Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

যে গল্প বাস্তবতাকেও হার মানায়

প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্পোর্টস ডেস্ক : ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক কিংবদন্তি আছেন যাদের পদাঙ্ক আমরা কেউই অনুসরণ করতে চায় না। তবে গল্পের নির্যাসটুকু ঠিকই নিই প্রেরণা হিসেবে। আমরা সাধারণত তাদের পদাঙ্কই অনুসরণ করি যারা মানবিকতার সর্বোত্তম শিক্ষা দেয়। দেয় শত ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝেও আশা না হারানোর অনুপ্রেরণা।
ইউসরা মারদিনি তেমনি একজন। বয়স মাত্র ১৮। এই বয়সে অন্যদের মতো সেও হাতে স্মার্টফোন আর মুখে হাসি নিয়ে মেতে থাকত বন্ধুদের সাথে আড্ডায়। বাবা-মায়ের পরিবারে বাকি দুই বোনের সাথে সেও মেতে থাকত খুনটুসিতে। সবার মত তারও ছিল স্বপ্ন। বাবা সাঁতারু দলের কোচ হওয়ায় সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ে মারদিনির মধ্যেও। সে স্বপ্ন দেখতে থাকে, একদিন সে নামকরা সাঁতারু হবে। এজন্য এক জিমন্যাসটিকসেও ভর্তিও হয় সে।
এ পর্যন্ত সবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এর পরই তার প্রিয় মাতৃভূমি সিরিয়ায় শুরু হয় যুদ্ধের দামামা। সর্বোত্র সংঘাতের নির্মমতা, মুহুর্মুহু বোমার শব্দ, রক্ত আর মৃত্যুতে আলিঙ্গনের পরিচিত ভয়ানক দৃশ্য।
ইউসরা মারদিনির জীননের গল্পটাও তাই আর স্বাভাবিক থাকেনি। যে পুলে সে সাঁতার কাটত সেটি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বোমার আঘাতে। সেই আঘাত থেকে রেহায় পেল না তার বাড়িও। বিশ্বস্ত আপন ঘর একসময় পরিণত হল ধ্বংসস্ত‚পে। মারদিনিরা শারীরিকভাবে অক্ষতই ছিলেন। তবে সামনের দিনগুলো ছিল অন্ধকারময়। এরপরও সময় থেমে থাকে না। এক গড়িয়ে হল দুই, দুই হল তিন, তিনও একসময় পার হয়ে কাটল চার-চারটি বছর। আর কত? তারা বেঁচে ছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে বেঁচে থাকা বলে কি?
মারদিনি একজন ফুটবলারকে জানত, যে মারা গিয়েছিল বোমার আঘাতে। চোখের সামনে ছেলেটির স্বপ্নকে চুর হতে দেখেছে সে। সে সিদ্ধান্ত নিল ‘এভাবে আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না।’ তার সামনে পথ ছিল দু’টিÑস্বপ্নকে কুরবানি করে জন্মভূমিতে থেকে যাওয়া, অথবা স্বপ্নকে সম্বল করে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমানো। মারদিনে বেছে নেন দ্বিতীয়টি। এরপর শুরু হয় দুঃসাহসী এক অভিযান। জীবন আর মরণের দড়ি টানাটানি খেলায় শেষ পর্যন্ত জয়ী হন মারদিনি। জীবনকে টিকিয়ে রাখাার সেই লড়াইয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে মারদিনি বলেন, “পথিমধ্যে যে কোন সময়-ই আমি মরতে পারতাম। কিন্তু আমি তো আগেই মারা পড়েছিলাম আমার মাতৃভূমিতে। তাই, এ ছাড়া আমার কি-ই বা করার ছিল।”
দিনটা ছিল ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট। সিরিয়ান গৃহযুদ্ধের বয়স ততদিনে পেরিয়েছে প্রায় সাড়ে চার বছর। অন্যান্য দেশত্যাগীদের (রিফিউজি) মত সেও সিদ্ধান্ত নিল দেশ ছাড়ার। সাথে ছিল তার বড় বোন ও তাদের দুই চাচাতো বোন। তাদের বাবা তাদের পথ অনুসরণ করছিল জিপিএসের মাধ্যমে। তাদের এই ভ্রমণ বাকি সব ভ্রমণের মত ছিল না। লেসবস দ্বীপ থেকে তারা যে ইঞ্জিন নৌকায় করে সমুদ্রযাত্রা শুরু করে তার ধারণক্ষমতা ছিল ২০জন। কিন্তু তাদের দলে লোকসংখ্যা ছিল তার চেয়েও ৬-৭ জন বেশি। সমুদ্র যাত্রার আধাঘন্টা পর হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল নৌকার ইঞ্জিন। এমতাবস্থায় লোকসংখ্যা কমানো না হলে নৌকা যে কোন সময় ডুবে যাবে। মারদিনি বলেন, “আমি জানতাম এটা লজ্জার হবে যদি আমি সমুদ্রে না নামি কারণ আমি একজন সাঁতারু।” কয়েকজনের সাথে তারা দুই বোনও সমুদ্রে ঝাঁপ দিল। নৌকায় দড়ি লাগিয়ে গভীর সমুদ্রে সাঁতার কাটতে থাকল তারা। এভাবে তারা সাঁতার কেটে নৌকা টানতে লাগল তীরের দিকে। এই কাজে তাদের সাথে ছিল আরো তিন নারী। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জীবন-মরণ এই যুদ্ধের পর তারা দেখা পায় তীরের। তখনকার কিছু স্মৃতি মারদিনির মুখেই শোনা যাক, “প্রত্যেকের শরীরের রং ধুসর হয়ে গিয়েছিল। এটা এমন ছিল যেন চোখের সামনেই নিজের জীবনকে শেষ হতে দেওয়া। আমি ও আমার বোন এক হাত দিয়ে নৌকা ধরে রেখে বাকি হাত ও পা ব্যবহার করে চিত সাঁতার দিচ্ছিলাম। শেষ এক-দেড় ঘণ্টা আমি আর পারছিলাম না। পানিও ছিল তীব্র ঠাÐা। সুতরাং আমি ওপরে উঠলাম।” এরপর এসময় তারা কাক্সিক্ষত তীরের দেখা পায়। সেখানে পৌঁছেই মাটিতে শুয়ে পড়ে সে, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে।
স্থল যাত্রাটাও তাদের জন্য সহজ ছিল না। গ্রিসে পৌঁছানোর পর ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত শিবির যখন একটা খারার রেস্টুরেন্ট দেখল তখন প্রথমদিকে তাদের কাছে খাবার বিক্রি করতে চায়নি দোকানিরা। “আমরা খাবার কিনে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা দিলো না। তারা ভাবছিল আমরা বোধহয় চুরি করব। অনেকেই ভাবছিল রিফিউজিদের কোন বাড়ি নেই, তাদের কিছুই নেই। তারা ভাবছিল আমরা শুষ্ক মরুর আদিবাসী। কিন্তু না, আমাদের সব ছিল, যেমনটি তোমাদের আছে।” বলেন মারদিনি।
একসময় তারা তাদের কাছে পানি ও খাবার বিক্রি করে। এমনকি একজনের কাছ থেকে একটা জুতা ও একটা ট্রাওজারও পান মারদিনি। তাদের লক্ষ্য জার্মানি তখনও এক হাজার মাইলের পথ। গ্রিস থেকে তারা মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি এবং অস্ট্রিয়া পাড়ি দিল পায়ে হেঁটে! এরপর তারা এগুতে থাকল বার্লিনের দিকে। ২৫ দিনের দুঃসহ সেই যাত্রার পর তারা পৌঁছালো বার্লিনে। সে বুঝল, আশা নামের বস্তুটা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
জার্মানিতে মারদিনির প্রথম আশ্রয় হয় একটা উদ্বাস্তু শিবিরে। সেখানে পৌঁছে সে প্রথমেই শুরু করে নিকটস্থ সাঁতার পুলের সন্ধান। একজন মিশরীয় দোভাসির সহায়তায় বার্লিনের সবচেয়ে পুরাতন সুইমিং ক্লাব ওয়াসারফ্রুয়েন্ডে স্পানাদুর খোঁজও পেয়ে যান তিনি। তার সাঁতার কৌশল দেখে সেখানকার কোচ অবাক হয়ে যায়। ফলে ক্লাবটিতে সুযোগ পেয়ে যান মারদিনি। কোচ ভ্যান স্প্যানারক্রেবস তাকে টোকিও অলিম্পিক ২০২০ এর জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। কিন্তু গত মার্চে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) ঘোষণা দেয় এবারের রিও অলিম্পিকে উদ্বাস্তু নামে একটা দল অংশ নেবে। যা ছিল সমস্ত বিশ্বের রিফিউজিদের জন্য এক আশার বাণী।
মারদিনি দ্রæতই বুঝতে পারল তাকে নিয়ে চারিদিকে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের মত বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা তার কাছে ফোন করতে লাগল। একসময় আইওসি’র সংক্ষিপ্ত ৪৩ জনের তালিকায় যখন মারদিনির নাম আসল তখন কোচ স্প্যানারক্রেবস তার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিলেন। মনোযোগ দিতে বলেন অনুশীলনে। গত এপ্রিলে ৪০০ মিটারে মারদিনি সময় নেন ৫ মিনিট ২১.৩ সেকেন্ড, যা কোন সিরিয়ান নারী সাঁতারুদের মধ্যে দ্রæততমের রেকর্ড।
মারদিনি এখন রিও ডি জেনেরিওতে। এবারের অলিম্পিকে সেও একজন প্রতিযোগী। তবে, কোন দেশ নয়, উদ্বাস্তু দলের আরো অনেক প্রতিনিধির মধ্যে সেও একজন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞের এই প্রতিযেগিতায় সে বিজয়ী হতে পারবেন কি না তা সময়-ই বলে দেবে। কিন্তু জীবন নামের প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর যে স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন তা সমস্ত মানবকুলের জন্যই হয়ে থাকল অনুপ্রেরণার। তার মতে, “তুমি যতটুকু ভাবো তার চাইতেও তুমি অনেক বেশি শক্তিশালী।” কি তার স্বúœ? তিনি বলেন, “আমি সবার জন্য অনুকরনীয় হতে চাই। এটা আমার নিজের সাহায্যের জন্য নয়, মনের গভীর থেকে আমি এটা চাই সমস্ত রিফিউজিদের সাহায্য করার জন্যে।”



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যে গল্প বাস্তবতাকেও হার মানায়
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ