Inqilab Logo

রোববার ১৩ অক্টােবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাষা আন্দোলনের কথা

অধ্যাপক আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

পৃথিবীর কোনো বড় ঘটনাই হঠাৎ করে ঘটে না। ভাষা আন্দোলনও নয়। ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা সাধারণত বায়ান্নর আন্দোলনের কথা স্মরণ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু বায়ান্নর আন্দোলনও হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। বায়ান্নর পেছনে ছিল আটচল্লিশের অবদান। আর আটচল্লিশের পেছনে ছিল সাতচল্লিশের বিভাগ-পরবর্তী আন্দোলন। অবশ্য প্রকৃত প্রস্তাবে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে বিভাগ-পূর্ব যুগেই। আর এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল পাকিস্তান আন্দোলন।
পাকিস্তান আন্দোলনের মূলভিত্তি ছিল লাহোর প্রস্তাব। এই লাহোর প্রস্তাবে ছিল উপমহাদেশে মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা। ঘটনার স্রোতে প্রতিকূলতার কারণে সাতচল্লিশে দু’টির স্থলে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র হলে পূর্বাঞ্চলের রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে, এ ছিল অবধারিত ব্যাপার। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব অনুসারে না হয়ে সাতচল্লিশে উভয় অঞ্চল মিলে একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর দেখা গেল, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী। সুতরাং ভারত বিভক্ত হলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি হয়ে পড়েছিল অতি স্বাভাবিক ও অনিবার্য ব্যাপার।
পরিস্থিতির এটা ছিল এক দিক। অপরদিকে উপমহাদেশব্যাপী অখ- ভারত বনাম পাকিস্তান আন্দোলনের ভারতপন্থীদের উপস্থাপিত হিন্দীর মোকাবিলায় মুসলমানেরা উর্দুর প্রতি একটা সাধারণ দুর্বলতা পোষণ করত। সুতরাং স্বাধীন ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দীর মোকাবিলায় পাকিস্তানপন্থী অনেকেই উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বলে মনে মনে কল্পনা করত। প্রকৃত প্রস্তাবে এই প্রশ্নে বাঙালি ও অবাঙালি পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। এ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট সমঝোতায় উপনীত হবার পূর্বেই সাতচল্লিশের আগস্ট মাসে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়ে যায় এবং পাকিস্তান এই ভাষাভিত্তিক দ্বন্দ্বের উত্তরাধিকারী হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বিভাগপূর্ব আমলের কলকাতাকেন্দ্রিক পাকিস্তানপন্থী বাঙালি লেখকদের প্রতিষ্ঠত পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটিতে বহুবারই পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয় এবং সকলে এ ব্যাপারে এক মত হন যে, পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে অবশ্যই বিশেষ মর্যাদা দিতে হবে। পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির সদস্যদের মধ্যে মুজীবুর রহমান খাঁ, ফররুখ আহমদ, তালেবুর রহমান প্রমুখ এ ব্যাপারে বেশ কতকগুলো নিবন্ধ রচনা করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ স্বাধীন ভারতে হিন্দীর মোকাবিলায় পাকিস্তানে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের খ্যাতনামা মনীষী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার প্রতিবাদ করেন। এর পূর্বে হায়দরাবাদে ১৬ মে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে তাও বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর নবজাত রাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিসে উর্দু ভাষীদের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। স্বাভাবিকভাবে বাংলাভাষীদের মনে নানা আশঙ্কা সৃষ্টি হতে থাকে। এই প্রেক্ষিতেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ভাষার প্রশ্নে মারাত্মক সংশয় ও সমস্যা দেখা দেয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা-ভাবনার পাশাপাশি সুপরিকল্পিত সাংগঠনিক প্রক্রিয়াও শুরু হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির ২/৩ সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকায় ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠিত হয়। ইসলামী সাংস্কৃতিক লাইনের কর্মকা- ছাড়াও সুষ্ঠু ভিত্তিতে বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরা ছিল এই মজলিসের কর্মসূচির প্রধান দিক। এই সংস্থার পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ এই নামে একখানি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিনজন: ১. তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, ২. খ্যাতনামা সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন এবং ৩. বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। অধ্যাপক আবুল কাসেমের নিবন্ধে আন্দোলনের মূল দাবি সন্নিবেশিত হয়। এতে বলা হয়:
ক. বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালতের ভাষা।
খ. বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ।
গ. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দু’টিÑ বাংলা ও উর্দু।
পুস্তিকার দ্বিতীয় রচনা ছিল ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের। এতে তিনি বাংলা ভাষার সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্কের ঐতিহাসিক দিকটি তুলে ধরে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাংলা ভাষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। তৃতীয় নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’। এতে জনাব আবুল মনসুর আহমদ সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন যে, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ এবং সরকারি চাকরির ‘অযোগ্য’ হয়ে যাবে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, এমনি করেই অতীতে বৃটিশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রভাষা পরিবর্তনের মাধ্যমে মুসলমানদের রাতারাতি অশিক্ষিত ও সরকারি চাকরির অযোগ্য গণ্য করা হয়েছিল।
ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের মানি অর্ডার ফরম, টেলিগ্রাম ফরম, ডাক টিকিট ও মুদ্রায় ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার শুরু করে দেয়া হয়েছিল বলে এই পুস্তিকায় প্রকাশিত আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণের কোনো উপায় ছিল না। ফলে একদিকে চিন্তাশীল পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে যেমন ভাষার দাবি একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হিসেবে গভীরভাবে রেখাপাত করতে লাগল, তেমনি অনেকে এ দাবিকে শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য একটা অবাঞ্ছিত ও বিপজ্জনক চিন্তা বলেও ধারণা করতে লাগল। উর্দুভাষী প্রশাসকগণ এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দুর্বলচেতা নেতৃবৃন্দ জনগণের একাংশের এই সহজ-সরল মনোভাব কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন। এতে জনগণের মধ্যে বেশ কিছুদিন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা সম্ভব হয়।
এই প্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলনের প্রথমদিকে কর্মী ও নেতৃবৃন্দের কাজ যথেষ্ট কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পূর্বোক্ত তমদ্দুন মজলিস ছাড়াও গণ আজাদী লীগ ও গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামক দু’টি স্বল্পায়ু প্রতিষ্ঠানও বাংলা ভাষার দাবির প্রতি সমর্থন দান করে এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। ভাষা আন্দোলনের এই প্রথম পর্যায়ে অবশ্য তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকাই ছিল সবচাইতে সক্রিয়। তারা শুধু ভাষার দাবি তুলেই ক্ষান্ত হয়নি; সেমিনার, আলোচনা সভা, পোস্টার, বিবৃতি এবং নানারূপ সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মারফত বাংলা ভাষার দাবিকে জোরালো করে তুলে ধরতে চেষ্টা করে এবং ভাষার দাবিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে কনভেনর করে একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠন করে। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম প্রকাশ্য সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় ফজলুল হক হলে। এতে সভাপতিত্ব করেন সুসাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ্ বাহার এবং বক্তৃতা করেন কাজী মোতাহার হোসেন, কবি জসীম উদ্দীন এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম।
ইতোমধ্যে করাচীতে সরকারের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা অথবা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভা শেষে এক বিরাট মিছিল পূর্ববঙ্গ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বাসভবনে গমন করে। মন্ত্রীদের মধ্যে সৈয়দ আফজল ও জনাব নূরুল আমীন দাবির প্রতি সমর্থন করেন, তবে অর্থমন্ত্রী জনাব হামিদুল হক চৌধুরী দাবি সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জনান। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন অসুস্থতার কথা বলে মিছিলকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ দান করেননি (দ্রষ্টব্য : জাতীয় রাজনীতি, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা ৪২)।
ইতিপূর্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের তদানীন্তন শ্বেতাঙ্গ সচিব মি. গুডইন ১৯৪৭ সনের ১৫ নভেম্বর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে উচ্চতম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়াদি সম্পর্কে একটি সার্কুলার পাঠান। এই সার্কুলারে ঐ পরীক্ষার জন্যে সর্বমোট ৩১টি বিষয় দেয়া হয়, যার মধ্যে নয়টি ছিল ভাষা। এই সকল ভাষার মধ্যে হিন্দী, উর্দু, ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেন্স এমনকি ল্যাটিন এবং সংস্কৃত ভাষাও স্থান পেয়েছিল। কিন্তু স্থান পায়নি পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা। এই সার্কুলারের উল্লেখ করে তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদে একটি বিবৃতি দেন। ৩০ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেহাদে ঐ বিবৃতি এবং এ সম্পর্কে পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের লেখা এক কড়া সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এই বিবৃতি ও সম্পাদকীয় প্রকাশের ফলে ভাষার প্রশ্নে গণবিক্ষোভ গভীরভাবে দানা বেঁধে ওঠে এবং ভাষার দাবিতে আরও প্রত্যক্ষ কোন কর্মসূচি গ্রহণের চিন্তাভাবনা শুরু হয় ভাষা প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের প্রতিকূল মনোভাবের মোকাবিলায়।
ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-রাজনীতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে, যা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্র সংগঠন হিসেবে যে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ নামক ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল তার মধ্যে মূল প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগের মতো নাজিম-আকরম খাঁ গ্রুপের বিপরীতে সোহরাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থক একটি গ্রুপ কাজ করছিল। ঢাকায় পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবিরকে (১৫০, মোগলটুলি) কেন্দ্র করে এই গ্রুপটি ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। পার্টিশনের পর এবং সাময়িকভাবে সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের পৃষ্ঠপোষকতা হতে বঞ্চিত থাকলেও কলকাতা থেকে এই গ্রুপের নেতৃবৃন্দের ঢাকা আগমনের ফলে এরা বিভিন্ন প্রশ্নে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা নিতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হল মিলনায়তনে অধ্যাপক নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই গ্রুপের এক ছাত্র সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি নতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান জন্মগ্রহণ করে। জনাব নঈমুদ্দিন আহমদ এই প্রতিষ্ঠানের কনভেনর নির্বাচিত হন। ঢাকা শহর কমিটির কনভেনর হন জনাব অলী আহাদ। এই ছাত্রলীগ গোড়া থেকেই ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
৮ ফেব্রুয়ারি এই ছাত্রলীগ এবং অন্যদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলা ভাষার মর্যাদাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। খাজা নাজিমুদ্দীন প্রতিনিধি দলকে আশ্বাস দেন যে, বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহন এবং কেন্দ্রে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের স্বপক্ষে দাবি তোলেন বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এর বিরোধিতা করেন। ইতোমধ্যে খাজা নাজিমুদ্দীন তাঁর পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেন। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের এক সভা হয়। অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয় এবং নাজিমুদ্দীনের উক্তির প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে বৃহত্তর পরিধিতে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজনে ১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসের রশিদ বিল্ডিংস্থ অফিসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সভায় জনাব শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত করা হয় এবং একই বৈঠকে ভাষার দাবিতে সারা দেশে ১১ মার্চ হরতাল, সভা ও মিছিলের আহ্বান জানানো হয়। সংগ্রাম পরিষদকে আরও প্রতিনিধিত্বশীল করার লক্ষ্যে তমদ্দুন মজলিস ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ, গণ আজাদী লীগ, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও বিভিন্ন কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের কো-অপ্ট করে নেয়া হয়।
১১ মার্চের এই কর্মসূচি সফল করার জন্য ৩ মার্চ আন্দোলনের সমর্থকদের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেয়া হয়। কলকাতার দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরদান করেন: জনাব শামসুল আলম, কনভেনর, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ; অধ্যাপক আবুল কাসেম, সাধারণ সম্পাদক, তমদ্দুন মজলিস; জনাব নঈমুদ্দিন আহমদ, কনভেনর, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ; জনাব তফাজ্জল আলী, এম এল এ; মিসেস আনোয়ারা খাতুন, এম এল এ, সম্পাদিকা পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি; জনাব আলী আহমদ খান, এম এল এ; জনাব কমরুদ্দীন আহমদ, সাবেক অফিস সম্পাদক, ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ; জনাব শামসুল হক, পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মীশিবির; জনাব এম এ সালাম, দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান; জনাব বজলুল হক, সম্পাদক, জিন্দেগী; জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল; জনাব মোহাম্মদ তোয়াহা, সহ-সভাপতি, ফজলুল হক মুসলিম হল; জনাব আলী আহমদ, আহ্বায়ক, ঢাকা নগর মুসলিম ছাত্রলীগ ও জনাব আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, সম্পাদক, ইনসান।
বিবৃতিটির বাংলা তরজমা ছিল নি¤œরূপ:
‘১. বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ভাষা,
২. কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও
৩. পাকিস্তান গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবিতে কিছুকাল যাবৎ ব্যাপক আন্দোলন চলিতেছে।
বাংলা সমগ্র পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা। লজ্জার বিষয় এই যে, এই ভাষাকেই রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করিতে আন্দোলনের প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে.....ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার জন্যই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস ১১ই মার্চ রোজ বৃহস্পতিবার সাধারণ হরতাল ঘোষণা করিয়াছে। সংযুক্ত রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটির কর্মসূচি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে ও শৃংখলার সহিত ধর্মঘট পালন করিবার জন্য আমরা সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পূর্ব পাকিস্তানের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ছাত্র ও নাগরিকদের প্রতি আবেদন জানাইতেছি। ... কেন্দ্রীয় পাকিস্তান ও গণপরিষদে আমাদের আন্দোলনকে ভুল বুঝা উচিৎ হইবে না। এই গণতান্ত্রিক দাবীকে দমন না করিয়া বাংলা ভাষাকে মানিয়া লইলে আমরা বিশ্বাস করি, ইহাই হইবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের একতার ভিত্তি।” ১১ মার্চের এ কর্মসূচি বিপুলভাবে সাফল্যম-িত হয়। সেক্রেটারিয়েটের বিভিন্ন গেটে পিকেটিংকালে ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের অনেকে গ্রেফতার হন। বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতার মিছিলে হয় পুলিশী হামলা। এ সবের প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষুব্ধ ঢাকা নগরী মিছিলের শহরে পরিণত হয়। অতি শিগিরই কায়েদে আজমের ঢাকা আগমনের কথা ছিল। তাঁর সামনে ঢাকা শহরের অবস্থা শান্ত দেখানোর তাগিদে ১৫ মার্চ প্রাদেশিক আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন চলাকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক সভায় মিলিত হন। বহু আলোচনার পর উভয় পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দীন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে জনাব কমরুদ্দিন চুক্তিতে স্বাক্ষর দান করেন। চুক্তির ধারাসমূহ ছিল নি¤œরূপ:
১. ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে, তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তিদান করা হইবে।
২. পুলিশী অত্যাচারের অভিযোগ সম্বন্ধে উজিরে আলা স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে বিবৃতি দিবেন।
৩. ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে বেসরকারি আলোচনার জন্য নির্ধারিত তারিখে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার এবং ইহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় চাকুরী পরীক্ষাদিতে (সেন্ট্রাল সার্ভিস কমিশন) উর্দুর সমমর্যাদা দানের নিমিত্ত একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।
৪. পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে এপ্রিল মাসে একটি প্রস্তাব তোলা হইবে যে, প্রদেশের অফিস-আদালতের ভাষা ইংরেজির স্থলে বাংলা হইবে।
৫. আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কাহারোও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।
৬. সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।
৭. ২১ ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ববঙ্গের যে সকল অংশে ভাষা আন্দোলনের কারণে ১৪৪ ধারা জারী করা হইয়াছে, তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।
৮. সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর সরকার এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছেন যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত নয়।’
ইতোমধ্যে পূর্ব ঘোষিত প্রোগ্রাম মোতাবেক কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯ মার্চ ঢাকা আগমন করেন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসাবে এটাই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর একমাত্র সফর। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা হিসাবে তিনি ছিলেন তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
তেজগাঁও বিমানবন্দরে তিনি বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় এবং পরবর্তীকালে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে তিনি ঘোষণা করেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ছাত্ররা কায়েদে আজমের মুখ থেকে এমনটি ঘোষণার জন্যে তৈরী ছিল না। বিস্মিত, বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের একাংশ থেকে এ বক্তব্যের প্রতিবাদ উঠল। ঐ দিনই বিকালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল কায়েদে আজমের সঙ্গে সাক্ষাতকারে মিলিত হয়ে তাঁর কাছে বাংলা ভাষার দাবিনামা পেশ করেন। তবে এ আলোচনার ফল সন্তোষজনক হয়নি। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কায়েদে আজমের এ মনোভাব তাঁর এতদিনের ভক্তদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। তবে এর মূলে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের মতামত কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল তা আজও বলা যায় না। প্রবীণ সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের মারফত জানতে পারা যায়, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কায়েদে আজম তাঁর ভুল পরে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি পরবর্তীকালে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্নেল এলাহি বখশের কাছে নাকি এইমর্মে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে অন্যের কথা বিশ্বাস করে তিনি ভুল করেছেন (দ্রষ্টব্য: সাংবাদিকের রোজ নামচা, মোহাম্মদ মোদ্দাব্বের)। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৪৮ সালের মার্চের পর সেপ্টেম্বরে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তিনি কোনো বক্তৃতা-বিবৃতি দেননি।
ইতোমধ্যে ভাষা আন্দোলন সমর্থক তিনজন নেতা জনাব তফাজ্জল আলী, ডা. মালেক এবং জনাব মোহাম্মদ আলীর মধ্যে প্রথম দু’জন মন্ত্রিত্ব নিয়ে এবং শেষোক্তজন রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে আন্দোলন থেকে খসে পড়েন। এদিকে সুযোগ বুঝে নাজিমুদ্দীন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সম্পাদিত তাঁর চুক্তিও ভঙ্গ করে বসেন। এরপর আন্দোলন ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালের পর বেশ কয়েক বছর ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে প্রতিপালিত হয়। সাময়িকভাবে আন্দোলনে ভাটা পরিলক্ষিত হলেও আন্দোলন ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে।
১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ঐ দিন তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। এই সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ গোড়া থেকেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। প্রথম পর্যায়ে সৈনিকের সম্পাদক ছিলেন কথাশিল্পী শাহেদ আলী ও এনামুল হক এবং সহ-সম্পাদক ছিলেন আবদুল গফুর। এঁরা সকলেই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সৈনিকের সম্পাদনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন সানাউল্লাহ নূরী। তিনি তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র এবং ভাষা আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী (ইতিপূর্বে আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী সম্পাদিত স্বল্পায়ূ সাপ্তাহিক ‹ইনসান› ও ‘ইনসাফ’ পত্রিকা ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে)। ‘সৈনিকে’ ভাষার প্রশ্নে নিয়মিত নিবন্ধ এবং সংবাদ ইত্যাদি প্রকাশিত হত।
উর্দু ভাষাকে সরাসরিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে সরকার বাংলা ভাষার উর্দু হরফ চালু করবার প্রচেষ্টা চালায়। এর বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের সমর্থক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সৈনিকসহ বিভিন্ন পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রবল প্রতিবাদ উত্থিত হয়। এভাবে ভাষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ না করলেও আন্দোলনের ধারা ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে। এ সময় আন্দোলনকে ছাত্র সমাজে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি স্বতন্ত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ইতিমধ্যে ১৯৪৯ সালে দেশের প্রথম রাজনৈতিক বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং আরও পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হলে ভাষা আন্দোলনের শক্তি আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা আগমন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও অন্যান্য বিষয়ের দাবিনামা তাঁর সামনে পেশ করা হয়। ডাকসুর তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক জনাব গোলাম আযম ছাত্রদের পক্ষ থেকে এটি পাঠ করেন।
ইতোমধ্যেই লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলীতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে এক বক্তৃতায় বলে বসেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু। এর প্রতিক্রিয়ায় সারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রচ- বিক্ষোভের ঝড় বয়ে যায়।
৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক প্রতিনিধিত্বমূলক সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা কাজী গোলাম মাহবুবকে কনভেনর করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের সদস্যবৃন্দ ছিলেন: মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জনাব আবুল হাশিম, জনাব শামসুল হক, অধ্যাপক আবুল কাসেম, জনাব আবদুল গফুর, জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব কমরুদ্দিন আহমেদ, জনাব -খয়রাত হোসেন, মিসেস আনোয়ারা খাতুন, জনাব আলমাস আলী, জনাব আবদুল আউয়াল, জনাব সৈয়দ আবদুর রহীম, জনাব মোহম্মদ তোয়াহা, জনাব অলি আহাদ, জনাব শামসুল হক চৌধুরী, জনাব খালেক নেওয়াজ খান, জনাব মীর্জা গোলাম হাফিজ, জনাব মুজিবুল হক, জনাব হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, জনাব শামসুল আলম, জনাব আনোয়ারুল হক খান, জনাব গোলাম মাওলা, জনাব সৈয়দ নুরুল আলম, জনাব নূরুল হুদা, জনাব আবদুল মতিন, জনাব শওকত আলী ও জনাব আখতারউদ্দীন আহমেদ।
সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি নেয়া হয়। ইতিমধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস সফল করার প্রস্তুতি এগিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ২০ ফেব্রুয়ারি ভীত-সন্ত্রস্ত প্রাদেশিক সরকার অপরাহ্নে ঢাকা শহরে এক মাসের জন্যে ১৪৪ ধারা জারী করে। এই পটভূমিতে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সংগ্রাম পরিষদের এক জরুরী সভা বসে। সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের এই সিদ্ধান্ত পরবর্তী দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে খুশী করতে পারেনি। ছাত্র প্রতিনিধিগণ পূর্বেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ছাত্র কর্মীবৃন্দ সুপরিকল্পিতভাবে ছোট ছোট গ্রুপের মিছিলের মাধ্যমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনকে এক নবদিগন্তে পরিচালনা করতে সমর্থ হন।
২১ ফেব্রুয়ারির সেই ঐতিহাসিক দিনটিতে ঘটনার নয়া মোড় পরিবর্তনে সর্বজনাব অলি আহাদ, গাজীউল হক, আবদুল মতিন প্রমুখের ভূমিকা ছিল মূখ্য ও নেতৃস্থানীয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পর ছয়, আট ও দশজনের বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ছাত্ররা রাস্তায় বের হতে থাকে। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত ছাত্রদের উপর কাঁদানে গ্যাস ছাড়ে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে ছাত্রদের মিছিলের মধ্য থেকে কে বা কারা দু’একবার পুলিশের প্রতি ইস্টক নিক্ষেপ করেছিল। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় এবার ছাত্রদের উত্তেজনা চরমে উঠে। ছাত্রদের বিক্ষোভ দমনের নামে পুলিশ প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে এবং পরে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সামনে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সঙ্গে পারস্পরিক ইস্টক বর্ষণে লিপ্ত হয়। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে আনুমানিক বেলা তিনটার পর পুলিশ ভাষার দাবীতে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর গুলী বর্ষণ করে। পুলিশের গুলী বর্ষণের ফলে একে একে ভূতলে লুটিয়ে পড়েন আবুল বরকত, সালাহউদ্দিন, জব্বার, রফিক এবং আরও অনেকে।
ছাত্র হত্যার খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। প্রাদেশিক পরিষদে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন পরিষদের অধিবেশন মুলতবীর দাবী জানান। তাঁরা এর প্রতিবাদে ওয়াক আউট করেন। মুসলিম লীগ দলীয় পরিষদ সদস্য দৈনিক আজাদ সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন পুলিশের গুলী বর্ষণের প্রতিবাদে প্রথমে মুসলিম লীগ থেকে, পরে পরিষদ থেকে ইস্তফা দেন। একুশের গুলী বর্ষণের খবর সারা শহরে এমনভাবে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল যে, এর পর থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত ঢাকা শহর বিক্ষোভ মিছিলের শহরে রূপান্তরিত হয়ে গেল।
২১ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ভাষা আন্দোলনের যে সব নেতা গ্রেফতার হননি তাঁদের কয়েকজনের জরুরি সভা হয়। এতে সংগ্রাম পরিষদের অস্থায়ী আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জনাব গোলাম মাওলা। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে পরবর্তী দিন ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাযা ও বিক্ষোভ মিছিল হয়।
এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি সারাদিন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক হল ও মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল থেকে মাইক যোগে আন্দোলন ও হরতালের কর্মসূচিকে সাফল্যমন্ডিত করার লক্ষ্যে একটানা প্রচার চলতে থাকে। ঢাকা তখন মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়-একথা আগেই বলা হয়েছে। ‘নারায়ে তকবীর- আল্লাহু আকবার’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নূরুল আমিনের কল্লা চাই’, ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই’ প্রভৃতি শ্লোগানে সারা শহর কয়েকদিন ধরে মুখরিত ছিল। সরকার ইতিমধ্যেই সংগ্রাম পরিষদের সব নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে। নেতাদের অধিকাংশই গ্রেফতার হন। অবশ্য কেউ কেউ আত্মগোপনও করেন।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের গুলী বর্ষণের খবরসহ সাপ্তাহিক সৈনিকের বিশেষ সংখ্যা বের হলে জনগণের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অবস্থার তাগিদে ২২ ও ২৩শে ফেব্রুয়ারিতে এক এক করে সাপ্তাহিকটির একাধিক সংস্করণ বের করতে হয়। ২২ ফেব্রুয়ারিতে থেকে বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ছাত্র হত্যা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিক্ষুব্ধ অবস্থার খবর ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাবে ক্রমে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, অতীতের মত এরপর আর কেউই কোনদিন বাংলা ভাষার দাবির বিরুদ্ধে এদেশে কথা বলার সাহস করেনি। একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল আন্দোলনের ইতিহাস লাল হরফে লেখা এমন একটি তারিখ যার তুলনা নেই, এদেশের ইতিহাসে যার নজির মেলা ভার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন