পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিএনপি, ২০ দলীয় জোট এবং ঐক্যফ্রন্ট ইলেকশনে অবতীর্ণ হয়েছে। সারাদেশের মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের তিনটি পথ খোলা রয়েছে। একটি হলো বিপ্লব। দ্বিতীয়টি হলো গণঅভ্যুত্থান। তৃতীয়টি হলো নির্বাচন। দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্যকোনো দেশের পরিস্থিতি বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের অনুকূল নয়। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই গণতন্ত্র বিদ্যমান। বাংলাদেশে সেই গণতন্ত্র হয়েছে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের ওপর চাপিয়ে দেয়া নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটাতে গেলে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সে কারণেই ২০ দলীয় জোট, ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপির দাবি দাওয়ার পেছনে বিপুল জনসমর্থন সত্তে¡ও নির্বাচনের পথকে বেছে নিয়েছে। বিএনপি এবং তার রাজনৈতিক মিত্রসমূহ বিশুদ্ধ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তারা অহিংস এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী।
গণতন্ত্রের স্বার্থে, বাক-স্বাধীনতার স্বার্থে, মতামত প্রকাশের স্বার্থে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে অনেক ছাড় দিয়ে বিএনপি, ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো সময়ই চায়নি, বিএনপি তথা বিরোধী দলীয় জোটসমূহ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনে তারা ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছিলো। এবারো তারা সেটাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বারবার ঘোষণা করেছেন যে, তারা এবার আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার দেবেন না। সেই ঘোষণা মোতাবেক, ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের এই সিদ্ধান্তের ফলে আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়েছে। না পারছে তারা ফেলতে, না পারছে তারা গিলতে। এখনো তারা চাচ্ছে আপদ বিদায় হোক। সেদিন নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে যা ঘটলো, সেটি একথার সত্যতা বহন করে। পুলিশ বিএনপির সমাবেশে লাঠিচার্জ করে ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। অন্তত ৫০ জন বিএনপি কর্মী ও সমর্থক আহত হয়। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো এই যে, পুলিশের নাকের ডগার ওপর দিয়ে পুলিশের দুইটি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অথচ পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। টেলিভিশনে দেখা গেল, দীর্ঘ সময় ধরে ওই আগুন জ্বলছে। অথচ সে আগুন নেভানোর কোনো প্রচেষ্টা নেই। উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার। তারা জনগণকে দেখাতে চেয়েছিল যে, বিএনপির ছেলেপেলেরা আগুন লাগিয়েছে। অর্থাৎ তারা ২০১৫ সালের মতো আবার অগ্নিসন্ত্রাস করছে। নির্বাচনের বর্তমান পর্যায়ে পুলিশের এই আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, যেদিন থেকে তফসিল ঘোষিত হয়েছে সেদিন থেকে পুলিশ সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের অধীনে। আলোচ্য ক্ষেত্রে পুলিশ সম আচরণ করেনি।
বিগত তিন-চার বছর হলো বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট লেভেল প্লেয়িইং ফিল্ডের জন্য তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। বরং তিন-চার বছর আগে থেকেই বিরোধী দলসমূহের ওপর জুলুমের ষ্টিম রোলার চালাচ্ছে সরকার। এটি আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিগত চার বছর ধরে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে রাস্তায় নামতে দেয়া হয়নি। এটা যেমন ঢাকা মহানগরীসহ বড় বড় বিভাগীয় শহরে হচ্ছে, তেমনি তৃণমূল পর্যায়েও সেটি ঘটছে। সকলেই জানেন যে, বিএনপির হাজার হাজার কর্মী কারাগারে রয়েছে। হাজার হাজার কর্মী হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। লাখ লাখ কর্মীর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়। বিএনপির একটি ধারণা ছিল এই যে, নির্বাচন আসন্ন হলে হয়তো ধরপাকড় এবং জেল-জুলুমের অবসান হবে। কিন্তু নির্বাচন যতই এগোতে থাকে, জুলুমের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে।
দুই
বিএনপি তখন ভেবেছিল যে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করলে হয়তো রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অবসান হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, তফসিল ঘোষণার পরেও দমন-পীড়নের কোনো অবসান হয়নি। বরং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর ৪৭২ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি। বিএনপির গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বরাবর জমা দিয়েছে বিএনপি। দলটির কেন্দ্রীয় মামলা তথ্য সংগ্রহকারী কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দিন খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে (ইসি) গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের তালিকা ও সিইসি বরাবর একটি চিঠি জমা দেন। বিএনটি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ৮ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এবং আশপাশের এলাকাসহ সারাদেশ থেকে দলের ৪৭২ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই মর্মে ৫টি এজাহারও পাওয়া গেছে। গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের পদ তালিকা জমা দেয়া হলো। পরবর্তীতে আরও পাওয়া গেলে সেগুলোও জমা দেওয়া হবে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেয়া ‘বানোয়াট মামলা’ প্রত্যাহারসহ নিঃশর্ত মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপও কামনা করেন মির্জা ফখরুল। এর আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ১৪ নভেম্বর বুধবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচন কমিশন বলেছিল, তফসিলের পর যদি নেতাকর্মীদের গ্রফতার করা হয়, তাহলে নাম-পদবিসহ সেটার তালিকা দেওয়ার জন্য। তালিকা দেখে হয়রানিমূলক মামলা বা গ্রেফতার করা হলে ব্যবস্থা নেবে ইসি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইসিতে তফসিলের পর গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের নাম-পদবীসহ তালিকা জমা দিল বিএনপি। তফসিল ঘোষণার পর ৪৭২ জন অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৫০ ব্যক্তির গ্রেফতার সহজ কথা নয়। প্রতিদিন ৫০ ব্যক্তি গ্রেফতার হচ্ছে, সে গ্রেফতার ১০ দিন ধরে চলছে, তার পরও ইলেকশন কমিশন নির্বিকার। এটি কি কল্পনা করা যায়? এটি কোন টাইপের ইলেকশন?
নির্বাচন কমিশন স্বয়ং যদি পক্ষপাতমূলক আচরণ তাহলে সে নির্বাচন কোনো সময় সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। বিএনপির সামনে যে ঘটনা ঘটেছে সেখানে কোনো রক্তপাত হয়নি, কোনো প্রাণহানী ও ঘটেনি। অথচ তারপরও ৪৮৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় এবং ৩৮ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়। অথচ গত ১০ নভেম্বর শনিবার আদাবর থানায় আওয়ামী লীগের উপদলীয় কোন্দলে দুই ব্যক্তি নিহত হলে পুলিশ যুবলীগের আহ্বায়ক আরিফুর রহমান তুহিনকে গ্রেফতার করে। ওই জোড়া হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই মুকুল রঞ্জন ১১ নভেম্বর রোববার দুপুরে আদাবর থানা যুবলীগের আহবায়ক তুহিনকে পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠান। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে তুহিনকে আদালতে হাজিরও করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারী আসামির রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর করে জামিনের আদেশ দেন।
এরপর নরসিংদীর বাঁশখালীতে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষ টোটা বন্দুক ব্যবহার করে। এই সংঘর্ষে চার ব্যক্তি নিহত হয়। লক্ষ করার বিষয় হলো এই যে, ঢাকার আদাবর এবং নরসিংদীর বাঁশখালীতে সংঘর্ষে যে ৬ ব্যক্তি নিহত হয়েছে সে সংঘর্ষটি ছিল আওয়ামী লীগের দুইটি উপদলের। ঢাকার সংঘর্ষ ছিল আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আরেকজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সাদেক খানের মধ্যে। ৬টি প্রাণ ঝরে গেল, কিন্তু কোনো গ্রেফতার নেই, কোনো রিমান্ড নেই। বরং অন্যতম যে আসামী তুহিনকে ধরা হয়েছিলো সেই তুহিনকে রিমান্ডে দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। অথচ রিমান্ড তো দূরের কথা, গ্রেফতারের ১০ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে নয়াপল্টনে কোনো খুন হয়নি। অথচ মির্জা আব্বাসকে হুকুমের আসামী করা হয়েছে এবং নিপুন রায় ও আরিফা রুমা নামক দুজন উচ্চ শিক্ষিত সমাজে প্রতিষ্ঠিত তরুণীকে ৫ দিনের রিমান্ড দেয়া হয়।
তিন
আওয়ামী লীগ সরকার তো বটেই, নির্বাচন কমিশনও এই নির্বাচনে যেন একটি পার্টি হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা দুরাশা মাত্র। এগুলির একটি মাত্রই উদেশ্য। আর সেটি হলো, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। ঐক্যফ্রন্ট সরকারের এ খেলা ধরতে পেরেছে। তাই গত ১৭ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টে অনুষ্ঠিত আইনজীবীদের মহাসমাবেশে ড. কামাল ঘোষণা করেছেন যে, কোনো অবস্থাতেই ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বয়কট করবে না। সরকার বিরোধী দলের কোনো দাবি মানেনি। নির্বাচন কমিশনও তাদের কোনো আবেদনে কর্ণপাত করেনি। নির্বাচন যদি আর তিন সপ্তাহ পেছানো হতো তা হলে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হতো না। তার আগেই আওয়ামী লীগের একটি ডেলিগেশন কমিশনে গিয়ে হুমকি দেয় যে তফসিল একমাস পেছানো তো দূরের কথা, এক ঘণ্টাও পেছানো হবে না। উদ্দেশ্য, ঐক্যফ্রন্ট যেন ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বলে, আমরা আর ইলেকশন করবো না। আর আওয়ামী লীগ তো সেটাই চাচ্ছে। কিন্তু শত উস্কানির মুখেও বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের বক্তব্য হচ্ছে, তারা কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের পাতা ফাঁদে পা দেবে না।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, গায়েবি মামলার একটি তালিকা বিএনপির তরফ থেকে শনিবার নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বিএনপি নির্বাচন কমিশনে (ইসি) প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর গত তিনমাসে করা গায়েবি ও মিথ্যা মামলা এবং তাতে তালিকাভুক্তদের নামের তালিকা জমা দিয়েছে। একই তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছেও জমা দিয়েছে। মহাসচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৪৮টি মামলা করা হয়েছে। গত আট নভেম্বর তফসিলের পর ৭৭৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি অব্যাহত রেখেছে। তারা হুমকিও দিচ্ছে। তাই এই হুমকি ও গ্রেফতার বন্ধের জন্য সিইসির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন মহাসচিব।
এখনো মফস্বলের প্রতিটি জেলায় বিএনপি নেতা কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিচ্ছে পুলিশ। তফসিল ঘোষণার ১২ দিন পরেও যদি এধরনের উন্মত্ততা চলে তা হলে তার পরিণতি কখোনো শুভ হয় না। যদি অবিলম্বে এসব স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ না হয় তাহলে তার জন্য দায়ী থাকবে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।