পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
‘উইঘুর’ শব্দটার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৫২ সালে। ঐ বছর অক্টোবর মাসে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী যে ইসলামী সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে রুহী উইঘুর নামের এক লেখক সম্মেলনে পাঠের জন্য একটি ইংরেজী প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন, তাতে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় অবস্থিত উইঘুর সিনকিয়াং এলাকায় বসবাসকারী মুসলমানদের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রকাশ পেয়েছিল।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসের ঐ ইসলামী সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এবং এই সম্মেলন আয়োজনের জন্য যে প্রস্তুুতি কমিটি গঠিত হয় তার সভাপতি ছিলেন মরহুম প্রিন্সিপ্যাল ইবরাহিম খাঁ এবং বর্তমান লেখক (আবদুল গফুর) ছিলেন ঐ কমিটির সম্পাদক। ৪ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ঐ সম্মেলন বিভক্ত ছিল কয়েকটি বিভাগ তথা শাখায়, যথা: সাহিত্য, লোককলা, সমাজবিজ্ঞান ও ইসলামী আন্দোলন। ঐ সম্মেলনের সাহিত্য বিভাগে সভাপতিত্ব করেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন। লোক কলা বিভাগের সভাপতিত্ব করেন বিখ্যাত লোকবিজ্ঞানী মরহুম প্রফেসর মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতির আসন অলংকৃত করেন করাচীর বিখ্যাত গবেষক জনাব মাজহার উদ্দিন সিদ্দিকী এবং ইসলামী আন্দোলন বিভাগে সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম অধ্যাপক আবুল কাসেম।
সম্মেলনের বিভিন্ন বিভাগ ও শাখায় যারা প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন মরহুম অধ্যাপক ফেরদৌস খান, অধ্যাপক (পরবর্তীকালে ডক্টর) হাসান জামান অধ্যাপক আবু তালিব কলিকাতার দৈনিক নবযুগ পত্রিকার সাংবাদিক জনাব আলাউদ্দিন খান প্রমুখ সুধীবৃন্দ। ঐ সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে বিভিন্ন দেশ থেকে যারা বাণী পাঠিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমিনের নেতা হাসান আল হোদায়রী, ইরানের আবদুল্লাহ কারবাসাচাইন, ইন্দোনেশিয়ার মাসজুমী পার্টীর নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. এম এ রহিম প্রমুখ। এছাড়াও মুসলমান বিশে^র অনেক দেশের তদানীন্তন (বর্তমানে মরহুম) বহু বিশিষ্ট জন। বহুদিন পর প্রধানত: স্মৃতি থেকে লিখছি বলে বহু নাম বাদ পড়ে থাকবে। এ জন্য বাদ পড়া বিশিষ্টজনদের কাছে বিনীত ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বহু দিন পর প্রধানত স্মৃতি থেকে লিখছি বলে বহু নাম বাদ পড়ে থাকবে স্বাভাবিক কারণে।
এতসব বাধা ও অসুবিধা সত্তে¡ও এ বিষয়ে লিখার প্রয়োজন অনুভব করছি এ কারণে যে, পাকিস্তানের পশ্চিম উত্তর দিকস্ত যে এলাকায় উইঘুর নামের মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস আজও তারা সেখানে বসবাস করছে এবং চীনের কম্যুনিস্ট শাসকরা তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠকরা আমার এ বক্তব্যের পক্ষে স্বাক্ষ্য দেবেন বলে আমার বিশ^াস আছে বলেই পাঠকদের সামনে এ বিষয়টি নতুন করে তুলে ধরছি প্রধানত মানবিক বিবেচনা বোধ থেকে।
আমাদের দেশে এককালে কম্যুনিস্ট আন্দোলন খুবই জোরদার ছিল। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বিশে^র অন্যতম পরাশক্তি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ছিল তার স্থান। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, তখন চীনও ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী রাষ্ট্র। (পরবর্তী কালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের মধ্যেদিয়ে সোভিয়েত কম্যুনিজমেরও পতন হয়। এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রভাবে চীনেও কম্যুনিস্ট ব্যবস্থার পতন ঘটে। তবে চীনে কম্যুনিস্ট ব্যবস্থার পতন ঘটলেও চীন কম্যুনিস্ট পার্টীর পতন ঘটেনি। এখনও তারা তাদের কড়া শাসন অব্যাহত রেখেছে।
শুধু তাই নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণ দিকস্থ যেসব এলাকা মুসলিম-অধ্যুষিত থাকার কারণে সেই সব এলাকার জনগণের মধ্যে কম্যুনিস্ট আদর্শের প্রচারের লক্ষ্যে ইসলামের মধ্যেও যে সাম্যবাদের উপাদান রয়েছে তা বুঝাতে চেষ্টা করতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ভাঙ্গনের ফলে ঐসব এলাকার মুসলিম জনগণের মধ্যে ইসলামের প্রভাব ফিরে এলেও ঐ অঞ্চলের ঠিক পূর্ব দিকস্থ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা সিনকিয়াং এর জনগণের মধ্যে ঐরূপ স্বাধীন পরিবেশ ফিরে আসেনি।
আগেই বলা হয়েছে চীনের সিনকিয়াং অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রধানত: ইউঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। চীনের বর্তমান কম্যুনিস্ট শাসকরা প্রধানত : অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়াতে উইঘুরদের সাথে তাদের কোনো সুসম্পর্ক নেই। শুধু সুসম্পর্ক নেই বললেই বিষয়টা পুরা বলা হয় না। উইঘুরদের মধ্যে ইসলামের যে প্রভাব আছে তাকে চীনের কম্যুনিস্ট নেতারা আপত্তিকর মনে করে এবং তা দূর করতে বলপ্রয়োগ ও নির্যাতন চালানো কোনটাই বাদ রাখতে তারা রাজী নয়।
বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রতিবেশী ভারতের শাসক সম্প্রদায়ের মনোভাব ভাল নয়। বিশেষ করে ভারতের বর্তমান শাসক দল বিজেপি আগাগোড়াই একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হওয়াতে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের প্রতি তাদের মনোভাব আগাগোড়াই শত্রæতাভাবাপন্ন। ভারতের শাসক সম্প্রদায় মুসলমানদের প্রতি শত্রæভাবাপন্ন বলে বাংলাদেশের জনগণ চীনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। এই একই কারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনগণ চীনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। কিন্তু তারা চীনের উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে চীনের কম্যুনিস্ট শাসকদের আচরণে ক্ষুব্ধ। এটা উইঘুররা প্রধানত: মুসলামন বলে নয়, চীনের কম্যুনিস্টদের মধ্যে মানবিকতা বোধের প্রচÐ অভাব বলে।
আমরা উইঘুরদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন তারা প্রধানত: মুসলমান বলে নয়, তারা মজলুম বা নির্যাতিত বলে। কম্যুনিস্টরা বিপন্ন মানবতার পক্ষে বলে এক সময় যে ধারণা ছিল তা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে কম্যুনিস্ট চীনসহ বহু দেশে। ইসলাম জুলুম-নির্যাতনে বিশ^াস করেনা। সে কারণেই আমরা উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনের কম্যুনিস্ট শাসকদের নির্যাতনের বিরোধী। এই নির্যাতন তারা বন্ধ না করা পর্যন্ত আমরা তাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করব না।
রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে কম্যুনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার বহু বহু বছর আগে আরব দেশে সাম্যভ্রাতৃত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামের নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)। পরবর্তীতে মুসলমানরা অনেকে সাম্যভ্রাতৃত্বের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলেও প্রকৃত ইসলামপন্থীরা কখনও সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শ ত্যাগ করেননি।
অপর পক্ষে রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে একদা কম্যুনিস্ট সমাজ গড়ে উঠলেও অল্পদিন পরেই তারা দেশে নির্যাতনমূলক আদর্শের দিকে ফিরে যায়। সুতরাং কম্যুনিস্টদের ইতিহাস থেকে মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণের কিছু নেই। তাই রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে কম্যুনিস্ট শাসনের পরিবর্তে যে নির্যাতনমূলক পথে তারা দেশ পরিচালনা শুরু করেছে তা থেকে আমাদের গ্রহণের কিছু নেই। তবে এ বিষয়ে আমরা চীনের তুলনায় রাশিয়ার দৃষ্টান্ত থেকে কিছুটা ইতিবাচক কিছু দেখতে পাচ্ছি। রাশিয়ায় কম্যুনিস্ট শাসনের পতনের পর এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত যেসব অঞ্চলে এককালে কম্যুনিস্ট শাসন ছিল, সেসব দেশ এখন অপেক্ষাকৃত উন্নত সমাজ হতে পেরেছে।
দু:খের বিষয় এব্যাপারে রাশিয়ার দৃষ্টান্ত থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে কম্যুনিস্ট চীন। তার প্রমাণ আমরা দেখছি উইঘুরদের বাসভূমি চীনের সিনকিয়াংয়ে। সেখানে এখন চলছে কম্যুনিস্ট শাসকদের জংলী শাসন। এটা বলছি শুধু উইঘুরা মুসলিম বলে নয়। তারা যদি মুসলমান নাও হতো, আমরা তাদের এই জংলী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতাম।
আমরা পুনরায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাতে চাইছি যে কম্যুনিস্ট চীনের নেতৃবৃন্দ সিইনকিয়াং বসবাসরত উইঘুরদের উপর তাদের বন্য শাসন বজায় রাখা পর্যন্ত আমরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে কখনও দ্বিধা করবো না। এবং একমাত্র উইঘুরদের উপর নির্যাতন বন্ধ করলেই আমরা তাদের নিন্দা জানানো থেকে বিরত থাকবো। যতদিন উইঘুরদের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্ট শাসকদের নির্যাতন অব্যাহত থাকবে, ততদিন আমরা চীনের কম্যুনিস্ট নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো অব্যাহত রাখবো। অন্যদিকে উইঘুরদের উপর অত্যাচার চালানা বন্ধ করলে আমরা তাদের নিন্দা জানানো বন্ধ করবো। তারা উইঘুরদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধ করবে না আর আমরা তারপরও তাদের প্রতিবাদ চালাবো না এমনটা হবে না।
বাংলাদেশের জনগণ আমরা চীনের সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল যদিও আমাদের একাত্তুরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের শাসকরা পাকিস্তান শাসকদের প্রতি নিলজ্জ সমর্থন দিয়ে গেছে। কারণ ঐ সমথর্নের ব্যাপারে চীনের সাধারণ মানুষের কোন দোষ ছিল না। দোষ ছিল চীনের কম্যুনিস্ট নেতৃবৃন্দের। আমরা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে চীনের সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের সহানুভূতি জানাতে চাই এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাতে চাই যে, চীনের শাসকদের অপরাধের জন্য আমরা চীনের সাধারণ মানুষদের দায়ী করতে চাই না। তারা নির্দোষ কারণ তারা চীনের শাসকদের মত একাত্তুরের আমাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ করেনি।
তারা চীনের শাসকদের মতো আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করেনি, তাই তাদের শাসকদের সাথে একইভাবে দায়ী করতে পারি না। পক্ষান্তরে যেহেতু তাদের শাসকরা একাত্তরে আমাদের জনগণের পক্ষ দাঁড়ায়নি, তাই আমরা তাদের অকারণে নিন্দা করে তাদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই না। কারণ আমরা বিশ^াস করি, যারা অপরাধ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করাও একটা অপরাধ। আমরা যে কারণে চীনের সাধারণ মানুষের পক্ষে, সেই একই কারণে আমরা চীনের অপরাধী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না জানানোকেও একটা অপরাধ বলে মনে করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।