ভালোবাসি মাতৃভাষা
‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা...’আমার ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা।জন্মেই মাকে মা বলে
৬৭তম অমর একুশে আজ আমরা উদযাপন করছি। আমাদের মাতৃভাষা রক্ষায় এ দিনটিতেই চিরস্মরণীয় ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের শহীদরা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। সমসাময়িক ইতিহাসে এটি এক স্বতন্ত্র ঘটনা। আমাদের স্বাধীনতা আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনের ঐতিহাসিক সূচনার মুহূর্তও এটি। জাতির জন্য এটি গর্বের বিষয় যে, এ দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গোটা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে। সারা বিশ্বের জনগণ এ দিন নিজ নিজ মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শপথ নেন।
এই ঐতিহাসিক দিনে সৈয়দ মুজতবা আলীকে আমাদের স্মরণ করা উচিত। আমরা সবাই তাকে ব্যঙ্গ কবিতা লেখক, রোমান্টিক, ভাষাবিদ, মহান সাহিত্যিক হিসেবে জানি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে খুব কম লোকই তাঁকে চেনেন বা জানেন। সমসাময়িক বাংলা ইতিহাসে মুজতবা আলী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর ত্রিশটি বইয়ের মধ্যে বিশেষ করে দেশে-বিদেশে, চাচা কাহিনী, শবনম, পঞ্চতন্ত্র, ময়ূরকণ্ঠী ইত্যাদি বাঙালি পাঠকের কাছে কিভাবে সমাদৃত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর পান্ডিত্য-চিন্তাশক্তির ধার ফুটে উঠেছে তাঁর লেখনীতে। পরিতাপের বিষয় আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা অনেকেরই অজানা। আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলাই- এ কথা প্রথম যে ক’জন বলেছিলেন, এর মধ্যে অন্যতম সৈয়দ মুজতবা আলী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রিটিশ ভারত ভাগের অনেক আগে ‘মুসলিম ভারত’-এর সাধারণ ভাষা উর্দু করার জন্য কয়েকজন উর্দু পন্ডিত আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭ সালে লখৌতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের অধিবেশনে বাঙালি মুসলিম নেতারা এই প্রস্তাব খারিজ করে দেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর, এই উর্দু আন্দোলন ফের তেজি হয়ে ওঠে। করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে মুখ্যত প্রস্তাব নেয়া হয়, পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা উর্দু। স্কুল সংবাদ মাধ্যমে একমাত্র উর্দু ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব বিশেষভাবে গৃহীত হয় করাচি সম্মেলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি পড়–য়ারা এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান। বাঙালি ইসলামিক সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিশের সচিব আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা জোরদার আন্দোলন শুরু করেন। পাকিস্তানের সরকারি ভাষা তালিকায় বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করা ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতির দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এই আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ ক্ষেত্রে আগুনে ঘৃতাহুতি দেন। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের জনক কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা হবে উর্দু। পাঁচ দিন পর ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে জিন্নাহ ফের একই ঘোষণা করেন। উভয় সভাতেই জিন্নাহ বাধাপ্রাপ্ত হন। উভয় সভাতেই উপন্থিত কিছুসংখ্যক যুবক জিন্নাহর এই কথার তীব্র বিরোধিতা করেন। এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়–য়ারা আন্দোলনের গতি তীব্র করে তোলেন। ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি অনেকেই মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন।
এই ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগেই পাকিস্তান আলাদা দেশ হওয়ার তিন মাস পরই, সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষা করার জোরালো দাবি উত্থাপন করেন। এই সভায় রক্ষণশীল লোকেরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। সৈয়দ মুজতবা আলী সিলেটের এই সভায় হয়রানির সম্মুখীন হন। এমনকি তাঁকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু শক্ত ধাতুতে গড়া মুজতবা টানা তিন ঘণ্টা বাংলা ভাষার সপক্ষে জোরালো যুক্তিতর্ক পেশ করেন। তিনি নিজের দাবিতে অনড় থাকেন।
কেন মুজতবা নিজের জেলাতেই অপমানিত হলেন? ওই সময় সিলেটের পরিস্থিতি বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল দেশভাগ-গণভোটের কারণে। এ পরিস্থিতিতেও অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন মুজতবা আলী। উর্দু বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা উচিত নয় বলে ওই সময় সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি । তাঁর বক্তব্যে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘যদি আমাদের লোকজনের ওপর সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে কেবল তাদের স্বার্থে আমাদের শোষণ করার হাতিয়ার তুলে দেয়া হবে।
ভূগোলক চষে বেড়ানো-বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, গোটা বিশ্বের লোক নিজেদের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজের মাতৃভাষাকেই সবচেয়ে উপযুক্ত- সুবিধাজনক মাধ্যম বলে বিবেচনা করেন। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ইরান ও তুরস্ক বিজয় করলেও আরবরা অ্যারাবিক ভাষা চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পার্সি বা তুর্কিশ ভাষা মুছে ফেলতে পারেনি আরবরা। মোগলরাও ভারতে পার্সি ভাষা চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মুজতবা স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করেন, ‘যদি উর্দু পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপানো হয়, তাহলে আমাদের লোক একদিন বিদ্রোহ করবেন। পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবেন।’ তাঁর এ ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীতে সত্য হলো, আমরা আন্দোলন করলাম, সংগ্রাম করলাম এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হতে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করলাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ কিন্তু বপন হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।
এই সিলেট কান্ডের পরই হতাশ মুজতবা বাধ্য হয়ে কলকাতায় পাড়ি দেন। ওই সভায় তাঁর ভাষণের পুরোটা সাহিত্য সাময়িকী চতুরঙ্গ-তে তিনি প্রকাশ করেন। এখানেই অপমানের কাহিনীর শেষ নয়। সিলেটে যে অপমানের সূচনা হয়েছিল, তা এক বছর পর বগুড়ায় শেষ হয়। ১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বগুড়ার এক সাহিত্য সম্মেলনে পৌরোহিত্য করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই সম্মেলনে তাঁর দু’টি পান্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান স্থানীয় আজিজুল হক কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা। তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা-চিন্তাধারা দেখে তাঁরা সৈয়দ মুজতবা আলীকে এই কলেজের অধ্যক্ষ পদে বসাতে চান।
কলকাতার উঁচুমানের সাহিত্যিক জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে মোটেই রাজি ছিলেন না মুজতবা আলী। কলকাতা ছেড়ে ছোট জেলা বগুড়ায় আস্তানা গাড়ায় বিরোধী হলেও উপর্যুপরি চাপে মুজতবা হার মানেন। কয়েকজন শিক্ষক-পড়–য়া কলকাতায় গিয়ে তাঁকে রাজি করান।
১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। এই সময়টা ছিল বিস্ফোরণের মুহূর্ত। ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলন জোরদার করে তুলেছে। কিন্তু আলীর ভাগ্য প্রসন্ন ছিল না, শুরু থেকেই বগুড়ার রক্ষণশীল সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত্রের সলতে পাকানো শুরু করে। আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে তাঁর এই নিযুক্তি রক্ষণশীল-গোঁড়ারা মেনে নেয়নি।
অধ্যক্ষ পদে যোগ দেয়ার কিছু দিনের মধ্যেই কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কয়েকজন ছাত্র কলম ধরেছিলেন এই ম্যাগাজিনে। মুজতবা অধ্যক্ষ পদে আসীন হওয়ার অনেক আগেই ম্যাগাজিনের লেখা বাছাই হয়ে যায়্ এর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মুজতবাকেই কাঠগড়ায় তোলা হলো। বলা হলো, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য মুজতবাই ছাত্রদের প্ররোচিত করেছেন। ম্যাগাজিনে অধ্যক্ষের বার্তা হিসেবে মুজতবা যে লেখনী লিখেছিলেন, এতেও চক্রান্ত খুঁজে পায় প্রশাসন। পাকিস্তান সরকার এই ম্যাগাজিন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সব কপি বাজেয়াপ্ত করে।
ব্যাচেলর মুজতবা ওই সময় তাঁর বড় ভাই সৈয়দ মুর্তাজার সঙ্গে থাকতেন। তখন অধ্যক্ষের কোনও বাসস্থান ওই কলেজে ছিল না। মুর্তাজা ছিলেন তখন বগুড়ার ডেপুটি কমিশনার। চক্রান্তকারীরা কেবল ছোট ভাই মুজতবা আলীকে হয়রানি করে ক্ষান্ত হয়নি, ডেপুটি কমিশনার মুর্তাজার বিরুদ্ধেও আঙুল তোলে। তাঁকেও এতে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
মুজতবা গ্রেফতারি এড়াতে পালিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলেজ অধ্যক্ষ পদে যোগ দেয়ার সাত মাসের মধ্যেই তিনি ফের কলকাতায় আসতে বাধ্য হন। এদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির রক্ত ঝরে। দৃঢ় আন্দোলনের চাপে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তাঁর বিখ্যাত সিলেট ভাষণ আল-ইসলাহ ম্যাগাজিনে প্রকাশের অনুমতি দেন এই মহান সাহিত্যিক। পরবর্তীতে ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামে এই ভাষণ বই আকারে প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালে এটি পুনঃমুদ্রিত হয়। খুবই চিত্তাকর্ষক ও মূল্যবান দলিল। দুর্ভাগ্যের কথা, আমাদের বিরাট সংখ্যক লোক আমাদেরই ভাষা আন্দোলনে মুজতবা আলীর অবদান সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ।
প্রকৃতপক্ষে এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে, ১৯৯৯ সালের ১২ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের তরফে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে অমর একুশকে ঘোষণা করার আর্জি জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন তারই ভাতিজা সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। এ উদ্যোগ সফল হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের তরফে পেশ করা এ প্রস্তাব ইউনেস্কো সাধারণ অধিবেশন সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেছিল। ১৯৪৮ সালে মুজতবা আলী যা বলেছিলেন আজ তা সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করছে গোটা বিশ্ব। এই দিনে সারা বিশ্বের মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষায় শপথ নেন। এ মহান আত্মার প্রতি এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধার্ঘ আর কী হতে পারে!
মুজতবা আলী তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশির ভাগ সময় বিদেশ কাটিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মন-হৃদয় গভীরভাবে প্রোথিত ছিল বাংলাদেশে। আমাদের স্বাধীনতার পরই তিনি ঢাকায় চলে আসেন। শেষ জীবন পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অতিবাহিত করেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি ঢাকায় মারা যান। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। তাঁর লেখনী সব সময়ই আমাদের প্রেরণার উৎস। তাঁর অদম্য-অজেয় জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা আজো আমাদের কাছে আলোকবর্তিকাস্বরূপ। এই অমর একুশেতে আমরা সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। আগাগোড়া মহান দেশপ্রেমিক ও ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুজতবাকে বারবার শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।