Inqilab Logo

রোববার ১৩ অক্টােবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

সেই সময়

ইউসুফ শরীফ | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

বাড়ির সামনের মাঠে ঘঁষা কাঁচের মত কুয়াশা, বাংলাঘরের উপর বড় আম গাছটার পাতা থেকে শিশির ঝরছে। প্রতিদিন এ সময়ই ঘুম ভেঙে যায় কেরামত মুন্সির। গত শীতেও দীঘির ঠা-া পানি দিয়ে ওজু সেরে মসজিদে গিয়ে আজান দিয়েছেনÑ নামাজ আদায় করেছেন। তারপর ঈশান ঘোষের সতের কাঠার ক্ষেতের ধারে কবরটার পাশে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পাঠ শেষে ক্ষেতখলা দেখে বাড়ি ফিরে ছেলে-ছেলের বউ আর নাতি-নাতনিদের ঘুম থেকে জাগিয়েছেন।
এই প্রথম শীতকালটা তার কাটছে ঘরে বসে। মাত্র দিন তিনেক ধরে গরম পানি দিয়ে ওজু করে ঘরে নামাজ আদায় করছেন। এর আগে প্রায় মাসখানেক বিছানাতেই শুকনা মাটির ঢেলা দিয়ে তাইমুম সেরে ইশারায় নামাজ আদায় করতে হয়েছে। কেরামত মুন্সি ঊনসত্তর বছর বয়সে এই প্রথমবারের মত অনুভব করেছেন তার সময় বুঝি ফুরিয়ে এসেছে। তার বয়েসিদের চেয়ে তিনি আগাগোড়াই ছিলেন যথেষ্ট শক্ত সমর্থ। খাবার-দাবারটা বরাবর নিয়মিত খেয়েছেন আর ক্ষেতখলায় গতর খাটাতেও গড়িমসি করেননি।
মাথায় পাশে জানালাটা একটু আগে তিনি নিজেই খুলে নিজেই দিয়েছেন। গতকাল হাফিজ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ডাক্তার বেটা, আর কয়দিন এমন শুইয়া থাকতে হইব? অহন যে একটু হাঁটাচলা করার ইচ্ছা করে।
ডাক্তার হেসে বলেছেন, এই তো আর ক’দিন, তারপর আপনি আবার আগের মতই চলাফেরা করতে পারবেন। তা হাঁটাচলা এখন একটু করতে পারেন?
কাল বিকাল থেকেই মনে মনে তিনি বাইরে ঘুরাফেরা করেছেন। এই দেড় মাসে বাইরে ক্ষেতখলা-জমাজমি-গাছপালা কেমন হয়ে উঠেছেÑ মনে মনে তার হিসাব-নিকাশ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেন। ঈশান ঘোষের সতের কাঠার ক্ষেত আর কবরটার না জানি কি হাল হয়েছে। ঈশান ঘোষের এই ক্ষেত যৌবন বয়সে কেরামত মুন্সির কাছে ছিল একতাল সোনার মতÑ লোকে শুনলে অবশ্য হাসবে। তিনি কাউকে বলেননি। দশ-দশটি বছর ধরে কি করে ঘরে বাঁশের খুঁটির ফোকরে সিকি-আধুলি আর কাঁচা টাকা জমিয়েছেন। তার সাথে আর পাঁচ কুড়ি টাকা মিলিয়ে ঈশান ঘোষের ছেলে মহিম ঘোষের কাছ থেকে এই ক্ষেতটা কেনা থেকেই তার শুরুÑ তারপর জমির নেশায় পেয়ে বসেছিল তাকে। গভীর রাতেও সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে জমির আইলে গিয়ে দাঁড়াতেনÑ লম্বা করে দম টেনে মাটির গন্ধ নিতেন। সেই সব পাগলামির কথা মনে করে হেসে ওঠেন কেরামত মুন্সি।
আজ তার বাপজানের কথা মনে পড়ছে। তার বাপজান সারাজীবন দুঃখ করে গেছেন। অনেক সময় আপন মনেই বলতেন, আমার কপাল মন্দ। নাইলে কত সাধ করে পোলারে রসুলপুর মাদ্রাসায় পাঠাইলাম, পোলা আমার আলিম হইব। আর হালার চাষার পোলা আলিমগিরি ফালাইয়া রাইখা হইল চাষা!
কেরামত মুন্সি এসব কথার কোন জবাব দিতেন না। খতম পড়া ও যিয়াফত খাওয়ার মধ্যে হয়ত অসম্মানের কিছু নেই কিন্তু তিনি পারতেন না। কেউ খতমের দাওয়াত দিতে এলে তিনি বলতেন, আমার তো অহন যাওনের সময় অইব নাÑ তারচে’ আমি খতম পইড়্যা বইখ্শা দেম’নে। প্রথম প্রথম লোকজন তাকে সিকিটা-আধুলিটা দিতে চাইত। তার এককথাÑ আপনাগোর দোয়ায় আল্লাহতাআলা আমারে ক্ষেতখলা দিছেনÑ খাইটা খাইতাছি। আল্লাহ খুব ভালা রাখছেন আমারে। এই পয়সাটা অভাবী এতিমগরে দিয়া দিবাইন, আল্লাহ বরকত দিবেন।
এসব কারণে অনেকে ‘আংরেজ মুন্সি’ বলে ঠাট্টাও করত। কেরামত মুন্সি কিন্তু বেশ কিছু ইংরেজি শব্দও জানেন আর বিদ্যাসাগরের বাল্যশিক্ষাটাও নিজের চেষ্টায় পড়ে শেষ করেছিলেন।
ছেলের বউ ওজুর বদনায় গরম-ঠান্ডা পানি মিশিয়ে দিয়ে গেছে। তিনি খাটের ডালায় ভর দিয়ে উঠে এলেন। বারান্দায় জলচৌকিতে বসে ওজু সেরে উঠানে দাঁড়ালেন। শরীর এখনও বলতে গেলে আগের মতই দুর্বল। দীঘির পাড়ে জাংলায় ফনফনা সীম আর লাউ গাছের দিকে তাকিয়ে মনে বেশ জোর পেলেন। ছেলের বউয়ের হাত বেশ ফলন্ত ঠিক তার শাশুড়ির মত। যেখানে যে বীজটা পুঁতে রাখতÑ তাই লকলকিয়ে বেড়ে উঠত। কেরামত মুন্সি ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে পড়েন। তারপর তাড়াহুড়া করে দীঘির উত্তর পাড় দিয়ে মসজিদের দিকে এগোতে থাকেন।
ছেলের বউ দৌড়ে এল, কই যান আব্বা?
তিনি পেছন ফিরে বললেন, যাইরে মাÑ জুম্মাঘরেই নামাজটা আদায় করি।
ছেলের বউ অস্থির হয়ে উঠে, আব্বা, আপনার শরীলতো ভালা হয় নাইÑ হাঁটতে পারবেন না।
তিনি বলেন, কিছু হইব না মাÑ এই তো একটুখানি পথ।
বলতে বলতে আলোয়ানটা গায়ে ভাল করে জড়িয়ে এগিয়ে গেলেন।
ছেলের বউ পেছনে থেকে বলল, তাইলে আমি আব্বা আপনার লাঠিটা দেই।
লাঠিটা হাতে নিয়ে কেরামত মুন্সির মনে পড়ে তার বাপজান আশি বছর বেঁচেছিলেন কিন্তু লাঠি হাতে নেননি। লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি অনুভব করলেন গায়ে কিছুটা জোর ফিরে এসেছে। জুম্মাঘরের সামনের প্রাঙ্গণে অযতেœর ছাপ। মনে হয়, তখনি নিজে বসে সব ঝাঁট দিয়ে সাফ-সুতোর করে ফেলেন। পাশের বাড়ির আফাজুদ্দিন ক্বারী গত কিছুদিন ধরে মসজিদে আজান দেন-ইমামতি করেন।
ক্বারী তাকে দেখে চমকে ওঠেন, আরে চাচামিয়া, অসুখ লইয়া জুম্মাঘরে আইছেনÑ কি করতাছেনÑ এইগুলান করাইবাম আমি।
তিনি বলেন, কি করবাম বেটাÑ মনটা বড় কান্দেÑ নে বাজানÑ আজান দে।
নামাজ আদায় করে কেরামত মুন্সি বাইরে তেঁতুল তলায় এসে দাঁড়ান। অল্পপরে পূবদিকে লালচে আভা ডিঙিয়ে সূর্য উঠলেও ঘন কুয়াশার জাল তখনও চারপাশ ঘিরে রেখেছে।
আফাজুদ্দিন ক্বারী বলেন, চাচামিয়া আমি একটু যাই। আমগর আবার কেইসের তারিখ আজ। গরুগুলানের খাওন-দাওনের ব্যবস্থা কইরা তারপর কাচারির গাড়ি ধরতে অইব।
কেরামত মুন্সি সামনে তাকিয়েই বলেন, কী অইব ভাইয়ে-ভাইয়ে মামলা-মোকদ্দমা কইরাÑ খালি উকিল-মোক্তারগর পেট ভরাইয়াÑ তারচে আপোষ হইয়া যাÑ জমি-জমা মানুষের সাথে যায় না।
আফাজুদ্দিন ক্বারী বলেন, এই তারিখটা কইরা আসিÑ পরে আপনি একটু বুঝাইয়া কন ভাইরে। আপনার শরীর ভালা থাকলে তো আর এই আকাম হয় না।
আফাজুদ্দিন চলে যাবার পরও তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পূবদিকে। ঈশান ঘোষের সতর কাঠার ক্ষেত এখনও কুয়াশায় তলিয়ে আছেÑ তার চশমায়ও কিছুদিন ধরে কাজ চলছে নাÑ কাঁচটা পাল্টান দরকার। এই ক্ষেতের প্রতি আরও এক কারণে গত দশ বছরে তার মায়া বেড়ে গেছে। সোনার টুকরো এই ক্ষেতে গোপাটের পাশে এক সোনার ছেলে শুয়ে আছে। বীরদের সর্ম্পকে কেরামত মুন্সির ধারণা আমীর হাজমা-আবু হানিফা আর সোহরাব রুস্তমের পুঁথিতে সীমাবদ্ধ ছিল। পুঁথির এসব বীররা বড়Ñ না এখানে শুয়ে আছে যে সে বড়Ñ এটা তিনি বলে বুঝাতে পারবেন না।
একাত্তরের সেই সময়ের কথা এখনও মনে হয়Ñ যেন এই সেদিনের কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি শিশু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছে তার যৌবনকালে। সে যুদ্ধওতো চোখে দেখা নয়। চাটগাঁয় বোমা পড়েছেÑ কলকাতায় বোমার আতংকে লোকজন সব শহর ছেড়ে গ্রামে আসছে। চাউলের মত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চড়ামূল্য আর পানির দামে জমি বিক্রির হিড়িক। যুদ্ধের সময় তার জমিতে ফসল হয়েছিল আর কিছু নগদ টাকা-কড়িও ছিলÑ অনেকে জোর করে তার কাছে জমি ‘রেহান’ দিয়েছেÑ বিক্রি করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের কথাÑ একাত্তরের কথা মনে হলেই তার বুক দুমড়ে-মুচড়ে যায়Ñ এলোমেলো অর্থহীন মনে হয় তার বাকি জীবনটা। ছোট ছেলেটিকে ঢাকা পাঠিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়তে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পর প্রতিদিন তিনি অস্থির হয়ে এর-ওর কাছে জিজ্ঞেস করেছেনÑ খবর নিয়েছেন আর অপেক্ষা করেছেনÑ এই বুঝি ছেলে এসে বলেÑ আমি এসেছি বাজানÑ অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। বর্ষাকাল শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সে এল নাÑ কোন খবরও পাওয়া গেল না। এই ছেলেটিকে জন্ম দিয়েই তার রাহেলা খাতুন ইন্তেকাল করেন। তিনিই কোলে-পিঠে করে মানুষ করেন এবং এর জন্যই চারদিকের শত প্ররোচনা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বার বিয়েতে রাজী হননি।
রাতেও তার ঘুম হত নাÑ সারাক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে থাকতেন। বড় ছেলে বৌ-বাচ্চা নিয়ে সন্ধ্যার আগেই ভরভরা বিল পার হয়ে পশ্চিমদিকে এক আত্মীয় বাড়িতে চলে যেত। সবার পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তিনি বাড়ি ছাড়তে পারেননি। অথচ মাইল চারেক দূরে গফরগাঁয়ে পাঞ্জাবিদের ঘাঁটি। এখান থেকে রেল লাইনও খুব বেশি দূরে নয়। এছাড়া আশেপাশের বাড়িগুলো একরকম পতিতই থাকে। ঘোষপাড়া প্রায় খালি করে এপ্রিলের মাঝামাঝি সবাই সীমান্তের ওপারে চলে যায়। পুরুষ মানুষ যে ক’জন ছিল তারাও গেছে মে মাসের শুরুর দিকে। এ গ্রামে রাজাকার বা শান্তি কমিটি কিছুই ছিল না। তারপরও অদৃশ্য শংকায় মোড়া ছিল এই গ্রামÑ পুরো এলাকা।
কেরামত মুন্সির মনের ভেতর সেই রাতটা আজও জেগে আছে। জমা হয়ে আছে টকটকে তাজা রক্ত।
সে রাতেও কান পেতে রেখে ভেবেছিলেনÑ প্রতীক্ষার অবসান হবেÑ ফিরে আসবে ছোট ছেলেÑ আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। হঠাৎ ভিতরের দিকে দরজায় টোকা পড়ে। এ রকম প্রায় প্রতি রাতেই ভাবেনÑ পরক্ষণেই আবার বুঝতে পারেন এটা তার মনের ভুল। আবার টোকা পড়েÑ তিনি কান খাড়া করেন এবং আবারও টোকা পড়ে। বিছানা থেকে উঠবার আগে একবার ভাবলেন। এবার টোকার সাথে সাথে ফিসফিসে কণ্ঠস্বর, ভয় পাবেন নাÑ আমরা ওপার থেকে এসেছিÑ দরজা খুলেন।
হারিকেন উসকে দিয়ে তিনি দরজা খুললেন। দরজার সামনে দু’তিনজন এবং উঠানে ও দেউড়ির পাশে বেশ ক’জন। সবার গায়েই চাদর। কাঁধে ঝুলানো অস্ত্রের আভাস খুবই স্পষ্ট।
দরজার সামনের একজন এগিয়ে এসে বলল, আপনিইতো কেরামত আলী সাহেব?
তিনি মাথা ঝঁকালেন। এক অজানা সংশয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে।
ছেলেটি বলে, চাচা আমি শহীদÑ আপনার ছেলে ফোরকানের ক্লাসমেটÑ বন্ধু।
তিনি ঘর থেকে নেমে শহীদকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন, বাবাÑ আমার ফোরকানের কি খবর বাবা?
শহীদ নয় পাশ থেকে আরেকজন বলে, জ্বিÑ ভাল আছে চাচা।
শহীদের দিকে দ্বিতীয়বার তাকিয়ে কেরামত মুন্সি স্পষ্ট দেখেন, ফোরকানকে! মনে হয়Ñ আদরের ছেলেকে তিনি বুকে পেয়েছেন।
ফোরকান কোথায় আছেÑ কেমন আছেÑ এদিকে আসবে কিনাÑ ইত্যাদি অনেক প্রশ্নেরই কোন উত্তর এল না। তিনি উত্তরের অপেক্ষা না করেই একের পর এ প্রশ্ন করে গেছেন।
এক ফাঁকে ওদের মধ্যে একজন বলে উঠে, চাচা আমাদের খুব ক্ষুধা পেয়েছেÑ খাবার কিছু থাকলে দেন।
সেই রাতে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা ওরাই করে নেয়। তিনি শুধু ঘর থেকে চাউল আর ডাল বের করে দেন। ভোর হবার আগেই ওরা চারটি দলে ভাগ হয়ে পশ্চিমদিকে চলে যায়। শুধু শহীদ নামের ছেলেটি রয়ে যায় পরবর্তী দলের আসার অপেক্ষায়।
কেরামত মুন্সি ফজরের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে ফিরে দেখেন, সে ঝুলনা গুছিয়ে নিয়ে ঘরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।
তিনি বললেন, কী ব্যাপার বাবাÑ আপনের ঘুম হইয়া গেল? আরেকটু ঘুমাইয়া নিতেন। কত রাত জাগতাছেনÑ কত কষ্ট করতাছেন।
শহীদ হেসে বলল, চাচাÑ যদি আমরা বাঁচিÑ আপনারা বাঁচেন তাহলে ঘুমাবার অনেক সময় পাওয়া যাবে।
কথা শেষ করার আগেই সে ঝুলনাটা হাতে তুলে নেয়।
কেরামত মুন্সি অবাক হয়ে বললেন, ব্যাগ নিলেন যে! চইলা যাবেন কোথায়ও?
শহীদ বলল, নাÑ তবে এঘরে দিনের বেলায় আমার থাকা ঠিক হবে না। এমন কোন ঘর আছে যেখানে কেউ বড় বেশি যায়-টায় না?
তিনি একটু ভেবে বললেন, তা আছে। গোয়াল ঘরের পাশে যে খড়ির ঘরটা আছে ঐটা খুব নিরিবিলি আর তার বাদেই জঙ্গল। কিন্তুক বাবাজি আমাদের গেরামে কোন ভয়-ডর নাই। এখানে কোন রাজাকার নাই-শান্তি কমিটিও নাই।
শহীদ বলে, চাচাÑ তবু জানেন তো সাবধানের মার নেই।
তিনি বলেন, জ্বেÑ কতা ঠিক। চলেন আপনেরে ঘরটা দেখায়া দেই।
শহীদ বাইরে বেরুবার পরিবর্তে গোল টুলটায় বসে পড়ে।
তিনি আবার বললেন, চলেন বাবাজি।
শহীদ শুনতে পায়নি এ রকম করে বলল, একটা কথা আপনাকে বলা দরকার।
এবার কেরামত মুন্সির বুক কেঁপে ওঠে। গতরাত থেকে যে আশংকায় দুলছেন তিনি তা আবার খচ্ খচ্ করে ওঠে।
তিনি অস্থির হয়ে বলে উঠেন, বাবা আমার ফোরকানের কি কিছু হইছে?
শহীদের মাথা আপনি নিচু হয়ে যায়Ñ রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, জ্বি চাচা।
এক কঠিন নি:স্তব্ধতা ঘিরে ধরে। কেরামত মুন্সি নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। শহীদ মুখ তোলে। ওর চোখে স্ফুলিঙ্গ ঠিকরাচ্ছে।
চাপা এবং দৃঢ় কণ্ঠে সে উচ্চারণ করে, চাচাÑ আমরা ওর বদলা নিয়েছি, আরও নেব। আল্লার কসম আমরা এমন শোধ নেব যা ইতিহাসে নজির হয়ে থাকবে। আপনার এ ত্যাগÑ এ দান দেশ-জাতি কোনদিন ভুলবে না। আপনি দুঃখ করবেন নাÑ আপনার ছেলে ফোরকান নেই কিন্তু আপনার ছেলে শহীদ আছেÑ আরও হাজারও ফোরকান-শহীদ আছেÑ থাকবে। আপনি শুধু আমাদের দোয়া করবেন চাচা।
কেরামত মুন্সি চিৎকার করে বুক ফাঁটিয়ে কাঁদতে চাইলেনÑ পারলেন না। তিনি হয়ত হাউমাউ করে কেঁদে ফেলতেন। শহীদের চোখের দিকে তাকিয়ে সহসা তার মনে হল, খবরটা জোরে চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জানাবার মত। অথচ তিনি চিৎকার দিতে পারছেন নাÑ সে চিৎকার বাতাসে ভেসে ভেসে যদি ওদের ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়।
এই ভয়ে সন্ত্রস্ত কেরামত মুন্সি অনেকক্ষণ পর শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ওর জানাজা-দাফন-কাফন কোনখানে হইছে বাবা?
এই শান্ত জিজ্ঞাসায়ও শহীদ বিব্রত বোধ করে, সে কী করে বলবেÑ ফোরকানের লাশটা শত্রুরা নিয়ে গেছেÑ তারা জানে না কি হয়েছে সে লাশের।
শহীদ প্রায় স্বগতোক্তির মত অস্পষ্ট স্বরে বললÑ না।
কেরামত মুন্সি এ খবরটাও সহজভাবে নিলেনÑ বিস্মিত হবার কিছুই যেন নেই আর তার!
শহীদকে খড়ির ঘরের মাচাংয়ের উপর তুলে দিয়ে এসে দেখেন তার বড় ছেলে লোকমান বউ-বাচ্চা নিয়ে এসে গেছে। ছেলের বউ বাচ্চা কোলে রান্না ঘরে ঢুকল নাশতার যোগাড় করতে।
লোকমান ঈশান ঘোষের ক্ষেতের দিকে যেতে যেতে বলল, ক্ষেতটা আগাছায় ভরে গেছেÑ একটু সাফ কইরা দিয়া আসিÑ কামলা পাওয়ার কুনু উপায় নাই।
কেরামত মুন্সি কিছুই বলতে পারলেন না। তার জিহ্বা শুকিয়ে গেছে। আশেপাশের বাড়ির লোকজনও এক এক করে এসে গেছে। মৃত গ্রামটা ধীরে ধীরে প্রাণ পেলেও নেই স্বাভাবিক উচ্ছ্বাসÑ অন্যদিন অনেকে এসে মুন্সির দহলিজে আড্ডা জমায়। কাল রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কি বলেছে-বিবিসি কি বলেছে-আকাশ বাণীর খবরই বা কিÑ এসব নিয়ে আলাপ হয়। আজও অনেকেই জড়ো হয়েছেÑ কেরামত মুন্সির তেমন উৎসাহ না দেখে সবাই ¤্রয়িমান।
পাশের বাড়ির একটা ছেলে তামাক সাজাবার জন্য এ বাড়ির রান্না ঘরে গিয়েছিলÑ সে এসে কেরামত মুন্সিকে বলে, দাদা রান্না ঘরে ডেক-পাতিল-থালা-বাসনÑ রাইতে কি কেউ খাইছিলÑ চাচি জিগাইছে।
ওর কথা শোনে কান খাড়া হয়ে উঠে সবার।
কেরামত মুন্সির দিকে তাকিয়ে একজন বলল, মুক্তি?
তিনি সংক্ষিপ্ত জবাব দেন, হ।
উপস্থিত লোকজনের চোখমুখে দুঃখের বিষন্ন ¤্রয়িমান ভাব কেটে যায়। সকালটা আশা-আনন্দ ও উদ্দীপনায় আলোকিত হয়ে ওঠে।
কেরামত মুন্সি চুপচাপ তাকিয়ে আছেন সামনে বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে। লোকমানকে হঠাৎ ঈশান ঘোষের ক্ষেত থেকে কাজ ফেলে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। কেরামত মুন্সি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন।
লোকমান মসজিদের কাছে এসেই চেঁচিয়ে উঠল, পালাওÑ তাড়াতাড়ি পালাও সকলেÑ পাঞ্জাবি আইয়া পড়ছেÑ পালাও তাড়াতাড়ি।
সাথে সাথে উপস্থিত সকলের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি হয়Ñ হতবুদ্ধি দশা কাটিয়ে তারা যে যার বাড়ির দিকে দৌড়ায়। আশ্চর্য! এখানে তো কোনদিন ওরা আসে না।
লোকমান কাছাকাছি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বাপজান অহনও বইসা আছেনÑ তাড়াতাড়ি চলেন বিল পার হইয়া যাইতে হইবেÑ মহিমগর বাড়িতে ঢুইক্যা পড়ছেÑ মোট তিন গাড়ি আইছে।
লোকমানের কথা শেষ হওয়ার আগেই মেশিন গান গর্জে উঠে উত্তর দিকে ঘোষপাড়ায়।
সে অস্থির কণ্ঠে বলে, বাপজান তাড়াতাড়ি চলেনÑ সময় নাই।
কেরামত মুন্সি চকিতে উঠে দাঁড়ানÑ খড়ির ঘরের দিকে যেতে যেতে বলেন, তুই সবাইরে লইয়া যাইতে থাকÑ আমি আইতাছি।
খড়ির ঘরে এসে দেখেন শহীদ মাচা থেকে নেমে স্টেনগান হাতে তুলে নিয়েছে। তাকে দেখে বলল, চাচা আর দেরি করবেন নাÑ আপনারা বিল পার হয়ে ওপারে চলে যান। আপনারা না যাওয়া পর্যন্ত আমি ওদের আটকে রাখব।
কেরামত মুন্সি বলেন, বাবা আপনের সঙ্গী-সাথীরা কেউ নাইÑ এইভাবে একলা একলা ফাইট দিয়া লাভ নাইÑ অস্ত্রটা ঝোলায় ভইরা চলেন আমগর লগেÑ বিল পার হইতে পারলে আর চিন্তা নাই।
শহীদ স্টেনগানে ম্যাগজিন লাগাতে লাগাতে বলল, চাচা অস্ত্র তো ঝোলায় ভরার জন্য নাÑ আর সময় নষ্ট করবেন না। আমি ফাইট দিয়ে না রাখতে পারলে আপনারা কেউ বিল পার হতে পারবেন নাÑ কেউ বাঁচতে পারবেন না।
কেরামত মুন্সি শহীদকে বুকে জড়িয়ে ধরে রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, বাবারে আমি ফোরকানরে হারাইছিÑ দুঃখ নাই। কিন্তু তোরা সবাই যদি এমন কইরা যাস তাইলে আমরা বাঁচবাম কারে লইয়্যা?
শহীদ অস্থির হয়ে ওঠেÑ চাচা আর কথা কওয়ার সময় নেই। আপনারা জলদি যানÑ আমার জন্য ভাববেন না। আমি ঠিক এসে আপনাদের সাথে মিলিত হব।
কেরামত মুন্সি হতবুদ্ধি হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেষে প্রাণভয়ে তাড়িত মানুষজনের দঙ্গলে জড়িয়ে পড়লেন। সামনে চারপাড়া গ্রামে স্ত্রী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের রুদ্ধশ্বাস ¯্রােত এখনও থামেনিÑ পেছনে গোলাগুলির প্রচ- শব্দ। ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন হাতে প্রাণ নিয়ে দৌড়াচ্ছে পশ্চিমদিকেÑ গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিলে।
কেরামত মুন্সি বিলের পানি ভেঙে কি করে যে মাঝখানে উঁচু টেকে প্রাচীন বটগাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন বুঝতে পারলেন না। তার পা আর চলছে নাÑ বুক উঠানামা করছে হাঁপরের মতÑ দৌড়ে যাবার শক্তি আর নেই। এখান থেকে ওদের গ্রাম দেখা যায়। মাঝখানে ভরভরা বিলের শান্ত পানি গোলাগুলিতে অবিরত তোলপাড় হচ্ছে। যারা বিল পার হয়ে গেছেÑ যারা বটগাছের গুড়ি আঁকড়ে থমকে আছেÑ তাদের সবার বুকের ভেতরটা টের পাচ্ছেন কেরামত মুন্সি।
ঘণ্টা খানেক পরে গোলাগুলির শব্দ থেমে গেলÑ কেরামত মুন্সির বাড়ির সামনের বিশাল তেঁতুল গাছ ছাড়িয়ে কালো ধোঁয়া উঠছে। তার বুকের ভেতর ধক্ করে উঠেÑ সারা জীবনের পরিশ্রম দিয়ে গড়া ঘরবাড়ি কী তাহলে আগুনে পুড়ছে। হঠাৎ মনে পড়ল শহীদের কথা। চারপাড়া গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবাই অক্ষত অবস্থায় বিল পার হতে পেরেছে। কিন্তু শহীদÑ শহীদের কি হয়েছে? সে কি ওদের হাতে ধরা পড়েছে নাকি ফোরকানের মত তার বুকের রক্তেও এই জমিন ভিজে গেছে?
কেরামত মুন্সি আর কিছু ভাবতে পারছেন না। বট গাছের একটা ঝুড়ি হেলান দিয়ে বসে আছেন। অনেকক্ষণ গোলাগুলির কোন শব্দ না পেয়ে সন্ত্রস্ত মিছিল থেকে দুয়েকজন সাহসী মানুষ পানি ভেঙে এসে বটগাছের তলায় জড় হয়েছে। সবারই চোখ দূরের চরপাড়া গ্রামের দিকে। কেরামত মুন্সি যে বসে আছেনÑ এদিকে যেন কারও খেয়াল নেইÑ কারও মুখে কোন কথাও নেই।
দশ বছর আগের ঘটনা হলেও কেরামত মুন্সির স্মৃতিতে এখনও সব তাজা। মনে হয়Ñ এই তো গতকালই ছিল সেই সময়Ñ সেই দুঃসময়। তার চোখ থেকে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে দুর্বা ঘাসে জমে থাকা শিশির বিন্দুতে মিশে যায়। সামনে ঘষাঁ কাঁচের মত কুয়াশাÑ বাংলাঘরের উপর বড় আমগাছের পাতা থেকে রক্ত চুঁয়ানো স্মৃতির শিশির ঝরছে...।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন