শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
স ম তুহিন
আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর (০৩ আগস্ট ১৯৪৩ - ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১০) বিশেষ ভূমিকা ছিল বাংলা কবিতায় এক অচেনা কাব্যরুচির পাঠক তৈরিতে। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, অন্যান্য গদ্যশিল্পসহ সমালোচনা সাহিত্যের প্রভাববিস্তারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। লেখালেখিকে তিনি জীবনের সমান্তরালে স্থান দিয়েছিলেন। ‘... জীবনের সমানই ছিল তাঁর লেখক-জীবন। দিন নেই, রাত নেই, লেখালেখি আর বইপুস্তকই ছিল তাঁর নিত্যমুহূর্তের সঙ্গী। সমকালীনদের মধ্যে তিনিই সম্ভবত নিরঙ্কুশ সর্বব্যস্ত লেখক। তাঁকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন লেখালেখিতে তাঁর ব্যস্ততা ও সময়নিষ্ঠতার বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। লেখালেখির জন্য তিনি সময়ের একটি ফোঁড়ও হারিয়ে যেতে দেননি। ব্যস্ততা আর সময়, এই দুইয়ের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আত্মনিষ্ঠ ও সাবধানী। শুরু থেকেই মান্নান সৈয়দ’র অভীপ্সা জেগেছিল একটি ভিন্ন ভাষাকাঠামো রপ্ত করে নতুন চিন্তা ও কল্পনার প্রকাশ ঘটাবেন তাঁর রচনায়। গদ্যে-কবিতায়-ছোটগল্পে সেই কাজটিই তিনি পূর্ণ বিকাশের মুহূর্তে আয়ত্ত করেছিলেন। সমকালীন কারো কারো ঈর্ষার কেন্দ্রবিন্দুও তিনি হয়েছিলেন। ঈর্ষাগত কারণে তাঁর একটি প্রতিপক্ষও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিকে সামান্য বিরুদ্ধ হাওয়ার আঘাত সৃষ্টি করলেও অবশেষে বন্ধু-অবন্ধু সমকাল-পূর্বসূরী প্রায় সকলের স্বীকৃতি ও সান্নিধ্য লাভ করেন।’ (ভূমিকা : অনু হোসেন, আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলি ; প্রথম খ-)
নান্দনিক শুদ্ধাচারের পাশাপাশি ‘পরাবাস্তবতা’ নামের পাখিটি বাংলা কবিতার আকাশে বিস্তীর্ণ ডানা মেলে উড়েছিল ঈর্ষনীয়ভাবে আবদুল মান্নান সৈয়দের হাত ধরে। এই ধারার সূচনা ও পরিচর্যা বহুলাংশে তাঁর হাতে ঘটেছিল। বলা যাবে এই ধারার প্রায় একক প্রতিনিধি তিনি। তাঁর এই ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের জন্যে, বাংলা কবিতার আলোচনা এলে বারবার আলোচিত এবং উল্লেখিত হতে থাকবেন আবদুল মান্নান সৈয়দের নাম। দৃশ্য থেকে অন্যদৃশ্যে অবাধ যাতায়াত ‘পরাবাস্তব’ কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অবচেতনের সবচেয়ে ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর অনেক জড়ো হওয়া ভাবনা সব কুড়িয়ে পকেট ভর্তি করে কবিÑ যে ভাবনাগুলোর সাথে পাঠক আগে পরিচিত নন, এমনকি সেসব ভাবনারা পাঠকের চেতনার বাইরে ছিল, ছিল বোধের বাইরে। অবলীলায় কবি অবচেতনকে ব্যবহার করেন সচেতনভাবে। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র (১৯৬৮) কবিতাগুলো প্রায় সবই টানাগদ্যে লেখা। কবিতাগুলোকে শহীদ কাদরী ‘কন্টিনেন্টাল প্রোজ পোয়েম’ বলেছিলেন। কবিতার এই ধরন বাংলা কবিতার আলোচনায় সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত ‘তিরিশের কবিতা’ থেকে যেমন ছিল আলাদা, তেমনই আলাদা ছিল চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের সমন্বিত কবিতা আন্দোলনের ধারা থেকেও। মান্নান সৈয়দ-এর বলামতেÑ ‘এই কবিতাগুলো লেখা শুরু করেছিলেন ১৯৬১ সালের দিকে’। তখন বাংলাদেশের বা বাংলা ভাষার কবিতা এমন বিমূর্ত সুযোগ বা আঙ্গিক ধারণের থেকে অনেক দূরে ছিল। এমনকি প্রতীক-উপমায় এমনই আলাদা ছিল, বুদ্ধদেব বসু’রাও (সম্মিলিত তিরিশের কবিরা) এমন উপমা-উৎপ্রেক্ষা-প্রতীক-আঙ্গিক নিয়ে চিন্তা করেননি। মান্নান সৈয়দ-এর সমসাময়িকরাও রূপকধর্মী এ আশ্চর্য কুশলতার কাছে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অদ্ভুত সব উপমায় চিত্রকলা, চিত্রশিল্প ও কবিতার উদ্ভাস ঘটিয়ে অনালোকিত এক সৌন্দর্যের দরজা খুলে দিয়েছিলেন মান্নান সৈয়দের কবিতাগুলো। পরাবাস্তবতার ছবি খুঁজে নেয়ার জন্যে আমরা আশ্রয় নিতে পারি কবিতার লাইনগুলোতেÑ
১.
জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়,
আমার চারিদিকে যতোগুলো দরোজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের; জ্বলছে
গাছ সকল সবুজ মশাল; বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান
একটি নক্ষত্র : আর সমস্তের উপর বরফ পড়ছে। Ñ এরকম দৃশ্যে আহত হয়ে
আমি শুয়ে আছি পথের উপর, আমার পাপের দুচোখ চাঁদ ও সূর্যের মতো
অন্ধ হয়ে গেল, আর যে-আমার জন্ম হলো তোমাদের করতলে মনোজ সে
অশোক সে। জ্যোৎস্না তার কাছে ভূত কিন্তু একটি গানের উপর, দরোজা
তার কাছে পুলিশ কিন্তু একটি জন্মের উপর, মৃত্যু তার কাছে দোজখ কিন্তু
একটি ফুলের উপর।।
(অশোককানন, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)
২.
চিৎকারের নিচে প’ড়ে আছে আমাদের শাদা শহরÑতার পিঠ, কাঁধ, গ্রীবা উরু,
জানু : একফোঁটা আস্বচ্ছ বিহ্বল নীল শিশির সময়ের সবুজ পাতায়। কল্যাণ,
জলের মতো, আমাদের মাথার উপরে প্রতীক্ষায়। ছোটো দিন :- পাশের বনে
শব্দ নেই, শহরে হাওয়া নেই, শহরে একটা মূর্ছা। চটের মতো চোখ বেঁধে
নিয়েছে কুয়াশা মানুষের-মানুষের।
(পরস্পর, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)
তাঁর প্রথম কবিতার বই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র কবিতাগুলো আপাত বিক্ষিপ্ত পরিকল্পনার মতো দেখতে; পরাবাস্তবতার নতুন বুনট আবদুল মান্নান সৈয়দের একেবারে নিজস্ব পরিকল্পনার ফসল আর আমাদের জন্যে অন্যরকমের এক নতুন ভাবনার উপস্থাপন। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ হাতে নিয়ে একজন নিশ্চক্ষু পাঠকও, অনুভব করবেন যে এই কবিতাগুচ্ছ অর্ধমনষ্ক মৌলিক প্রয়াসের ফসল নয়। এই কবিতাগুলো রচিত হবার পেছনে প্রতিটি পঙক্তি নির্মিত হবার উদ্যোগে চেষ্টা শ্রম ও অধ্যবসায়ের কর্ম চেষ্টায় হাত দিয়েছেন কবি, সচেতন ও সক্লেশভাবে চেষ্টা করেছেন গতানুগতিক কবিতার সহজ মসৃণ ও পরিচিত জগৎ থেকে, চেনা রূপকল্প ও পুরোনো উপমার ভিড় থেকেÑ নিজেকে পৃথক করে তুলতে। বিরামহীন, নিবৃত্তিহীনভাবে তিনি খুঁজে যাচ্ছেন স্বকীয়তা’Ñ (আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, কণ্ঠস্বর, মে-জুন ১৯৬৭)।
মান্নান সৈয়দের কবিতা বিষয়ে শওকত ওসমান বলেছিলেনÑ ‘মান্নান আঙ্গিকের দিক থেকে পুরোপুরি পরাবাস্তবতাবাদী (স্যুররিয়ালিস্ট)। চিত্রকল্পের মাধ্যমেই তার ভাবজগৎ নির্মিত। মান্নানকে ভুল-বোঝাবুঝির তাই যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিন্তু ইউরোপীয় কাব্যধারার সঙ্গে পরিচয় থাকলে, এমন হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা কম। সংকুচিত পৃথিবীতে শিল্পের ভাববস্তু (ঈড়হঃবহঃ) হোক জাতীয়, আকার প্রকার বা গড়ন (ঋড়ৎস) হোক আন্তর্জাতিক। গ্রাম্যতা সর্বতোভাবে বর্জনীয়। নতুন টেকনিক আমদানি কোনো অপরাধ নয়। শুধু প্রশ্ন, তার সাফল্য দেশী ঐতিহ্যে কতটুকু সুসঙ্গতি লাভ করেছে। মান্নান এই ক্ষেত্রে আশ্চর্যরকমে অনেকখানি সফল’ (সমকাল, মাঘ-চৈত্র-১৩৭৩)। সেই সফলতার প্রতিচ্ছবি দেখি আমরা নিচের পঙক্তিগুলোতেÑ
...
কী চড়া বাজার! আমাদের পাশের লোকটির সত্যি-সত্যি গলা কেটে নিল চীনে
প্লেটের উপর এক গাঢ় দোকানদার। এরকম প্রমাণ আমি কখনো দেখিনি।
তারপর করল কি?Ñ না, তার কাটা-মু-ু ঝুলিয়ে দিল দোকানের
উইন্ডোর নিচে
বিজ্ঞাপনে টপাটপ। নেমে এলাম ঘোর রাস্তায়।
(সমস্ত ভাসান দিলাম সমস্ত উড়াল, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)
প্রথম কবিতার বই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৮) প্রকাশের পরও দীর্ঘসময় বলা যেতে পারে সারাজীবনই তিনি পরাবাস্তবতায় আচ্ছন্ন ছিলেন সেটি বোঝা যায় ‘পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮২)’ নামেই আবদুল মান্নান সৈয়দ একটি কবিতার বই বের করেছিলেন। হাসান হাফিজুর রহমানকে উৎসর্গ করা বইটির প্রকাশকাল ০৩ আগস্ট ১৯৮২। পরাবাস্তবতার পাশাপাশি সামগ্রিক কবিতা প্রসঙ্গে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘কবিতা কাদের জন্য?’
Ñ এ প্রশ্নের জবাবে আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেনÑ ‘সবার জন্যে নয়। সবার জন্য পদ্য। আগের আগের যুগে যেমন, তে¤িœ একালেও রাশি রাশি পদ্য উদগীরিত হচ্ছে, কিছু কিছু কবিতা। গদ্য থেকে কবিতাকে আলাদা করে চিনে নেওয়া চাই। পদ্য হচ্ছে অন্ধ ও বধির আত্মক্ষরণ, হয়তোবা ছন্দমিলে,Ñ ব্যাস, এটুকুই। কবিতা হচ্ছে এমন এক জিনিশ, যার মধ্যে অন্তত এক ফোঁটা আত্মআবিষ্কারের চিহ্ন লেগে থাকে। তা কিছুতেই পুরোনো, ব্যবহৃত বা পিছুহটা জিনিশ হতে পারে না। তা হবে নতুন, সব নশ্বর আশবাবের ভেতরে এক শাশ্বত জিনিশ। লোকসাধারণ সবসময় এই জিনিশকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে নাÑ ভিতরদর্শী কবি সময়ের বহু ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেকে বলেন, কবিতার জন্যে জনসাধারণকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। আমি তো মনে করি, সে-সব কোনোদিনই হবে না। কবি যিনি, তিনি কোনো মায়াবীর মতো জাদুবলে, সেই প্রগ্রসর লোকসমাজকেও বহুদূর অতিক্রম করে যাবেন। তা নাহলে তিনি আর কবি কী?’ (বিচিত্রা, কবিতা-সংখ্যা, ৩০ জানুয়ারি ১৯৭৬)
পরাবাস্তব কবিতা বিশ্বের অপরাপর দেশে লেখা হচ্ছে অনেকদিন যাবৎ। পরাবাস্তব কবিতাও যে একটি বিশেষ আসন করে নিতে পারে কবিতায়Ñ বাংলাদেশে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দই সেটা প্রথম প্রমাণ করেছেন। এ ধারার সফল কবিতা আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। এক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তত্ত্বগত দিক থেকে বিচার করতে গেলে তাঁর আধুনিকতার বোধ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ কাঠামোগত অর্থে তাঁর দার্শনিক অবস্থান খুব স্পষ্ট রূপ লাভ করেনি। যদিও পরাবাস্তবতাবাদ তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তাঁর সমাজবোধও নয় সম্পন্ন অর্থে বিজ্ঞানদৃষ্টিসম্পন্ন। কিন্তু একটা দার্শনিকতা এবং একটা সমাজবোধ যে তাঁর নিজের মতো করে ছিল তা তাঁর সমগ্র সাহিত্যকে পর্যবেক্ষণ করলে লক্ষ্য করা যাবে। সে-কারণেই আধুনিক সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে যখন তিনি সমসাময়িক মুসলিম সাহিত্যিকদের নাম নিয়ে আসতেন তখন অনেকেরই ভ্রু কুঞ্চিত হতো! কারণ নিজের মতো করে তিনি কৃষিনির্ভর গ্রামনির্ভর সমাজে অসম্পন্ন আধুনিকতার অভিমুখরেখাকে আমলে নিয়েই তিনি সাহিত্যের পর্যালোচনা করতেন। এভাবে না দেখলে বাংলাসাহিত্যের ভূগোলকে তাঁর কাছে সম্পন্ন মনে হতো না। (আবদুল মান্নান সৈয়দ : তাঁর আধুনিকতা, আহমাদ মাযহার, আর্টস বিডি২৪.কম, ০৪ আগস্ট ২০১৫)
আবদুল মান্নান সৈয়দের সাতষট্টি বছরের জীবনে লেখালেখির বয়স ছিল অর্ধশত বছরের। তার কবিতায় প্রিয় সাংকেতিক দু’টি প্রতীক ‘ভূত’ ও ‘জ্যোৎ¯œা’। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ থেকে ‘অঘ্রানের নীল দিন’ পর্যন্ত সব কবিতার বইয়ে তার এই প্রিয় প্রতীক দু’টির ব্যবহার যে কারো চোখ এড়িয়ে যাবে না। আধুনিক কবিতার কবি হিসেবে সব শর্তের, সব সীমায় তাঁকে আঁটকানোর পরেও কবিতা নিয়ে ভাবনাশ্রয়ী গুণীজনেরা তাঁকে ‘পরাবাস্তবের কবি’ বলেছেন। সেকারণেই আবদুল মান্নান সৈয়দ তার সময়ের এবং এখনো অন্যদের থেকে আলাদা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।