ভালোবাসি মাতৃভাষা
‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা...’আমার ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা।জন্মেই মাকে মা বলে
ট্রেনের কামরায় বসে আছি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা। বেশি দামের টিকিট কিনতে পারিনি। তাই সাধারণ লোকদের সঙ্গেই আমার কিছুক্ষণ বসার সৌভাগ্য হলো। একটু লক্ষ্য করে দেখলাম যে আমি বেশিরভাগ মানুষের বাক্যালাপ থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বুঝতে অক্ষম। চট্টগ্রামের লোক তাদের ভাষায়, সিলেটের লোক তাদের ভাষায়, রংপুরের লোক তাদের ভাষায়, অনেক শব্দ করে কথা বলে যাচ্ছেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ তারা নিজদের জেলার ভাষায় জম্পেস করে ভাবের আদান-প্রদান করছেন। তা হলে ভাষার মাসে এসে এদের কথা মনে হওয়ার কারণ কি? কারণ হলো এই যে এটি রূপময় বাংলা ভাষা নয়, বাড়ির ভাষা।
যখন আমরা বাইরে যাই, তখন বাড়ির ভাষাটা বাড়িতেই রেখে যাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েও যখন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে লক্ষ্য করি আঞ্চলিক ভাষার আধিক্য, তখন মনে হয় যে আমাদের শিক্ষার কোথাও গলদ আছে। কেন আমরা খাঁটি বাংলা ভাষায় কথা বলতে শিখব না? এদিকটার দিকে কেন আমরা মুখ ফিরিয়ে আছি? কবে আমাদের সম্বিত ফিরবে? প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলে এ কথাগুলো আমরা বার বার উচ্চারণ করি বটে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। বাড়ির পোশাক ও বাইরে বেরুনোর পোশাক এক হতে পারে না। যদি তাই হত, তা হলে আমাদের পোশাক খরচ অনেক কমে যেত। ভাষারও সেই অবস্থা। কোনো স্কুলে বা কলেজে প্রমিত বাংলার চর্চা হয় কিনা আমার জানা নেই। বিতর্ক, আবৃত্তি, বক্তৃতা, সবগুলোতেই প্রমিত বাংলা ভাষার চর্চা প্রাধান্য দিতে হবে। আবৃত্তির চর্চার যে কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে আমি তার সমর্থক। এমনকি টেলিভিশনে উপস্থাপনা শেখার জন্যেও সম্প্রতি ক্লাশ চালু হয়েছে। তাতে জানতে পারা যায় কিভাবে বাংলা শব্দের প্রক্ষেপণ হবে, কোথায় আস্তে হবে, কোথায় জোরে হবে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে চীনাদের ভাষা চর্চার কথা। আমি চীন দেশ ঘুরে এসেছি। সেখানে সবগুলো এয়ারপোর্টে গ্রামের যাত্রীরা বসে উচ্চ সরগ্রামে তাদের দেশীয় ভাষায় কথা বলে চলেছেন। কথাগুলো প্রায় চিৎকারের পর্যায়ে। এই উচ্চ চিৎকার রোধ করতে হবে।
বাংলাদেশে বিভিনড়ব জেলায় যখন যাই বিভাজনগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ে। এদিকে দৃষ্টি দেবে কে? কেন, বাবা-মারা। তারাই ছেলেমেয়েদেরকে সুস্থ প্রমিত বাংলা চর্চায় উৎসাহিত করবেন এটাই তো সবার আশা। এ নিয়ে বেশ কিছু বই বেরিয়েছে। বাংলা একাডেমী বইমেলায় এই বইগুলো যাতে ভালোভাবে প্রাধান্য পায় তার ব্যবস্থা থাকা দরকার। বক্তৃতা মালায় আমরা কাদের বক্তৃতা পছন্দ করি? যাদের করি, তাদের দুয়েকটি নাম উচ্চারণ করি। প্রথম নাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দ্বিতীয় নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। এদের শব্দচয়ন অনুকরণযোগ্য। যারা টিভিতে সবসময় সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, তাদের প্রতি সবার সপ্রশংস দৃষ্টি পড়ে। ওদের নাম জানি না, কিন্তু ভাবভঙ্গি এক নতুন মহিমায় আচ্ছ্বাদিত করে। মনে পড়ে মুনীর চৌধুরীর কথা। সেই সঙ্গে কবীর চৌধুরী। আরও মনে পড়ে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কথা। আমাদের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, রাফিকুল ইসলাম, কেন সবার দৃষ্টি কাড়েন? বাকভঙ্গির জন্য।
ভাষায় উনড়বতির জন্য গত এক বছরে কি কি করা হয়েছে, তার ক্ষতিয়ান নেয়া যেতে পারে। আমি যে এলাকায় বাস করি, অর্থাৎ গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, উত্তরা, সবখান থেকে বাংলা সাইনবোর্ড উঠে গেছে। আর যেখানে উঠে যায়নি, সেখানে বাংলায় লেখা হয়েছে ইংরেজি শব্দগুলো। যেমন মডার্ণ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সাইন্টিফিক ডিপার্টমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট স্টোর। এভাবে বাংলায় ইংরেজি লিখে কার লাভ হচ্ছে? কলকাতা থেকে আমাদের বন্ধুরা এসে সবচে’ বেশি খুশি হন বাংলা সাইনবোর্ড দেখে। তারা বলেন, কলকাতায় নেই, ঢাকায় আছে। তারা বলেন, আপনারা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আপনাদের জীবনে। এখানেই আমাদের জিৎ।
লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।