দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ইসলামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানব জাতির সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তি। আর রোযা আত্মিক ও আধ্যাত্বিক ইবাদত। ইসলামী পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী সংঘম থেকে বিরত থাকাকে সিয়াম বা রোযা বলে। রোযা আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও আত্মত্যাগের মনোভাব সৃষ্টি করে। রোযা মানুষে মানুষে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, হৃদ্যতা ও সৌজন্যবোধ আদান প্রদান করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নত গবেষণার ফলে বেরিয়ে আসছে রোযা রোগমুক্তির অন্যতম উপায়, সুস্থ্য হওয়ার গ্যারান্টি। সকল সক্ষম ঈমানদারদের উপর আল্লাহ রমজানের এক মাস রোজা ফরজ করেছেন। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের নিছক কষ্ট দেয়ার জন্যে ইহা ফরজ করেননি। তিনি এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন: তোমরা যদি রোযা রাখো তবে তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ, তোমরা যদি সেটা উপলব্ধি করতে পারো। তোমাদের মধ্যকার যে ব্যক্তি এ মাস (রমযান মাস) পাবে, সে যেন এ মাস ভরে সিয়াম পালন করে। অন্যত্র ইরশাদ করেন:হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মোত্তাকী হতে পারো। বস্তুত এ আয়াত সমুহে মহান আল্লাহ তায়ালা রোযা পালনের নানাবিধ কল্যাণের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দান করবো। কারণ, বান্দা আমার জন্য তার প্রবৃত্তিকে দমন করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে। রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মৃঘনাভীর সুগন্ধ অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর এবং রোযা ঢাল স্বরূপ। যখন রমযান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজা গুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজগুলো বন্ধ করা হয় আর শয়তানকে বেঁধে রাখা হয়। (সহীহ বুখারী)
রোযা হচ্ছে কম খাওয়ার প্রশিক্ষণ। কিন্তু রোযা ছাড়াও ইসলাম কম খাওয়াকে উৎসাহিত করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন: “পেট ভর্তি করে খাওয়া অপেক্ষা মানুষের জন্য মন্দ দ্বিতীয় কোনো কাজ নেই। আদম সন্তানের বেঁচে থাকার জন্য কয়েক লোকমা খাবারই যথেষ্ট। যদি তা না করে (অর্থাৎ বেশি খেতে চায়) তাহলে পেটের এক তৃতীয় অংশ খাবার, এক তৃতীয় অংশ পানি এবং অপর তৃতীয় অংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখা দরকার। মিসর সম্রাট মুকাউকাস মুসলমানদের চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসক পাঠান। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই বলে চিকিৎসককে ফেরত পাঠান, (কারো কারো মতে, এটা কোনো সাহাবী বা তাবেয়ীর বক্তব্য) : “আমরা এমন এক জাতি, যারা ক্ষুধা না লাগলে আহার করি না, আর খেলেও ক্ষুধা বাকী থাকতে আহার বর্জন করি। তাই আমাদের চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই।” এ বর্ণনা থেকে দেখা যায়, বাঁচার জন্য যেমন খাবার দরকার, অনুরোপভাবে বেশি খাদ্য রোগের ভান্ডার।(সীরাতে হালবীয়া)
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ গবেষণা করে উপরোক্ত আয়াতের সত্যতা প্রমাণ করেছেন। রোযার সকল হুকুম আহকাম স্বাস্থ্যরক্ষার দিকে লক্ষ্য রেখেই করা হয়েছে। যেমন-শিশু ও অতিবৃদ্ধের জন্যে রোজা ফরজ নয়। সফরে ও অসুস্থ অবস্থায় রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় বেশি কষ্ট না পাওয়ার জন্যে সেহরির ব্যবস্থা ইত্যাদি।
ইউরোপের ঘরে ঘরে ইদানিং রোযা রাখার হিড়িক পড়েছে। সবার মুখে এক কথা শরীরটাকে ভালো রাখতে চাও তো রোযা রাখো। এ ধরনের চেতনা সৃষ্টির পিছনে সত্তর দশকে প্রকাশিত একটি বই বিশেষতঃ দায়ী। প্রখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদ ড. হেলমুট লুটজানার-এর “The secret of successful fasting” নামক বইটিতে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণ করে নিরোগ, দীর্ঘজীবী, কর্মক্ষম স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরের কতিপয় দিন উপবাসের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন, The power and endurance of the boby under fasting Conditions are remarkable; After a fast properly taken the boby is literally bom afresh. অর্থাৎ রোযা রাখা অবস্থায় শরীরের ক্ষমতা ও সহ্যশক্তি উল্লেখযোগ্য: সঠিকভাবে রোযা পালনের পর শরীর প্রকৃতপক্ষে নতুন সজীবতা লাভ করে।” জার্মানির এক স্বাস্থ্য ক্লিনিকের গেইটে লেখা আছে, “রোযা রাখো স্বাস্থ্যবান হবে।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড নারায়ড বলেন, রোযা মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মূল করে দেয়। মানবদেহের আবর্তন-বিবর্তন আছে। কিন্তু রোযাদার ব্যক্তির শরীর বারংবার বাহ্যিক চাপ গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। রোযাদার ব্যক্তি দৈহিক খিচুনি এবং মানসিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয় না।
ড. লুটজানারের মতে, খাবারের উপাদান থেকে সারা বছর ধরে মানুষের শরীরে জমে থাকা কতিপয় বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিন), চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র সহজ ও স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে উপবাস। উপবাসের ফলে শরীরের অভ্যন্তরে দহনের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে শরীরের অভ্যন্তরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থসমূহ দগ্ধীভূত হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, ‘রমযান’ শব্দটি আরবীর ‘রময’ ধাতু থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ দহন করা, জ্বালিয়ে দেয়া ও পুঁড়িয়ে ফেলা। (চলবে)
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা; এমফিল গবেষক,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।