসা, আয়াত-৯৩)। এই ভাবেই ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যাও হারাম এবং আত্মঘাতী হামলা মহাপাপ। রাব্বে কারিম এরশাদ করেন- তোমরা নিজেদের নিজেরাই হত্যা করোনা। (সূরা: আন-নিসা, আয়াত-২৯)। ইসলামে কোনো সন্ত্রাসবাদের স্থান নেই। ইসলাম সন্ত্রাসবাদ কে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই সন্ত্রাসী সকল প্রকার কর্মকান্ড থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।