পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সিদ্ধান্ত করেছিলাম, এবার আর পাকিস্তানের ওপর লিখবো না। কারণ গত সপ্তাহেই এ বিষয়ে লিখেছি। কিন্তু শুক্রবার ইংরেজী দৈনিক ‘নিউ এজে’ একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ পড়লাম। বিশাল এই নিবন্ধ। একেবারে ৬ কলাম জুড়ে। ঐ উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে এমন কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে যা শুধু চাঞ্চল্যকরই নয়, ইতোপূর্বে অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি। আমি অনুভব করলাম, ইনকিলাবের সম্মানিত পাঠকদের কাছে ঐসব বিরল তথ্য পৌঁছে দেই। তবে দুই একটি জয়াগা আসতে পারে যেখানে মন্তব্য না করে পারা যাবে না। ]
বিশ্ববাসী জানে, ইমরানের অভিযোগ মোতাবেক তাকে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে নামানোর মূল কারিগর হলো আমেরিকা। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা যে চিরদিন ইমরান খানের চক্ষুশূল ছিল সেটি কোনোদিন গোপন করেননি ইমরান খান। অনাস্থা প্রস্তাবের ডামাডোলের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ২০ বছর আগে তিনি লন্ডন ছিলেন। ততদিনে তিনি পিটিআই বা পাকিস্তান তেহেরিকে ইনসাফ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। ২০ বছর আগে আমেরিকা যখন আফগানিস্তানে সর্বাত্মক হামলা করে, তখন তার সমর্থক এবং মার্কিন আগ্রাসন বিরোধী জনগণকে নিয়ে তিনি লন্ডনস্থ মার্কিন দূতাবাসের সামনে প্রবল বিক্ষোভ করেন। এরপর ২১ বছর পার হয়ে গেছে। ইমরান খান পশ্চিমা বিশেষ করে মার্কিন বিরোধী ভূমিকায় অবিচল আছেন। একদিনের জন্যও তিনি এই ভূমিকা থেকে টলেননি। রাজনীতিতে এটি ছিল তাঁর আদর্শিক অবস্থান। আজও সেই অবস্থানে তিনি অটল আছেন।
ইনকিলাবের পাঠকদের, বিশেষ করে প্রবীণ পাঠকদের মনে থাকার কথা, ৯/১১ কে কেন্দ্র করে আফগাানিস্তান আক্রমণ করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে কি ভয়ঙ্কর হুমকি দিয়েছিল। ঐ ধরণের হুমকি শুনলে রক্ত হিম হয়ে যায়।
তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানে পাকিস্তানের সক্রিয় সহযোগিতা আদায় করার জন্য প্রেসিডেন্ট বুশ তাঁর উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড আর্মিটেজকে পাকিস্তান পাঠান। মি. আর্মিটেজ পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল মাহমুদ আহমদকে বলেন, এই হামলায় পাকিস্তান যেন আমেরিকাকে সহযোগিতা করে। জেনারেল মাহমুদ বলেন যে, এই যুদ্ধে পাকিস্তান নিরপেক্ষ থকাতে চায়। তখন মার্কিন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং ক্রুদ্ধস্বরে বলেন, Be prepared to be bombed. Be prepared to go back to the stone age. অর্থাৎ ‘আপনার দেশে বোমা হামলার জন্য প্রস্তুত হোন। প্রস্তর যুগে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন।’ এর আগে আর্মিটেজ বলেন, Pakistan would need to be with us or against us. For Americans this was seen as black or white. অর্থাৎ, ‘পাকিস্তানকে হয় আমাদের পক্ষে থাকতে হবে, না হয় বিপক্ষে। মার্কিনীদের জন্য এটা দেখা হবে হয় সাদা না হয় কালো।’ অর্থাৎ এর কোনো বিকল্প নাই। প্রেসিডেন্ট মোশাররফ বলেন, এটি ছিল অত্যন্ত বড় একটি আঘাত। এমন পরিস্থিতিতে একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে মাথা ঠান্ডা রেখে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এবং আমি সেটাই করেছি।
॥দুই॥
আমরা এখন ইমরানের বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্রের কথায় ফিরে আসছি। নিউ এজের রিপোর্ট মোতাবেক ১০ এপ্রিল ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির বেশ কয়েকদিন আগে ওয়াশিংটনে দুই প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়। তারা নিজেদেরকে মার্কিন ফেডারেল সিকিউরিটি অফিসার হিসাবে পরিচয় দিয়ে আসছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিরাপত্তা বাহিনীর সাথেও তারা সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছিল। এই দুই ব্যক্তির নাম আরিয়ান তাহেরজাদে এবং হায়দার আলী। এদের গ্রেফতারের খবর ৮ এপ্রিল লন্ডনের ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট থেকে এদেরকে মুক্তি না দেওয়ার জন্য বলা হয়। ওয়াশিংটন ডিসির কয়েকটি ফ্ল্যাট থেকে বেশ কিছু অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। অন্যতম আটক হায়দার আলী বলেন যে, পাকিস্তানের মিলিটারী গোয়েন্দা সার্ভিস আইএসআইয়ের সাথে তার যোগাযোগ আছে। এদের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সিক্রেট সার্ভিস আরও ৪ জনকে সাসপেন্ড করে।
নিউ এজের ঐ নিবন্ধে বলা হয় যে, পাকিস্তানকে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র (Rogue state) হিসাবে ঘোষণার পরিকল্পনা চলছিল। বলা হতো যে, দেশটি আমেরিকার বিরুদ্ধে নাশকতামূলক তৎপরতার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। কিন্তু ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের সুর নরম হয়ে যায়। আটক ব্যক্তিদেরকে জামিন দেওয়া হয় এবং গৃহবন্দী হিসাবে রাখা হয়। ১১ এপ্রিল সিএনএনের রিপোর্ট মোতাবেক বিচারক মাইকেল হার্ভে আটক ব্যক্তিরা ‘বিপজ্জনক’, এমন অভিযোগের জন্য জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের তীব্র সমালোচনা করেন।
এরপর নিউ এজে পরিবেশন করা হয়েছে সেই চাঞ্চল্যকর সংবাদ। ঐ সংবাদে বলা হয়েছে যে, ইউক্রেন আক্রমণের পূর্বাহ্নে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইমরান খানের রাশিয়া সফরের সময় জ্বালানি ও কৃষিখাতে অনেকগুলো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর ছাড়াও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য প্রদানের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবিত সামরিক সাহায্যের মধ্যে রয়েছে এস-৩০০ বিমান ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, মার্কিন এফ-১৬ জঙ্গী বিমানের পরিবর্তে সুখয় সিরিজের (এসইউ) সর্বাধুনিক জঙ্গী বিমান এবং অন্যান্য সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র। বিনিময়ে পাকিস্তানকে ওয়াশিংটনের ওপর থেকে সামরিক নির্ভরতা কমাতে হবে এবং রাশিয়ার সাথে সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
২০ বছর আগে ওয়াশিংটন আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায়। এটি ছিল বীর আফগানদের আশা আকাঙ্খার সম্পূর্ণ বিরোধী। পাকিস্তান এবং রাশিয়ার ব্যাক ইয়ার্ডে (আফগানিস্তানে) মার্কিন সমারিক উপস্থিতি পাকিস্তান এবং রাশিয়ার দূরত্ব হ্রাস করে। মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বীর আফগানরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এই গেরিলা যুদ্ধে মার্কিনীরা যতই মার খেতে থাকে ততই তারা এই অভিযোগে সোচ্চার হয় যে, পাকিস্তানের সমর্থনের জন্যই মার্কিনীরা আফগান যুদ্ধে সাফল্য পাচ্ছে না। মার্কিন অভিযোগ যতই সোচ্চার হয় ততই পাক-রুশ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব বজায় রাখার পরেও যখন আফগানিস্তানে আমেরিকার গ্লানিকর পরাজয় ঘটে তখন এই পরাজয়ের দায় তারা পাকিস্তানের ওপর বিশেষ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ওপর চাপায়। এই গ্লানিকর পশ্চাদোপসারণের কারণে খোদ আমেরিকাতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জনপ্রিয়তায় বিপুল ধ্বস নামে। এই ঘটনা ঘটে গত বছরের অগাস্ট মাসে। তখনই বাইডেন প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় যে, ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। আর তখন থেকেই মার্কিনীরা শুরু করে পাকিস্তানে রেজিম চেঞ্জের কাজ।
॥তিন॥
২০ বছরের মার্কিন দখলদারিত্বের সময় তালেবান যোদ্ধাদের অবস্থা ছিল অনেকটা ‘ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দারের’ মতো। ২০০১ সালের শেষ প্রান্তিক থেকে ২০২১ সালের অগাস্ট- এই ২০ বছর তালেবানদের পেছনে একটি বিদেশী রাষ্ট্রেরও সমর্থন ছিল না। তারা সোভিয়েটদের ফেলে যাওয়া একে-৪৭ বা কালাশনিকভ রাইফেল দিয়েই ২০ বছর ধরে আমেরিকানদের মোকাবেলা করেছে। ‘আমেরিকা বিশ্বের ১নং শক্তি’, ‘আমেরিকা একমাত্র পরাশক্তি’- বিনা যুদ্ধে তালেবানের সমগ্র আফগানিস্তান দখল আমেরিকার এই ‘মিথ’ বা ভাবমূর্তিকে চূরমার করে দিয়েছে।
ইমরান খানের প্রচন্ড মার্কিন বিরোধী অবস্থান কোনো সুবিধাবাদী বা জনতুষ্টিবাদী (Populist) অবস্থান নয়। তিনি দেখেছেন আমেরিকা ও পশ্চিমের ইসলামোফোবিয়া, অর্থাৎ ইসলামী সন্ত্রাসের কাল্পনিক জুজু। তিনি দেখেছেন ইরাকে হামলা, দেখেছেন লিবিয়ায় পশ্চিমা আগ্রাসন, দেখেছেন সিরিয়া হামলা- সর্বোপরি আফগানিস্তান দখল। একজন অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েট হিসাবে এসব মুসলিম বিরোধী আগ্রাসন তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছে। তাই তাঁর কণ্ঠ দিয়ে পশ্চিমা বিশেষ করে মার্কিনীদের বিরুদ্ধে আগুন ঝরে। এটা শুধু প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর পর নয়, রাজনীতিতে তিনি নেমেছেনই মার্কিন বিরোধী রেটোরিক নিয়ে। বুদ্ধিবৃত্তি (Intellectualism) এবং মেঠো বক্তার (Demagoguery) এর অপূর্ব সংমিশ্রণ তিনি।
ইমরানের নিকট থেকে মার্কিন ডিপ স্টেট (Deep state) প্রধানমন্ত্রীত্ব ছিনিয়ে নিল কেন? নিল, কারণ ইমরানকেও তারা মরহুম জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো Liability বা বোঝা মনে করেছিল। তাই তারা ভুট্টোকে যেমন ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, ইমরানকেও তেমনি ঝেড়ে ফেলে দিতে চায়। তবে সব ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার পদ্ধতি সব সময় এক হয় না। প্রসাদ ষড়যন্ত্র এক এক ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। ইমরানের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে হয়েছে এমএনএদের হর্স ট্রেডিং বা কেনাবেচা দিয়ে। কিন্তু ইমরান কি এখানেই শেষ?
মনে হচ্ছে না। কারণ ইতোমধ্যেই এটা প্রকাশিত হয়েছে যে, আমেরিকার চাপে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সাইড চেঞ্জ করেছে। আবার সেনাবাহিনীর চাপে উচ্চ আদালতও ঘুরে গেছে।
ঐদিকে ক্ষমতা হারানোর পর ইমরান খান অগণতান্ত্রিক পথে যাননি। তিনি নালিশ জানিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালতের কাছে, অর্থাৎ জনতার কাছে। জনগণও তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। বিগত ১৫ দিনে তিনি ৪ টি জনসভা করেছেন। ইসলামাবাদ, পেশওয়ার, করাচি এবং লাহোর- প্রতিটি জনসভাতেই লক্ষ লক্ষ মানুষ হাজির হয়েছে। এখন ইমরান খানের একটিই দাবী। অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচন চাই। ইমরান কনফিডেন্ট এবং আমরাও জনসভাগুলোর ভিডিও ক্লিপ দেখে বুঝতে পারি, খাইবার পাখতুন খোয়া, পাঞ্জাব এবং সিন্ধুতে তিনি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন।
কিন্তু সেটা কি মার্কিন ও সেনাচক্র হতে দেবে? হতে না দিলে পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে। রাজনীতির অভিজ্ঞ ও প্রবীণ বিশ্লেষকরা সেই ভয়াবহ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করছেন। অনিশ্চয়তার কুয়াশা কাটবে আরো কয়েক মাস পর।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।