পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে রাজধানী পরিণত হয়েছে ইট-পাথর ও কংক্রিটের নগরীতে। এখানে মাটির ছোঁয়া পাওয়া যায় না। আছে কংক্রিটের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও ভবন নির্মাণের ধুলোবালির উড়াউড়ি। পাশাপাশি রয়েছে যানবাহন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড, মনোঅক্সাইড মিশ্রিত বিষাক্ত বাতাস। এতে রাজধানীর বাতাস যেমন ধূষিত হয়ে উঠছে, তেমনি বাতাস ভারি হয়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজধানীর এটা একটা দিক। আরেকটি দিক হলো, সবকিছু রাজধানীমুখী হওয়া। উন্নয়ন থেকে শুরু করে জনসেবামূলক যত ধরনের কর্ম রয়েছে, সবই রাজধানীকে কেন্দ্রিক। এসব সেবা পেতে সারা দেশের মানুষের স্রোত বরাবরই রাজধানীমুখী। এর ফলে ধারণক্ষমতার চেয়ে দুই-তিন গুণ মানুষ রাজধানীতে বসবাস করছে। রাজধানীতে যত মানুষ আসে, দেশের অন্য কোনো শহরে এতো মানুষের মিছিল হয় না। অর্থাৎ যা কিছুরই প্রয়োজন হোক না কেন, মানুষকে রাজধানীতে আসতেই হবে। এতে রাজধানী পরিপাটি ও বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা যাচ্ছে না। অপরিকল্পিত, ঘিঞ্জি ও দূষিত নগরীতে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত, বসবাসের অযোগ্য ও অসভ্য- এই তিন ধরনের খেতাবে ভূষিত হয়েছে।
দুই.
বিখ্যাত বৃটিশ ম্যাগাজিন দ্য ইকোনোমিস্ট-এর ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বিশ্বের বিভিন্ন নগরীর বসবাসের স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে প্রায় প্রতি বছর জরিপ করে থাকে। মূলত সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলোকে সূচক ধরে সংস্থাটি নগরীর স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে। তাদের এই সূচক বিশ্বে গ্রহণযোগ্য। সংস্থাটির জরিপে ২০১৪-১৫ সালে পরপর দুইবার ঢাকা নগরী বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য ও অসভ্য নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়। অর্থাৎ তাদের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা শহরে নাগরিকদের যে মানের জীবনযাপন করার কথা তার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা তারা পাচ্ছে না। এ জরিপ প্রকাশের পর পরিবেশবাদী ও নগর বিশেষজ্ঞরা বেশ নড়েচড়ে বসেন। তারা ঢাকার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। কিভাবে ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলা যায়, তার নানা পরামর্শ ও পরিকল্পনার কথা টেলিভিশন টক শো থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকায় তুলে ধরেন। তাদের এসব পরামর্শ আমরা শুনি, নগর কর্তৃপক্ষও শোনে, তবে কোনো লাভ হয় না। শোনা পর্যন্তই শেষ। তারপর যেভাবে চলার সেভাবেই চলে। এই যে যানজট নিয়ে এত কথা হচ্ছে এবং তা কীভাবে সহনীয় করা যায়, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা বহু পরামর্শ শুনেছি। এসব পরামর্শ কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ভ্রæক্ষেপ করেনি। ফলে যানজট অসহনীয় পর্যায়েই রয়ে গেছে। আগে মনে করা হতো, ছুটির দিনে কিছুটা যানজট কম হয়। এখন ছুটির দিন বলে কোনো কথা নেই, সব দিনই সমান হয়ে গেছে। দশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে লেগে যায় দুই ঘন্টা। এভাবে প্রতিটি সড়কে মানুষকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। এতে যে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে, তা হিসাব করে কূল পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা এ ক্ষতির পরিমাণ দিয়ে যাচ্ছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এক হিসাবে দেখিয়েছে, বিমানবন্দর থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে একদিনে ক্ষতি হয় ২২৭ কোটি টাকা। এটি শুধু একটি রাস্তার হিসাব। এ হিসাবে এই রাস্তায় মাসে ক্ষতি হয় ৬৮১০ কোটি টাকা। ব্র্যাকের এ হিসাবের বাইরে বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপিসহ দেশের অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অনেক হিসাব দিয়েছে। কেউ বলেছে যানজটে বছরে ক্ষতি হয় ৫৩ হাজার কোটি টাকা, কেউ বলেছে ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক যানজটে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা দিয়ে প্রতি বছর এক বা একাধিক পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এ ক্ষতি যদি অর্ধেকেও কমিয়ে আনা যায়, তাহলেও সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভাবে কিনা আমরা জানি না, তবে ভাবা উচিত। যানজটের এসব হিসাব দেয়া হয়েছে মূলত মানুষের কর্মঘন্টা নষ্ট ও যানজটে আটকে থেকে যানবাহনের জ্বালানি পোড়ার খরচ হিসাব করে। গড় হিসাবে দেখা যায় যে, যানজটে প্রতিদিন মানুষের ৮৩ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। আর যানবাহনের জ্বালানি পোড়ে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এত বিপুল ক্ষতি নিয়ে আমাদের সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। এমন একটি মনোভাব প্রতীয়মান হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে হোক, আমাদের কিছু করার নেই। অনেকটা লাগাম ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। লাগাম যে একটু টেনে ধরা বা কিছুটা ক্ষতির পরিমাণ কমানো দরকার- এ তাকিদ অনুভব করছে না। করলে নিশ্চয়ই দুই-তিন বা চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ কমানো যেত। এ খরচ কমলেও তো কম কথা নয়! দুঃখের বিষয়, আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না। একটি আদর্শ নগরীতে আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকলেও ঢাকা নগরীতে তা নেই। আছে মাত্র ৬.০৬ শতাংশ। তিন ভাগের এক ভাগেরও কম রাস্তা নিয়ে ঢাকা নগরী চলছে। তবে আমাদের নগরবিদরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, একটু সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা করা গেলে এই কম সড়ক দিয়েও সহনীয় যানজট নিয়ে চলাফেরা করা যায়। এসব ব্যবস্থা নেয়া খুবই সহজ। এই মুহূর্তে উদ্যোগ নিলে তার ফলাফল চোখের সামনে দেখা যাবে। যেমন অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া রাস্তা উদ্ধার করা, রাস্তার উপর অবৈধ পার্কিং নিষিদ্ধ করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা ইত্যাদি। একটু দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবস্থাপনা হিসেবে প্রধান প্রধান সড়কের মোড়ে ইউলুপ, আন্ডারপাস নির্মাণ করা। যানজটের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, রাস্তার তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা বেশি হওয়া। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী ঢাকার রাস্তায় যানবাহন চলাচল করার কথা সর্বোচ্চ ২ লাখ ১৬ হাজার। সে জায়গায় বিআরটিএ-এর হিসাব অনুযায়ী চলছে সাড়ে ১০ লাখের বেশি। এর মধ্যে আবার ছোট গাড়ি বা প্রাইভেট কারের আধিক্য দিন দিন বাড়ছে। ঢাকায় চলে দেশের প্রাইভেট কারের শতকরা ৭৮ ভাগ। আর প্রতিদিন ঢাকায় নামছে গড়ে ৩০৩টি যানবাহন। এর মধ্যে প্রাইভেট কার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি মটরসাইকেলের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বিআরটিএ-এর হিসাব অনুযায়ী, এক বছরে মটর সাইকেলের রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে ৮৬ হাজার। রাইড শেয়ারিং জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এ সংখ্যা যে দিন দিন বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। বেশি যাত্রী পরিবহনের বাস ও মিনিবাস বা মাইক্রোবাস খুব কম নামছে। এত অল্প রাস্তায় যদি কম যাত্রী পরিবহনকারী প্রাইভেট কার অধিক সংখ্যায় চলাচল করে, তবে যানজট কমার কোনো কারণ নেই। তার উপর কোনো কোনো পরিবারে রয়েছে একাধিক প্রাইভেট কার। হিসাব করে দেখা হয়েছে, একটি বাসে ৫২ জন, মিনিবাসে প্রায় ২৮ জন, মাইক্রোবাসে আকারভেদে ১০ থেকে ১২ জন চলাচল করতে পারে। অন্যদিকে একটি প্রাইভেট কারে চালকসহ ৩ থেকে ৪ জন চলাচল করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে প্রাইভেট কারের সংখ্যা যদি সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়, তবে যানজট যে সুতীব্র হয়ে উঠবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিন.
যানজট নিরসন কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে কোনো চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এর কারণ হচ্ছে, তাদের চলাচলের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। যারা ভিভিআইপি তাদের যাতায়াতের রাস্তা জনদুর্ভোগ চরমে নিয়ে ফাঁকা করে দেয়া হয়। আধাঘন্টা আগে থেকে তাদের চলাচলের রাস্তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একেবারে ফাঁকা করে দেয়। যাতায়াতের সময় তারা শুধু ফকফকা রাস্তা দেখেন। আর দেখেন রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। তারা কী আনন্দে দাঁড়িয়ে আছেন নাকি বিরস বদনে দাঁড়িয়ে আছেন, গাড়ির কালো গøাস ভেদ করে তা দেখার সুযোগ তাদের হয় না। কারণ তাদের গাড়ি মুহূর্তে চলে যায়। যানজটে পড়তে হয় না। একটু যদি উপলব্ধি করতেন বা থেমে দেখার চেষ্ট করতেন, তবে দেখতেন তাদের রাস্তার দুই পাশের সড়কগুলোর কী অবস্থা। মানুষ কীভাবে হাপিত্যেস করছে। তাদের এক চলার পথ কীভাবে পুরো ঢাকা শহরকে অচল করে দিয়েছে। পাঁচ-দশ মিনিটে তারা চলে গেলেও জটে আটকে পড়া মানুষগুলো কীভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকে। আর যারা ভিআইপি তাদেরও খুব একটা যানজটে পড়তে হয় না। কারণ তাদের জন্য উল্টো পাশের রাস্তা ফাঁকাই থাকে। তাদের গাড়ির অগ্রভাগে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি হুইসেল বাজিয়ে নিয়ে যায়। তারা জ্যাম দেখেন ঠিকই, এই জ্যাম সারানোর ব্যবস্থার কথা সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আলোচনা করেন না বলেই প্রতীয়মান হয়। মন্ত্রীসভার বৈঠকে যদি আলোচনা করতেন যে এক যানজটে বছরে যে ক্ষতি হয় তা দিয়ে দুইটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। প্রতিবছরের যানজটের ক্ষতি দিয়ে দেশে পদ্মা সেতুর মতো সেতু নির্মাণ করা কোনো ব্যাপারই না। এমনকি রাজধানীকে বাসযোগ্য করার জন্য যে খরচপাতি হওয়ার কথা তা-ও করা সম্ভব। আমরা বলছি না, একদিনে যানজটের সমাধান করে ফেলতে। অন্তত এটুকু তো করা যায় যে, যানজট নিরসনে একটি কার্যকর পরিকল্পনা নেয়া। আমরা তো তা দেখছি না। বরং দেখছি ঢাকার রাস্তায় যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ও সুব্যবস্থাপনার লেশমাত্র নেই। তানাহলে ধীরগতির রিকসার রাজত্ব সব রাস্তায় দেখা যেত না। বিশ্বে এমন কোনো শহর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে রিকসার মতো ধীরগতির বাহন ও দ্রæতগতির বাহন মিলেমিশে একাকার হয়। এ এক অদ্ভুত নগরী! এ নগরী বসবাসের অনুপযোগী হবে না তো অন্য নগরী হবে? বসবাসের অনুপযোগিতার কারণ শুধু যানজটই নয়। এ নগরীতে যেসব নাগরিক বসবাস করেন, তারা হাড়েহাড়ে টের পান ঢাকায় বসবাস করা কত কঠিন। এখানে অর্থ খরচ হয়ে যায়, সেবা পাওয়া যায় না। সরকারও নগরবাসীর সাথে একধরনের লুকোচুরি খেলা খেলে। যেমন পানির দাম গোপনে বাড়িয়ে দেয়া, গ্যাস না দিয়ে দাম বাড়ানো, বিদ্যুতের লোডশেডিং তো পুরনো ব্যাপার। ঢাকা শহরে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি কেউ ট্যাপ থেকে সরাসরি পান করেন, এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ এ পানি পানের অনুপযুক্ত। এতে দুর্গন্ধ থাকে, ঘোলা এবং পোকামাকড় ঘুরে বেড়ায়। অথচ এই পানিই বেশি দামে মানুষকে কিনতে হচ্ছে। আবার চুলায়ও গ্যাস থাকে না। গ্যাস না পেয়েও মানুষকে বিল দিতে হচ্ছে। একটি দেশের রাজধানীতে এত সমস্যা থাকে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। অথচ আমরা বলছি, ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো। এ যেন ছোট ছোট চোখে বড় বড় স্বপ্ন দেখা! রাজধানীর নাগরিকদের যে অবিরাম সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, এ সমস্যা বিরাজমান রেখে কীভাবে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো, তা ভেবে দেখা হচ্ছে না। সরকার হয়তো বলতে পারে, আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে রাজধানীর মানুষ মধ্যম আয়ের দেশের মানুষের মতোই বসবাস করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে সমস্যা দশকের পর দশক চলে গেলেও সমাধান হয়নি, তা আগামী অর্ধ দশকে কি সম্ভব? যানজট, পানি সমস্যা, গ্যাস সমস্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মানুষের টানাপড়েনের জীবন-এসব কি আগামী পাঁচ-ছয় বছরে সমাধান হয়ে যাবে? আমরা জানি, সরকারের হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই। থাকলে হয়তো পাঁচ-ছয় বছর নয়, এক নিমেষে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। আর যেভাবে ঢাকামুখী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, এর ফলে সমস্যা যে আরও জটিল আকার ধারণ করবে তাতে সন্দেহ নেই। ঢাকার বর্তমান লোকসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। ১৫ বছর পর তা হবে ২ কোটি ৭০ লাখের মতো। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ লাখ লোক বাড়ছে। প্রতি একরে বসবাস করছে ৩২৫ জন। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, এই অতিরিক্ত লোকগুলো বিদ্যমান যেসব সমস্যা রয়েছে, তা আরও প্রকট করে তুলবে। অর্থাৎ যেটুকু সুবিধা এখন নগরবাসী ভোগ করছে, তাতেই ভাগ বসাবে। তাহলে সমস্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি দূরে থাক, সরকার তো সমস্যারই সমাধান করতে পারছে না। সহসা পারবে বলেও মনে হয় না। কারণ কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই তো পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
চার.
ঢাকাকে বলা হয় মেগাসিটি। এর লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। আশা ও আশঙ্কা করা যায়, আগামী এক দশকে তা মেগা থেকে ‘গিগা’ সিটিতে পরিণত হবে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি ও সন্তুষ্টির মাধ্যমে তা যদি হয়, তবে নিশ্চয়ই তা গর্বের বিষয় হবে। পরিতাপের বিষয়, তা যে হবে না, তা এক প্রকার নিশ্চিত। বরং সমস্যার পাহাড় দিন দিন বড় হয়ে উঠবে। এর মধ্যে ভূমিকম্প যেভাবে সুরম্য অট্টালিকা থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে; আল্লাহ না করুন, যদি সত্যিকারের আঘাত করে বসে, তবে কী পরিণতি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। শুধু চোখের সামনে ধ্বংসস্তুপই দেখা যাবে। আমরা মনে করি, ঢাকা যেসব সমস্যায় জর্জরিত সেগুলো সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। যা হচ্ছে বা যা হবার হবে-এমন মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যে কাজগুলো সহজে করা যায়, সে কাজগুলো আগে করতে হবে। যানজট সহনীয় করতে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রাথমিক কাজ হিসেবে, সড়ক দখলমুক্ত করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ করা, বাস থামানো, সড়কের মোড়গুলো পরিস্কার রাখা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, সব রাস্তায় অবাধে রিকসা চলাচল বন্ধ করাÑএ পদক্ষেপগুলো নেয়া। প্রাইভেট কারের নিবন্ধন কমিয়ে দেয়া দরকার। এমনকি ছয় মাস বা এক বছর বন্ধ রাখলে দেখা যাবে, যানজট অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। এর পরিবর্তে বাস, মিনিবাসের মতো অনেক যাত্রী বহনকারী গাড়ি বৃদ্ধি করা। এসব গণপরিবহণ কোন রুটে কতটি চলবে তা পরিকল্পিতভাবে নির্ধারণ করা। কোম্পানিভিত্তিক বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে থানা বা এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা নেয়া অপরিহার্য। যেমন গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা ইত্যাদি এলাকাগুলো অনেকটা পরিকল্পনা করে করা হয়েছে, তেমনি রাজধানীর অন্যান্য এলাকাগুলোও অনুরূপ পরিকল্পনা অনুযায়ী শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া দরকার। সেই সাথে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। অন্তত পক্ষে মানুষ যাতে ট্যাপকল খুলে নিশ্চিন্তে পানি পান করতে পারে, ঠিক মতো গ্যাস পায়, সড়কগুলো আবর্জনামুক্ত থাকে। ঢাকামুখী মানুষের ঢল কমাতে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো সেবামূলক খাতগুলোকে বড় বড় জেলা শহর নিদেনপক্ষে বিভাগীয় শহরগুলোতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল রাজধানীর ওপর এত চাপ রাখতে হবে কেন? ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো আর দুটি বিভাগীয় শহরে যদি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা যায়, তবে রাজধানীর উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কিছুটা হলেও কমবে। এছাড়া গার্মেন্ট শিল্পের মতো ব্যাপক কর্মসংস্থানমূলক শিল্প কারখানা রাজধানী থেকে সরিয়ে নেয়া উচিত। এ কথা মনে রাখা উচিত, রাজধানীতে কেবল দুয়েকটি নান্দনিক স্পট ও স্থাপনা তৈরি করলেই তা উন্নতির সূচক হয়ে উঠে না। উন্নতি করতে হলে নাগরিক সেবামূলক প্রতিটি সূচকে উন্নতি করতে হবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে এখনই সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষকে সজাগ ও সচেতন হয়ে সম্মিলিতভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।