Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আধুনিক গ্যাব্রোভোবাসী

র ও ন ক জা হা ন তা নি | প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

আধুনিক গ্যাব্রোভোবাসীর জীবনকথা রওনক জাহান তানি মনে আছে ক্লাস সিক্সের পাঠ্য বইয়ে পড়া মুহম্মদ এনামুল হকের সেই প্রবন্ধটির কথা, ‘গ্যাব্রোভোবাসীদের রস-রসিকতা’? সেই প্রবন্ধটি পড়েই গ্যাব্রোভো জাতি সম্পর্কে প্রথম ধারনা পেয়েছিলাম যে পৃথিবীতে এমনও এক জাতি আছে যারা জীবনের যেকোন দিক হাসিঠাট্টার মাধ্যমে খুব দ্রæত মেনে নিতে পারে। কিপটা হিসেবেও তাদের খ্যাতি কম না।কিন্তু এই কিপটামি ব্যাপারটা তাদের কৌতুকময় জীবনের সাথে এতো চমৎকার মানিয়ে গেছে যে এটা ছাড়া তাদের অসম্প‚র্ণই বলা চলে! তবে বলা বাহুল্য, গ্যাব্রোভোবাসীদের বোকা মনে করা কিন্তু খুবই ভুল। তারা অন্তত বুদ্ধিমান, এবং এই বুদ্ধির জোরেই তারা নিজেদের আজকে পরিণত করেছে অনেক ব্যতিক্রমধর্মী জাতিতে। নিজেদের হাসিঠাট্টায় পরিণত করার মাধ্যমে তারা মানুষকে যেমন আনন্দ দেয়, নিজেদেরাও তেমন আনন্দিত হয়। এরই মধ্যে পৃথিবীর গড়ংঃ এৎববহবংঃ ঈরঃু হিসেবে গ্যাব্রোভো খ্যাতি পেয়েছে, এবং পৃথিবীর অন্যতম বসবাস উপযোগী স্থান হিসেবে একে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিদিনের জটিল জীবন থেকে সহজ-সরল, নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুদিন হাসিঠাট্টার মধ্যে কাটিয়ে অনেকেই ফিরে যান নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে।অনেকেই একে পৃথিবীর অন্যতম “নিশ্চিন্ত” শহর বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ছোটবেলার বিরক্তিকর বাংলা বইয়ের সবচেয়ে প্রিয় লেখা ‘গ্যাব্রোভোবাসীদের রস-রসিকতা’ পড়ার পর থেকে গ্যাব্রোভো শহর সম্পর্কে জানার ইচ্ছা ছিলো প্রবল।জানার ইচ্ছে থেকেই নানান স‚ত্র ও বুলগেরিয়ার বাসিন্দা সম্পর্কে জানতে গিয়ে জানতে পারলাম গ্যাব্রোভোবাসী সম্পর্কে।বিশ্বে তাদের এই ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থানকে প্রকাশ করতে গর্ববোধ করে এবং তারা তাদের এই কৃপণতার প্রতীককে ঐতিহ্য হিসেবে মনে রাখাকে কর্তব্য বলে মনে করে। বলকান পর্বতমালার কোলের শহর গ্যাব্রোভো, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইয়ান্ত্রা(ণধহঃৎধ)নদী।বুলগেরিয়ার দীর্ঘতম শহর হচ্ছে গ্যাব্রোভো,যা প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার লম্বা।কিন্তু শহরের এমন অনেক জায়গাই আছে যেখানে প্রশস্ততা যেন কষ্ট করে এক কিলোমিটারে গিয়ে ঠেকেছে।২৩৩ বর্গ কিলোমিটার শহরটির আয়তন,প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় আড়াইশ লোকের বাস।আন্তর্জাতিক ভাবে স্যাটায়ারের শহর হিসেবেই এ শহরটি পরিচিত।গ্যাব্রোভোবাসীদের স্থানীয় ভাষায় নাম হলো গ্যাব্রোৎস্কি(এধনৎড়াঃংর)।এ শহরের গ্যাব্রোৎস্কিরা মানে প্রতিটি লোক হাসি তামাশায় ও কৃপণতায় পারদর্শী। আর এই হাসিঠাট্টা,কৃপণতা দিয়ে বিশ্বে আজ তারা ভিন্ন এক অবস্থানে আছে।তাদের জীবনযাত্রায় নিত্যকার ঘটনার মতোই কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি: * তারা তাদের গাধাগুলোকে সবুজ কাঁচের চশমা পরায়, যাতে গাধারা খড়কে ঘাস ভেবে ভুল করে খড়ই খায়। * তারা চুলের কলপ হিসেবে হাঁড়ির কালি এবং তেল হিসেবে স‚র্যমুখীর তেলের বোতলের ঢাকনা ব্যবহার করে। তাই তাদের এক বোতল তেল কখনোই ফুরায় না! *গ্যাব্রোভোবাসীরা বই পড়ার সময় অনবরত বাতি জ্বালাতে এবং নেভাতে থাকে! কারণ তারা নিশ্চিত করতে চায়, পাতা উল্টানোর সময় যাতে এক বিন্দু শক্তিও অপচয় না হয়। *তারা বিয়ার রাখার জন্যে বড় ড্রাম ব্যবহার করলেও পরিবেশন করার জন্যে ব্যবহার করে ডিমের খোলস। অর্থাৎ তারা নিশ্চিত হতে চায় যে পাছে নেশা ধরে আরও বেশি পান করে ফেলে কিনা! *ঘরের দরজা মেরামত করবার জন্য এক দৌড়ে পাশের বাড়ি থেকে ছেলেকে একটা হাতুড়ি নিয়ে আসতে বললো এক গ্যাব্রোভোবাসী। ছেলে পাশের বাড়িতে জিজ্ঞেস করলে তাকে মিথ্যে বলা হলো, কোনো হাতুড়ি নেই। ছেলে ফিরে এলে বাবা বললো, “কিপ্টের কিপ্টে লোকটা, জানতাম! থাক বাছা, চিলেকোঠা থেকে আমাদের হাতুড়িটাই নিয়ে আয় বরং! *চিমনি পরিষ্কারের ঝামেলায় গ্যাব্রোভোবাসীরা যায় না। তারা কী করে জানেন? তারা বরং তাদের বিড়াল চিমনিতে ফেলে দেয় যেন চিমনি পরিষ্কার হয়ে যায়। *গ্যাব্রোভোবাসীরা কেন ফ্রিজ কেনে না? কারণ, তারা নিশ্চিত হতে পারে না যে ফ্রিজের দরজা লাগালে আসলেই ভেতরের আলো নিভেছে। ভেতরের আলো তারা কেন অপচয় করবে? এ তো গেলো তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের দৃশ্য এছাড়াও তাদের আছে নিজস্ব কিছু কৃষ্টি-কালচার।শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গ্যাব্রোভোর সাংস্কৃতিক একটি কেন্দ্র হলো হাউজ অফ হিউমার অ্যান্ড স্যাটায়ার(ঐড়ঁংব ড়ভ ঐঁসড়ঁৎ ধহফ ঝধঃরৎব) বা রসরসিকতাবাস।এখানে আছে একটি জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি।এর ম‚ল বক্তব্য হলো,”পৃথিবী এখনো টিকে আছে কারন আজও পৃথিবী হাসে।আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শন হয়ে থাকে হাস্যভঙ্গিমার চিত্র,বিভিন্ন দেশের চিত্রশিল্পীদের আঁকা চিত্র,ছবি,পোস্টার, কার্নিভাল মুখোশ ও কস্টিউম।মিউজিয়ামের এক অংশে রয়েছে লাইব্রেরি, সেখানে রয়েছে ৩৫ টি ভাষার ১হাজার খÐের সাময়িকী ও প্রায় ২৫হাজার দেশি বিদেশি বই।মিউজিয়ামের বেশির ভাগ জিনিসই দানের।এ কেন্দ্রটি বানানো হয়েছে ১৯৭২ সালের ১ এপ্রিল পুরাতন ট্যানারির জায়গায়।হাউজ অফ হিউমার অ্যান্ড স্যাটায়ার মিউজিয়ামের প্রতীক হলো গোলাকৃতি পৃথিবীর উপর বিড়ালের চোখ আর কান,যার মানে হলো পৃথিবীর হাস্যরসগুলো শোনা ও দেখা হচ্ছে। এই বিড়ালের প্রতীক থাকার কারনও আছে গ্যাব্রোভো শহরের প্রতীক হলো লেজকাটা বিড়াল।লেজকাটা বিড়াল নিয়েও হাস্যরসাত্মক গল্পটি পড়েছিলাম সেই বইটাতে।সেটারই অংশ তুলে ধরছি: *“গ্যাব্রোভো শহরে শীতের দিনে বাজার থেকে কয়লা কিনে এনে ফায়ারপ্লেসে তা জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখতে হয়। এতে খরচের পরিমান খুব কম হয় না। একদিন এক গ্যাব্রোভোবাসী ভাবল, তার এ খরচ কমাতে হবে। কী করে তা করা যায়, তাই উদ্ভাবন করল সে। তার একটা একটা আদুরে বিড়াল ছিল। এর লেজটা ছিল বেশ মোটা এবং অনেক লম্বা। বেড়ালটিকে সত্যিই খুব সুন্দর দেখাতো। আর বাড়ির সবাই আদর যতœ করত। শীত আসার আগেই লোকটি একদিন তার আদুলে বেড়ালের লেজ কেটে দিল। সবাই চেঁচিয়ে উঠল : সর্বনাশ এ কি করলে? লোকটি বলল, উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই, বিড়ালটিকে আমরা আদর-যতœ করব ঠিকই।তবে, আসছে শীতে দরজা খুলে তাকে বাইরে নিতে আর আনতে ঘরের যেটুকু তাপ নষ্ট হতো তার অর্ধেক তাপ এখন থেকে বেঁচে যাবে। এরপর থেকেই লেজকাটা বেড়াল, গ্যাব্রোভোতে মিতব্যয়ীতা অর্থাৎ কার্পণ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে”। দরদাম করা
দরদাম করা আর ব্যবসার কাজে গ্যাব্রোভোর মানুষদের কোনো জুড়ি নেই।তাদের রসিকতা ব্যবহার করেই বরং তারা খদ্দের বাড়ান আর ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নত রাখেন।লোহা আর তাঁত দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে শহরের রসিকতার কাহিনীগুলোও ছড়িয়ে যেতে থাকে।অনেক ব্যবসায়ী গ্যাব্রভোতে ব্যবসা করতে আসতেন শুধু এই কারনে যে তাদের কাছ থেকে যাতে মিতব্যয়ীতা শিখতে পারেন।পাশাপাশি সেখানকার লোকদের চতুর ব্যবসা কৌশল সম্বন্ধেও তারা জ্ঞানলাভ করতেন।শোনা যায় হাসিমুখ ছাড়া নাকি গ্যাব্রোভোর অধিবাসীরা ব্যবসা করতেন না এবং ক্রেতাদের মুখেও একইভাবে হাসি দেখতে চাইতেন।তাদের ব্যবসায়িক চিত্র এই যে: *গ্যাব্রোভোবাসীরা নাকি এতই ব্যবসায় পারদর্শী যে দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তেই নতুন কোনো ব্যবসায়িক শিরোনাম আপনার চোখে পড়ুক না কেনো,সেটা নিশ্চিতভাবেই আগে থেকেই গ্যাব্রোবাসীরা করে ফেলেছে। *তারা সবচেয়ে বেশি ঘামায় অত্যন্ত উত্তপ্ত কামারশালায় এবং বাজারে; প্রথমটি তাপের জন্যে হলেও দ্বিতীয়টি জিনিসপত্র নিয়ে দরদাম করার জন্যে। এ কঠিন বাস্তবতার পৃথিবীতে এখনো হাস্যরসকে বুকে ধরে বেঁচে আছে বুলগেরিয়ার বুকে বলকান পর্বতমালার পাদদেশের গ্যাব্রোভো শহরটি!



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আধুনিক

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন