Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বিপথগামী কিশোরেরা

চট্টগ্রামে জড়িয়ে পড়ছে খুন ধর্ষণ ছিনতাই অপহরণে

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

চট্টগ্রামে বেড়েই চলেছে কিশোর অপরাধ। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, অস্ত্রবাজি, মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে তারা। যাদের থাকার কথা পড়ার টেবিলে কিংবা খেলার মাঠে তারাই পাতাল জগত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্র-ছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর ও উঠতি তরুণেরা। তারা প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি করে হত্যা করছে। দলবেধে ধর্ষণ, অপহরণ ও ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। পাড়া-মহল্লা কেন্দ্রিক ভয়ঙ্কর গ্যাং কালচারকে ঘিরে প্রতিনিয়তই ঘটছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি।
এদের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়ারাও। গত কয়েক মাসে নগরীতে অন্তত ১২টি ভয়ঙ্কর অপরাধের ঘটনায় সরাসরি কিশোরদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। তাদের অনেকে গ্রেফতারও হয়েছে। নগরীর শিশু আদালতে প্রায় ৬০০টির মতো মামলা বিচারাধীন রয়েছে। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, চুরি, ছিনতাই, মাদক ও অস্ত্রবাজির অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে।
কিশোর ও উঠতি যুবকদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বাড়ছে। সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অভিভাবকেরাও। নগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, বেপরোয়া কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে সুফল মিলছে না। কিশোরদের আড্ডার ৮০ স্পটে নিয়মিত চলছে অভিযান। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ পুলিশের একার পক্ষে সম্ভবও নয়। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুশাসন না থাকায় কিশোরেরা বিপথগামী হচ্ছে। আর ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট ভ‚মিকা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও কিশোরদের অপরাধী হয়ে উঠার প্রবণতা বাড়ছে।
নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, আতঙ্কের বিষয় হলো রাজনৈতিক বড় ভাইদের কারণে কিশোরদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র উঠে আসছে। ক্যাস্পাস ও পাড়া মহল্লা কেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় তারা প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কিশোরদের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে। তার আগে নগরীর আরও কয়েকটি এলাকায় কিশোরদের অস্ত্রবাজি করতে দেখা যায়।
সস্প্রতি ছাত্রলীগের কোন্দলে কয়েকটি খুনের ঘটনায় কিশোরদের অংশ নিতে দেখা গেছে। নগরীর ষোলশহরে চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যকে প্রকাশ্যে গুলি করার ঘটনায়ও বেশ কয়েকজন কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়।
গত ২৭ মে বন্দর থানার দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর এলাকায় রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা সজল নন্দীকে খুন করা হয়। পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করে। এই তিন কিশোর খুনের দায় স্বীকার আদালতে জবানবন্দি দেয়। তারা জানায়, সজল নন্দীর ছেলে নবম শ্রেণিপড়ুয়া কিশোর তাদের বন্ধু। ২৯ লাখ টাকা নেওয়ার জন্য তারা বন্ধুর বাবা সজল নন্দীকে গলা কেটে খুন করে। ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে জামালখান মোড়ে ব্যস্ত সড়কে স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে খুন করে কয়েকজন কিশোর। পরে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা সবাই নগরীর বিভিন্ন নামকরা স্কুল ও কলেজের ছাত্র। সবাই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
টাকা লেনদেনের জেরে মায়ের সঙ্গে বিরোধে ৯ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। নগরীর আকবর শাহ থানার বিশ্ব কলোনিতে এ ঘটনায় পাঁচ আসামির মধ্যে কিশোর রয়েছে দুজন। এক স্কুলছাত্রকে অপহরণ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে ৪ কিশোর। এরাও স্কুল ও কলেজপড়ুয়া। গ্রেফতারের পর মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ইয়াবা সেবনসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার কথা স্বীকার করেছে তারা।
গত ১৮ জুন চট্টেশ্বরী রোডের একটি রেস্তোরাঁয় এক কিশোর আরেক কিশোরকে ছুরিকাঘাত করে। ওই ছুরিটি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে দেয় পাশে থাকা কিশোরী। পরে পুলিশ সিসিটিভি দেখে অভিযান চালিয়ে কিশোরীসহ সাতজনকে গ্রেফতার করে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে এসব শিক্ষার্থী প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে বিরোধের জেরে মারামারিতে জড়ায়। ২৮ জুলাই রাতে রেলস্টেশন এলাকা থেকে ছিনতাইকালে ১০ কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ছিনতাই করতে গিয়ে ১৭ জুন রাতে মো. সুমন নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় ১০ কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়। একই রাতে নগরীর ব্যাটারি গলির মুখে যুবলীগের কর্মী আবু জাফর অনিক হত্যা মামলায় এক কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিশোর আরাফাত খুনের ঘটনায় ২২ মে ভোরে মোহরা ইস্পাহানি শ্রমিক কলোনী থেকে আসিফ ও নূর হোসেন বাপ্পীসহ তিন কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা জানিয়েছে আরাফাত তাদের বন্ধু, ঝগড়ার জেরে খুনের এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ বলছে ওই তিনজনের বিরুদ্ধে আগে অপরাধের কোন রের্কড নেই। তুচ্ছ ঘটনায় তারা নিজেদের বন্ধুকে গলা কেটে হত্যা করেছে।
চট্টগ্রামের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বিচারহীনতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও কিশোর অপরাধ বাড়ছে। কোন ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অনেকে ভয়ে এ ধরণের অপরাধ থেকে বিরত থাকে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকাও দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। এতে করে অপরাধীরা পার পেয়ে যায় এবং দ্বিগুণ উৎসাহে অপরাধে জড়ায়। কিশোর অপরাধ দমনে পুলিশের পাশাপাশি অভিভাবক এবং সমাজেরও ভূমিকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, রাজনীতিকে যারা ব্যবসা হিসাবে নিয়েছে তারাই কিশোরদের বিপথগামী করছে। তাদের হাতে অস্ত্র মাদক তুলে দিচ্ছে। ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুশাসনের অভাবেও অনেকে অপরাধী হচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গেছে। একক পরিবারের বাবা-মা দ্ইুজনই চাকরি করেন। সন্তানদের সাথে তাদের যোগাযোগ কমে যাচ্ছে। ফলে তারা কার সাথে মিশছে, কি করছে তা অনেক বাবা-মা জানেন না। এতে করে সন্তান বখে যাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় কিশোরেরা যা দেখছে, বাস্তবে তা ঘটিয়ে বসছে। কিশোরদের সুপথে আনতে নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন আরও সূদৃঢ় করা জরুরি বলেও মত দেন তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খুন

৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ