পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইলেকশন সকলের দুয়ারে করাঘাত করছে। এতদিন আমরা জানতাম ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ইলেকশন হবে। অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিত তো এক সময় বলেই দিয়েছিলেন যে, ২৭ ডিসেম্বর ইলেকশন হবে। কিন্তু চিফ ইলেকশন কমিশনার নুরুল হুদা সেটি অস্বীকার করেন। তখন তিনি বলেছিলেন যে, নির্বাচনের জন্য কোনো তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। তবে ডিসেম্বরের শেষের দিকে ইলেকশন হবে। রবিবারের পত্র পত্রিকায় দেখলাম, তিনি সেই কথা অস্বীকার করেছেন। প্রায়শই দেখা যাচ্ছে যে, চিফ ইলেকশন কমিশনার (সিইসি) একটি কথা দেন এবং কয়েক দিন পরেই সেই কথা থেকে সরে যান। রবিবারের পত্র পত্রিকায় দেখলাম,নরুল হুদা সাহেব বলেছেন যে, ডিসেম্বর মাসেই যে ইলেকশন হবে এমন কোনো কথা তিনি বলেননি। তিনি বলেছেন যে, এটি ডিসেম্বরেও হতে পারে, আবার জানুয়ারিতেও হতে পারে। সম্ভবত সে কারণেই ইলেকশনের আগে যে গুলো আবশ্যকীয় করণীয় সেগুলোর কোনোটাই করা হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ বিশেষ করে তার সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন যে, সহসাই নির্বাচনী সরকার গঠন করা হবে। নির্বাচনী সরকার বলতে তারা বোঝাচ্ছেন, এখন যে মন্ত্রীসভা রয়েছে তার চেয়েও ছোট আকারে মন্ত্রীসভা পুনর্গঠন করা হবে। বর্তমান জাতীয় সংসদে যে সব দলের সদস্য রয়েছেন সেই সব দলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকবে নতুন মন্ত্রীসভায়। আজ ৯ অক্টোবর পর্যন্ত নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়নি। এরপর ঘোষিত হওয়ার কথা নির্বাচনী তফসিলের। সেটিও হয়নি। বর্তমান সংসদের মেয়াদ যেদিন শেষ হওয়ার কথা তার আগের তিন মাসের মধ্যে যে, কোনো দিন নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার অন্তত ৪৫ দিন আগে নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হওয়ার কথা। এতদিন শোনা গিয়েছিল যে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হবে। কিন্তু এখন যেসব কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে সেই সব কানাঘুষা থেকে মনে হচ্ছে যে, নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে না। ধরে নেওয়া যায় যে, নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে যদি তফসিল ঘোষণা করা হয় তাহলে আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সম্ভবত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহকে মাথায় রেখেই সরকার নির্বাচনের আগের করণীয়গুলো ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে দিচ্ছে। ক্যাবিনেট পুনর্গঠনে দেরি হচ্ছে , তফসিল ঘোষণায় দেরি হচ্ছে এবং ফলে ইলেকশনও দেরি হবে। অর্থাৎ সবকিছুই একেবারে শেষ সময়ে করা হবে।
এসব দেখে শুনে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার যতদূর পারে সময় নিচ্ছে কেন? হিসাব করে কেউ কেউ বলছেন বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ৩০ জানুয়ারি, আবর কেউ কেউ বলছেন, মেয়াদ শেষ হবে ২০ জানুয়ারি। সরকারের ভাব সাব-দেখে মনে হয় যে, সরকার পারলে ২০ জানুয়ারিতেই ইলেকশন করবে। তাই পুনর্বার প্রশ্ন উঠছে, সরকার কেন সময় নিচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাব সম্ভবত সরকারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
গত শনিবার এক সাংবাদিক সন্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের বিগত ১০ বছরের এবং সেই সাথে গত ১লা সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সময়ে সরকারের দমন-পীড়নের একটি খতিয়ান দিয়েছেন। ঐ খতিয়ানে বলা হয়েছে যে, ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ৪০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর পর থেকে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ১৩৮টি মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৯২ জনের, অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৫৭ জনকে। আর গ্রেফতার করা হয়েছে ৪ হাজার ৬৮৪ জনকে। গত দশ বছরে মামলার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৯০ হাজার ৩৪০ টি মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৪৭ জনকে। আর এই সময়ে জেলে নেয়া হয়েছে ৭৫ হাজার ৯২৫ জনকে। এই সরকারের দুই মেয়াদে নিহত হয়েছেন ১৫শ ১২ জন নেতাকর্মী যার মধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা খুন হয়েছেন ৭৮২ জন। গুম করা হয়েছে ১২শ ৪ জনকে। এদের মধ্যে ৭৮১ জনকে পরবর্তীতে গ্রেফতার দেখানো হয়। কিন্তু ৪২৩ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
দুই
ইলেকশনের আগে এত ব্যাপক ধরপাকড় এবং গায়েবি মামলার উদ্দেশ্য ফাঁস করে দিয়েছে দৈনিক ‘প্রথম আলো’। গত রবিবার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান সংবাদে যা বলা হয়েছে তার অংশ বিশেষ নি¤œরূপঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে মহানগর, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি পর্যন্ত প্রত্যক নেতাকে মামলার আওতায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই পুলিশ বাদী হয়ে সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক ‘গায়েবি’ মামলা করছে।
আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীর সম্ভাব্য এজেন্ট কারা এবং মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার সক্ষমতা কার আছে, এমন নেতাকর্মীদেরও শনাক্ত করে মামলার আওতায় আনতে থানা পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠ পর্যায়ের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনার ভিত্তিতে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি ধরে ধরে মামলার আসামি করা হচ্ছে। এ কারণে কোনো কোনো মামলায় মৃত ব্যক্তি, হজে থাকা, বিদেশে থাকা, বয়োবৃদ্ধ, গুরুতর অসুস্থ হয়ে চলাফেরায় অক্ষম ও কারাগারে থাকা নেতাকর্মীরাও আসামি হয়ে গেছেন, যা গণমাধ্যমে আসায় কিছুটা বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়েছে।
মাঠপর্যায়ে পুলিশের বেশ কটি সূত্র থেকে জানা গেছে, কয়েক মাস আগেই বিএনপির কমিটির তালিকা থানার পুলিশকে পাঠিয়ে প্রত্যেকের ঠিকানা যাচাই করতে বলা হয়। যাদের একাধিক ঠিকানা আছে, সেটাও বের করতে বলা হয়েছে। বিএনপির কর্মসূচি গুলোতে আসা নেতা–কর্মীদের ছবি তুলতে বলা হয়েছে। পরে ছবি দেখে নেতাকর্মীকে শনাক্ত করে, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাঁদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নিবাচনে বিএনপির সম্ভাব্য এজেন্টদেরও শনাক্ত করে এবং বিগত বিভিন্ন নির্বাচনে যাঁরা বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট হয়েছেন, তাঁদেরও মামলার আওতায় আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে থানা পুলিশকে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, এসব গায়েবি মামলার উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনের সময়ে নেতাকর্মীরা যাতে মাঠে থাকতে না পারেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাতে প্রার্থী হতে না পারেন। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। তিনি বলেন, ‘আমরা তো মনে করি, এটা সরকারের নীলনকশা। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় এসব মামলা হচ্ছে।’
আগামী ২১ অক্টোবর বর্তমান জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন বসছে। এই অধিবেশনে আরপিও সংশোধন করা হবে। সিইসি নুরুল হুদা গত শনিবার বলেন যে আরপিও সংশোধনীর খসড়া তারা ইতো মধ্যেই সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই খসড়াটি সংসদে গৃহীত হলে সেটি সাংবিধানিক বৈধতা পাবে। আর সেটি পেলেই আগামী ইলেকশনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহার করা যাবে।
তিন
এসব ঘটনার পর আর খোলাসা করে কিছু বলার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এই ইলেকশনে আওয়ামী লীগ তার অবস্থান স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ করেছে। সেগুলো হলো, তফসিল ঘোষণার আগে আওয়ামী সরকার পদত্যাগ করবে না, বিরোধী দলের দাবি মোতাবেক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো নির্বাচনী সরকার গঠিত হবে না, তফসিল ঘোষণার আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে না, তফসিল ঘোষণার আগে বর্তমান জো- হুজুর ইলেকশন কমিশনের পুনর্গঠন করবে না এবং আগামী নির্বাচনেই সীমিত আকারে হলেও ইভিএম ব্যবহৃত হবে। আওয়ামী লীগ সরকার আরো পরিস্কার করেছে যে, তফসিল ঘোষণার আগেই বিরোধী দলের বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর আন্ডা বাচ্চা সহ তৃণমূলের সমস্ত সক্রিয় কর্মীকে হয় মামলা দিয়ে পলাতক করা হবে, না হয় গ্রেফতার করে লাল দালানে তোলা হবে।
গত সেপ্টেম্বর থেকে সরকার হঠাৎ নতুন করে ধরপাকড় এবং মামলাবাজি শুরু করেছে কেন? এর উত্তরটিও খুব পরিস্কার। সেপ্টেম্বরের আগের মাস পর্যন্ত সরকারের ধারণা ছিল যে, বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোট ইলেকশন বয়কট করবে এবং ইলেকশন প্রতিহত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, যা কিছুই ঘটুক না কেন, বিএনপি ইলেকশনে আসবেই। এই জন্য প্রয়োজন হলে বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই তারা ইলেকশন করবে। এই খবরটি সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার পর সরকার তার রণকৌশল বদলায়। এখন তারা ঠিক করেছে যে, বিএনপি ইলেকশন করতে পারে, কিন্তু কোনো নেতাকর্মী পাবে না। জনসভা করার জন্য সংগঠক পাবেনা, মিছিল করার জন্য লোকজন অর্গানাইজ করার কর্মী পাবে না। এমনকি পোলিং এজেন্টও পাবে না। যারা মাঠে এসব কাজ করবে তারা সরকারের মামলা এবং হামলায় সব সময় দৌঁড়ের ওপরে থাকবে। ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় ঞযবু ংযধষষ ধষধিুং নব ড়হ ঃযব ৎঁহ. সরকার তার এই কৌশল সম্পর্কে কোনোরূপ রাখ ঢাক করছে না।
চার
এই পটভূমিতে বিরোধী দলসমূহ এখন কি করবে? বিএনপির কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে যে, তারা বি চৌধুরী, রব, মান্না এবং কামাল হোসেনের ওপর দারুণ ভাবে নির্ভর করছে। এই চার ব্যক্তি বা তাদের সংগঠন সরকারের এই অনমনীয় মনোভাবে কি করবেন? আর মাত্র তিন মাস। এখন পর্যন্ত বিএনপির সাথে তাদের ঐক্য কমপ্লিট হয়নি। হলেই বা কি? তারা কি কোনো আন্দোলনে যাচ্ছেন? গণআন্দোলনে যুক্তফ্রন্ট বা ঐক্য প্রক্রিয়ার এমন কোনো ভূমিকা থাকবে কি? যদি কিছু করার থাকে তাহলে সেটি করবে বিএনপি। আর করতে পারে জামায়াতে ইসলামী। তাদেরকে তো বাদই দেওয়া হচ্ছে। তাহলে কি রাজপথের কোনো আন্দোলন হবে না? শুধু জনসভা? জনসভা করে ইলেকশনে যাওয়া? কোন ইলেকশনে? যেখানে কোনো দাবিই মানা হচ্ছে না। যুক্তফ্রন্ট এবং ঐক্য প্রক্রিয়াতো তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে বেগম জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরার দাবি তুলতেই দেবে না। কি করবে তাহলে বিএনপি?
এসব প্রশ্ন জনগণকে এবং বিশেষভাবে বিএনিপর তৃণমূল কর্মীদেরকে উদ্বেল করছে। অবিলম্বে এসব প্রশ্নের সমাধান হওয়া উচিত। না হলে তৃণমূলের কর্মীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উৎসাহ পাবে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।