Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আবদুল মান্নান সৈয়দ

পরাবাস্তবতায় একাকী পরিব্রাজক

মু সা ফি র ন জ রু ল | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)

মূলত, ত্রিশোত্তরকালে বাংলা সাহিত্যে ইউরোপীয় ভাবধারার যে জোয়ার বয়ে গিয়েছিল; সে জোয়ারে তরণীর সফল মাঝি ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। মান্নান সৈয়দ প্রসঙ্গে খোন্দকার আশরাফ হোসেন তাঁর ‘বাংলাদেশের কবিতা : অন্তরঙ্গ অবলোকন’ গ্রন্থে বলেছেন “আবদুল মান্নান সৈয়দ পুনর্বার কুয়াশার মধ্যে প্রবৃষ্ট হন ‘পরাবাস্তব কবিতা’ পর্ব থেকে। কুয়াশা রূপ পরিগ্রহ করে নারীর, আর লিবিডোলিপ্ততার মধ্যে সংক্রমিত হতে থাকে তাঁর কাব্যশব্দাবলী।” তাঁর মনে হয় :
“এক অবিরল নদী
বইছে বইছে নীলিমা থেকে নিখিলের হৃদয় অবধি
নারী তুমি তার সারাৎসার .......
তোমার হৃদয় আনে পৃথিবীর সমস্ত সুস্বাদ”
(নারী)
ব্যক্তিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের মত প্রচলিত চিন্তা ও ফর্মের মুক্তিই তাঁর কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। তাঁর ‘তুমি’ কবিতায় সে বিষয়টি ফুটে উঠেছে :
‘‘তুমি অবিরল শ্রাবণ স¤প্রপাত :
কথা নয় সে তো মৃদু ঘাসফুল ফোটে
যখন তারার আলপিন আঁটা রাত
হৃদয়ে আমার হাওয়ায় হাওয়ায় লোটে
নীল চাদরের অবিকল অনুসরণে।”
(তুমি)
আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলাদেশের কবিতায় পরাবাস্তবতা বিনির্মাণে একটি বিশেষ স্থান আয়ত্ত¡ করতে সক্ষম হয়েছেন। এতদ্ প্রসঙ্গে খন্দকার আশরাফ হোসেনের উক্তি স্মরণীয় : “আবদুল মান্নান সৈয়দই সম্ভবত একমাত্র কবি যিনি একটি নির্মোহকে, একটি স্বয়ংসৃষ্ট গম্বুজের নিরালোক নিভৃতিকে, নিজেকে রক্ষা করেছেন বর্হিজগতের রোদ্র থেকে। তাঁর পরাবাস্তব কবিতাসমূহ নিজেরাই নিজেদেরকে সংক্রমণ করেছে বহুকাল এবং ঐ কবি বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে কম সমকালস্পৃষ্ট। আবদুল মান্নান সৈয়দের নিভৃত শিশিরচারিতা তাকে আলাদা করেছে অন্য কবিদের থেকে।......তাই মান্নানের সমকালীনরা যখন জনরুচির বিবিধ উপাচারে কবিতাকে সাজাচ্ছিলেন তখনও ঐ সৈয়দ থেকেছেন তাঁর নীলিমার চাষাবাদে ব্যাপৃত, নগ্নপায়ে শিশিরসিঞ্চিত চেতনাভ‚মিতে একাকী পরিব্রাজনরত।”(খন্দকার আশরাফ হোসেন, বাংলাদেশের কবিতা অন্তরঙ্গ অবলোকন, ভ‚মিকা, পৃষ্ঠা-১১)। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছে’র সবচেয়ে অর্থবোধক কবিতা হলো-‘সমস্ত ভাষাণ দিলাম সমস্ত উড়াল’ । এ কবিতায় পরাবাস্তবতার বেদানা ফেটে পড়েছে হাজার দানায় :
“আমাদের বাড়ির বাইরে তেতো রাত, আমাদের বাড়ির বাইরে সেতুর ব্যান্ডেজ করা রাত,
লাল এ্যাপ্রোনের মধ্যে বাঁধা বন্যার মতো বসে ছিল রাত, মেয়ে মানুষ রাত,
পশ্চিমে ছাড়া পেয়ে ডাকাত নেমে পড়লো ঘোড়ার ক্লিপক্লাপ ভিজে মাঠে,
লেনে বাইলেনে, সমুদ্রের মতো অন্ধস্ট্রিটে স্ট্রিটে, গনগনে জানোয়ার যেন..”
(সমস্ত ভাষাণ দিলাম সমস্ত উড়াল)
আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় পরাবাস্তবতার চিত্র বিচিত্র আঙ্গিকে প্রতিফলিত হয়েছে। কবি আল মাহমুদ তাঁর ‘পরাবাস্তব কবিতা’ গ্রন্থ সম্পর্কে বলেছেন : “আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় বাস্তবতার চিত্ররূপময় ছায়াকে কেবল শব্দের সঠিক সন্ধান দিয়ে যে কবিত্ব শক্তিতে তরতাজা স্বপ্নে পরিণত করা হয়েছে, তা আধুনিক বাংলা কবিতায় নিঃসন্দেহে একটি বিরল ঘটনা।” মান্নান সৈয়দ তাঁর কবিতায় গ্রীবর বিনম্র নীরব ভঙ্গিমা তিনি দেখার অবকাশ পাননি তিনি দেখেছেন সচল উষ্ণ গ্রীবার তৃষ্ণার্ত চঞ্চলতা। এ এক আশ্চর্য আবেগ, ভালোবাসার মধ্যেও রক্তের চঞ্চল গতি :
“বিগলিত করো তুমি জ্যোৎর বৃষ্টিতে
মনে হয় রাত্রি যতো গাঢ় হয় ততো যেন উঠি জেগে,
ততো যেন উন্মাতাল গভীর সংবেগে
হৃদয়ের মৌচাক প্লাবিত, বৈষয়িকের দৃষ্টিতে
দেখেছি গভীর নীল রাত্রির উচ্ছ্রিতি,
নিশীথ-সূর্যের মতো রেস্তোরাঁর সোনার খনির
আবিষ্কার, এই রেস্তোরাঁর চন্দ্র-ঠিকরানো জ্যোতি..।
(রাত্রির রেস্তোরা)
সময় ও সমাজের বিবেচনায় তাঁর অসংখ্য কবিতায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রতীকীবাদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে করণকৌশলের নিপুণ ব্যবহারে সুররিয়ালিজম-এর জগতে নির্বিঘে্ন অবগাহণ করেছেন। তিনি ব্যক্তি ও সমাজের বর্হিবাস্তবতাকে ধারণ করে চেতন থেকে অবচেতন হয়ে অচেতন অর্ন্তলোকের রহস্য সন্ধান করেছেন :
“মনে করো সেইসব রাত, যদি মনে থাকে; সাইরেনের মতো
টঙ্কার দিয়ে উঠেছে মেয়েরা একেকটি কটিতলের পুরুষ
উচ্ছ্রিত দেখে, রক্তাক্ত ধর্মযাজিকা, শিল্পী এককোণে তন্ময়
নিজেকে তিনটি পায়ের আঁকতে-”
(জ্যোৎনা, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)
সাহিত্যে ‘পরাবাস্তব’ বিক্ষা বাস্তবের চেয়ে এক সভ্যতর জগৎ নির্মাণের চেষ্টা, মনোলোকের প্রভাবে বাস্তবতার পুনঃনির্মাণে ’সুররিয়ালিজমে‘র বিশ্বজনীনতা নাস্তিতে নয়; অস্তিবাচকতায়। অবচেতন মনের মধ্য দিয়ে এ অনুভব আবিস্কার করে নেয় আমাদের প্রতিদিনের পৃথিবীর অন্তরালবর্তী এক সত্যতার বাস্তবতা। ‘ব্যক্তিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের মত প্রচলিত চিন্তা ও ফর্মের মুক্তিই ছিলো পরাবাস্তবতার মূল কথা।’ তবে এ ক্ষেত্রে মুক্তির চেয়ে পরিবর্তন কথাটি অধিকতর প্রযোজ্য :
“বিতরিত হ’য়ে আছো
আধেক পাথরে তুমি
আধেক উড্ডীন কোনো পরির পাখায়।”
(তুমি)
পরিশেষে, একথা নিঃসন্দেহে প্রতীয়মান হয় যে, আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলা কবিতায় পরাবাস্তববাদের ধারায় এক স্বতন্ত্র ধারা প্রবর্তন করে একটি নতুন সুরের অনুসন্ধান করেছেন। এই নতুন সুরই তাকে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত কবি হিসেবে স্থান করে দিয়েছে। বস্তুত, ষাটের দশকে এক তীর্যক বিতর্ক ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতা নিয়ে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলা কবিতায় উপস্থিত হয়ে আপন অহঙ্কার নিয়ে নতুন আকর্ষণে মগ্ন হন শব্দে, চিত্রে, বর্ণে-কবিতা তাঁর কবি মানসকে দুলিয়ে তোলে একের পর এক উচ্চ স্তরে। সে কারণে তিনি বিশুদ্ধ পরাবাস্তববাদী কবিতা রচনায় সাফল্য অর্জন করেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাস্তবতা

৫ অক্টোবর, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন