পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের মানুষ কি দিন দিন চিরায়ত কৃষ্টি, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ ও অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন এখন খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারণ দেশের বিভিন্ন জনপদে একের পর এক যেসব অনৈতিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে, সেসব ঘটনা কোনোভাবেই আমাদের দেশের মানুষের আচার-আচরণের সঙ্গে মেলে না। আমাদের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, আদব-কায়দা ও মায়া-মমতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করা। পরিচিত হোক আর অপরিচিত হোক, একের দুঃখে অপরের দুঃখিত হওয়া, সহমর্মীতা প্রকাশ করা, পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত¦না দেয়া। তরুণদের কেউ বেয়াদবির পথে ধাবিত হলে, তাকে বারণ করা। সমাজে অসঙ্গতি দেখা দিলে, সামাজিকভাবে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া, এমনকি পারিবারিক কলহ মিটাতেও এগিয়ে আসা। বাংলাদেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য তো এই যে, তারা সমাজ ও পরিবারে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সবসময়ই সচেতন। এমনকি অতিথিপরায়ণতার দিক থেকেও অতুলনীয় বৈশিষ্টের অধিকারী। আগে গাঁয়ের পথ ধরে কোনো তৃষ্ণার্ত পথিক যদি কোনো বাড়িতে গিয়ে এক গøাস পানি চাইত, দেখা যেত শুধু এক গøাস পানি নয়, সঙ্গে একবাটি মুড়ি-মিঠাই দেয়া হতো। এখনো এ চিত্র লক্ষ করা যায়। চেনা নেই জানা নেই, এমন ব্যক্তিকে অতিথি ভাবার মতো এমন মানুষ কি দুনিয়ার আর কোথাও আছে? দেড়-দুই দশক আগেও যে দুয়েকটি অকল্পনীয় ঘটনা ঘটত, সেগুলো তোলপাড় সৃষ্টি করলেও বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য করা হতো। কারণ এ ধরনের ঘটনা কালেভদ্রে ঘটত। এখন যেসব সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধমূলক ঘটনা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এগুলোকে আর বিচ্ছিন্ন বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। একটি ঘটনা ঘটছে তো এ ধারাবাহিকতায় আরেকটি ঘটনা এসে হাজির হচ্ছে। এর কারণ কি? এর অন্যতম কারণ যদি ধরা হয় অর্থ এবং এর প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণ, তবে এ কথাও তো বলা যায়, অর্থের টানাপড়েনের মধ্যে এ দেশের মানুষ যুগযুগ ধরেই ছিল, সে সময়ও মানুষ তার নৈতিক চরিত্র হারায়নি। অভাবের মধ্যেও তার নীতি-নৈতিকতা অটুট ছিল। বলাবাহুল্য, জীবনে অর্থের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। তবে অর্থ রোজগার করতে গিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে জোরজবরদস্তির পথ বেছে নেয়া কি আমাদের দেশের মানুষের চিরায়ত চারিত্রিক বৈশিষ্টের সঙ্গে মেলে? আমরা এখন এমন এক সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মান-সম্মান-ইজ্জতকে কেউ আর তোয়াক্কা করছে না। অনেকের মধ্যে এমন একটা প্রবণতা বিরাজমান, ভাল মানুষ না হলেও অর্থ-বিত্তের মালিক হতে পারলে মান-সম্মান কেনা যাবে। এর নজিরও কম নয়। দেখা যাচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীই সমাজের নিয়ন্তা হয়ে বসে আছে। তাদের অর্থ আছে, পেশীশক্তিও আছে। তারা মনে করে, এই দুই শক্তি থাকলে মান-সম্মান এমনিতেই তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়বে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা সম্মিলিতভাবেই এদের অবস্থানকে শক্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছি। আমাদের মধ্যে যাদের এখনও একটু-আধটু সুকুমারবৃত্তি রয়েছে, তারা কোনোভাবেই এক হতে পারছি না। একেক জন যেন আলাদা হয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী হয়ে বসবাস করছি। কে মরল আর কে মারল, এ নিয়ে টু শব্দ করি না। কিভাবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হয়, তা জেনেও উদ্যোগী হই না। আমাদের দুর্বলতার এ সুযোগটাই নিচ্ছে সমাজের মাথা হয়ে থাকা দুষ্টচক্র। শুধু সমাজের এই দুষ্টচক্র নয়, রাজনীতি থেকে রাষ্ট্র পরিচালকরাও এ সুযোগ নিচ্ছে। তারা জানে, হুমকি-ধমকি দিয়ে আমাদের ভীত করতে না পারলে কোনোভাবেই তাদের দুষ্কর্মের রাজত্ব কায়েম করতে পারবে না। আর আমরাও আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ প্রাধান্য না দিয়ে ভীতিসৃষ্টিকারীদের হুমকি মেনে নিচ্ছি।
দুই.
পরিবার ও সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রাতারাতি ঘটে না। আবার সামাজিক নীতি-নৈতিকতা ধরে রেখে সময়কে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়াও হঠাৎ করে হয় না। দশকের দশক ধরে এর পরিবর্তন হয়। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অটুট রেখে পরিবর্তিত সময়কে ধারণ করা হচ্ছে কিনা, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সভ্যতার দিকে ধাবিত হওয়া। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের যে বিবর্তন, তা সভ্য হওয়ারই ধারাবাহিকতা। এই সভ্য হতে গিয়ে মানুষ ভাল-মন্দ দুটো পথের দিকেই এগিয়ে চলেছে। দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষই ভাল পথের পথিক হয়েছে। সমাজ গঠনে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধসম্পন্ন মানবিক গুণাবলি প্রতিষ্ঠা করেছে। যুথবদ্ধ সমাজ গড়ে তুলেছে এবং তাদেরই আধিপত্য স্থাপিত হয়েছে। তারাই সমাজকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং দিয়ে আসছে। বলা হচ্ছে, এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসে প্রযুক্তি মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের মধ্যেই স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর হওয়ার প্রবল ইচ্ছা শক্তি জেগেছে। তাদের গতি এতটাই বেড়েছে যে, পারিবারিক ও সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধ এমনকি ধর্মীয় অনুশাসন এই গতির কাছে হার মানছে। পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এসব গুণাবলীর দিকে তাকানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না। যার ফলে আমাদের দেশের মতো আবহমান কাল ধরে চলে আসা রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা এবং সামাজিক যে বন্ধন, তা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে পড়ছে। শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের এই উদাসীনতার সুযোগ নিচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে মাইনর অথচ ভয়ংকর দুর্বৃত্ত শ্রেণী। তারা প্রাধান্য বিস্তার করছে, একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, যার শিকার হচ্ছে, উদাসীন হওয়া সুশীল ও সচেতন শ্রেণী। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। কয়েক দিন আগে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তার সাথে আলাপ হচ্ছিল। ভদ্রলোক বিয়ে ও ডিভোর্স সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখাশোনা করেন। গুলশান-বনানী-উত্তরার মতো অভিজাত এলাকার বিয়ে বিচ্ছেদের যে তথ্য তিনি দিলেন, তা রীতিমতো চমকে উঠার মতো। তার তথ্যানুযায়ী, এসব অভিজাত এলাকা থেকে মাসে গড়ে প্রায় তিন হাজারের মতো ডিভোর্সের আবেদন করা হচ্ছে। আর একটু কম অভিজাত এলাকায় এই হার গড়ে এক হাজার। পুরুষের চেয়ে নারীরাই ডিভোর্সের আবেদন করছে বেশি। ওই কর্মকর্তার মতে, অভিজাত এলাকায় ডিভোর্সের হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ নারীদের মধ্যে অধিকমাত্রায় স্বনির্ভর হওয়ার প্রবণতা। এছাড়া নীতি-নৈতিকতার স্থান দুর্বল হয়ে যাওয়া, পুরুষদের মধ্যে সমকামিতা ও চরিত্রহীনতা বৃদ্ধি এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে নারী-পুরুষের যোগাযোগ স্থাপন, বিয়ে ও অবশেষে প্রতারণার শিকার হওয়া। বলাবাহুল্য, এসবের পেছনে মূল কারণ সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে ধস নামা। শুধু অভিজাত এলাকাই নয়, দেশের সামগ্রিক পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থায়ও মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। কেউ কেউ বলছেন, অনেকটা পচন ধরেছে। এ ধরনের কথাবার্তা একেবারে অমূলক বা উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। পুলিশের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন পারিবারিক কলহের জের ধরে গড়ে খুন হচ্ছে ১৩ জন। প্রতিদিন আত্মহত্যা করছে ২৯ জন। পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে যেসব খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে, এসব অপরাধের ধরণ ও পেছনের কারণ হিসেবে সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথাই উঠে আসছে। সমাজবিদরাও বলছেন, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। যান্ত্রিক জীবনে বাড়ছে অস্থিরতা ও হতাশা। অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে মানুষ। শহরাঞ্চল ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে পারিবারিক অপরাধের মাত্রা বেশি। এসব ক্ষেত্রে ভিনদেশি বিশেষ করে ভারতীয় টেলিভিশন সিরিয়ালের বিকৃত গল্প, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব দায়ী। এছাড়া অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পরকীয়া সম্পর্ক, মাদকাসক্তি, আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা, অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব মানুষের মূল্যবোধকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এ কথাও বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে সংহতি ও বন্ধন আলগা হয়ে যাওয়ায় মারাত্মক অপরাধের ঘটনা ঘটছে। তা নাহলে একজন পিতা বা মাতা তার সন্তানকে খুন করতে পারে না। সন্তান পিতা-মাতাকে খুন করতে পারে না। এ ধরনের ঘটনা কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
তিন.
সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ ধরে রাখার মূল নিয়ামক শক্তি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় যদি গলদ থাকে, তবে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সর্বত্র পড়তে বাধ্য। সুশাসন থাকলে তার ফলাফল পরিবার ও সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। যারা শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, তারা যদি বলেন, বাড়ির বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়, তাহলে তো অপরাধীদের বেডরুমে প্রবেশ করে মহাউল্লাসে নাচার কথা। তা তারা করছেও। কোনো নাগরিকই প্রত্যাশা করে না তার বেডরুম সরকার পাহারা দিক। তার প্রয়োজনও নেই, যদি সরকার ঘরের বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঘরের বাইরেই তো মানুষকে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। তাদের স্বাভাবিক চলাচল ও নিরাপত্তা নাজুক হয়ে পড়েছে। বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। তাহলে মানুষ কেন নিরাপদ বোধ করছে না? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জননিরাত্তা বিধান করবে, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই খুন, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, বিনা কারণে মানুষকে হয়রানি, আটকে রেখে অর্থ আদায়, থানায় নিয়ে নির্যাতনের মতো মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পর্যন্ত তাদের হয়রানি থেকে বাদ যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ এমন হলে তাদেরকে যদি বেডরুম পাহারা দিতেও দেয়া হয়, তাতেও মানুষ নিরাপদ বোধ করবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাষ্ট্র যখন পুলিশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয় দেশে, তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার, কথাবার্তা ও আচার-আচরণে তার প্রমাণও পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শাসক শ্রেণীর রক্ষাকবচ হয়ে উঠে। শাসক ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে চলে যায়। বেষ্টনির বাইরে যে বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে, তারা অনেকটা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য তাদের প্রতি অবিচার করলেও, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ তাদের মধ্যে এ ধারণা জন্মায়, আমরা সরকার টিকিয়ে রেখেছি। কাজেই আমাদের বিচার করবে কে? এ ধরনের প্রবণতা সেসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের মধ্যে দেখা যায়, যারা দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন করে। দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্য দেখে এবং অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেয়া হয়। এমন কথাও শোনা যায়, কোনো কোনো ওসি বাণিজ্যিক এলাকা বা অপরাধ প্রবণ এলাকা বা তার কাক্সিক্ষত থানায় ট্রান্সফার হওয়ার জন্য কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করেন। এ যদি হয় পরিস্থিতি তাহলে যিনি কোটি টাকা খরচ করে কাঙ্খিত থানায় পোস্টিং পেলেন, তার দ্বারা কি সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? তিনি তো খরচ করা কোটি টাকা তুলে লাভ করার দিকেই বেশি মনোযোগী হবেন। এ কথা এখন প্রচলিত, যে থানায় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বেশি এবং অপরাধপ্রবণ সেখানে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার আয়ও বেশি। এ ধরনের কিছু পুলিশ সদস্যর কারণে পুলিশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। জনসাধারণের কাছে পুরো বাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা সৎ এবং প্রকৃতই জনসাধারণের বন্ধু হতে চান, সেসব পুলিশ সদস্য স্বীকার করছেন, রাজনৈতিক কারণে এবং কিছু পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষমতার অপব্যবহারে মানুষ অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এসব কর্মকর্তার উচ্চমহলে যোগাযোগ থাকায় অনেক সময় শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। তারা চেইন অফ কমান্ড মানেন না।
চার.
জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সঠিকপথে পরিচালিত করার লক্ষ্যেই মানুষ নিজস্বার্থে মানবিক গুণাবলী অর্জন করেছে। তা নাহলে মানুষ সেই আদিম যুগেই পড়ে থাকত, আজকের সভ্যযুগে বসবাস করত না। আইনের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে হয়তো দৃষ্টান্ত স্থাপন ও অন্যদের সতর্ক করা সম্ভব। তবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে শোধরানো সম্ভব নয়। এজন্য পরিবার ও সমাজের মহৎ ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত। পরিবার ঠিক থাকলে সমাজে তার প্রতিফলন ঘটে। পরিবারের অভিভাবক শ্রেণীকেই এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিবারের নবীণ সদস্যদের আচার-আচরণ ও চলাফেরার দিকে তী² নজর রাখতে হবে। তাদের সামনে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধের চেতনাগুলো তুলে ধরতে হবে। পাড়া-মহল্লায় প্রভাবশালীদের নিজ নিজ এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে উদ্যোগী হতে হবে। প্রয়োজনে অপকর্মে লিপ্তদের পরিবারের অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। জুম্মার নামাজের সময় মসজিদের ইমামদের এ ব্যাপারে বয়ান দিতে হবে। এখন আমরা এমন এক সময় অতিক্রম করছি, কেউ ধর্মীয় কথা বললে তাকে বক্রদৃষ্টিতে দেখা হয়। কেউ কথা বলা থামিয়ে দেয়। অথচ সারা বিশ্বেই এখন মানুষ স্ব স্ব ধর্মের প্রতি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকছে। এমনকি উন্নত বিশ্বের সিনেমাগুলোও ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করছে। এর মূল অর্থই হচ্ছে, মানুষকে মানবিক করে তোলা। আমাদের দেশ নিশ্চয়ই তাদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত নয়। তবে আমরা যে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধ থেকে তাদের চেয়ে এগিয়ে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণী, যারা সোস্যাল মিডিয়া নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকে, যার কারণে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সেই তাদেরকেই দেখা গেছে, ভূমিকম্পের সময় অসহায় হয়ে পড়তে। অনেককেই দেখা গেছে, ধর্মীয় কথাবার্তা লিখে এবং অন্যকেও ধর্মীয় আচার-আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে লেখালেখি করেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা সাময়িক মোহে ধর্মীয় অনুশাসন বিস্মৃত হলেও, ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে ধর্মের কাছেই আত্মসমর্পণ করছে। তাদের এই বিস্মৃতপ্রায় ধর্মীয় শাসন-বারণকে জাগিয়ে তুলতে পরিবার ও সমাজের অভিভাবকদের ভূমিকা রাখতে হবে। তা নাহলে আত্মহত্যা, পরিবারের সদস্যদের খুনের মতো মহাঅপরাধ কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের কাছ থেকে অপরাধীর প্রতি কঠোর ও সাধারণ মানুষের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ কাম্য। সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শুধু অপরাধ বা অপরাধীদের ধরণ নিয়ে গবেষণা করলে চলবে না। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবর্তন কিভাবে হচ্ছে, কোন দিকে ধাবিত, এসব বিষয় নিয়েও গবেষণা করতে হবে। দলীয় আনুগত্যর দিকে না তাকিয়ে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিকে তাকাতে হবে। অপরাধীর ক্ষমতার উৎসের কথা বিবেচনা না করে অপরাধীর অপরাধকে আমলে নিতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।