Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

‘দি ফল অব আমেরিকা’ এবং সাম্প্রতিক বাস্তবতা

প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটি সভ্যতার পতন এবং ধ্বংসস্তূপের উপর আরেক সভ্যতা গড়ে উঠেছে। বিজয়ী শক্তি ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে আত্মবিশ্বাস ও আত্মর্যাদাবোধ হারিয়ে অবক্ষয়ের শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের পতন ত্বরান্বিত করেছে। এখানে বিজয়ী শক্তির সামরিক-রাজনৈতিক কূটকৌশলের চেয়ে বিজিত শক্তির অন্তক্ষরণের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে উঠতে দেখা যায়। হেরোডটাসের জন্মের আগে প্রাগৈতিহাসিক যুগে মিশরে ফারাও সম্রাটদের পতন, ফিনিসীয়-আক্কাদীয় সভ্যতার পতনের ধারাবাহিক ইতিহাস অনেকটা দুর্লভ হলেও প্রাচীন গ্রীস থেকে রোমান-বাইজান্টাইন এবং অটোমান সা¤্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস অনেকটাই স্পষ্ট। গ্রীসের হাজার বছরের গৌরবময় শৌর্যের শেষপ্রান্তে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রোমান সম্রাটদের হাতে গ্রীসের পতনের মধ্যদিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের বিজয়গাথা রচিত হয়। ঐতিহাসিক গিবনের মতে, সেই রোমান সাম্রাজ্য প্রায় ৫০০ বছর দুর্দা- প্রতাপে টিকে থাকার পর ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইনদের হাতে পতিত হয়। বাইজান্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটে ২১ বছর বয়সী ৭ম উসমানীয় সুলতান মেহমুদ দ্য কনকোয়ারর’র হাতে। বাইজান্টাইনকে ইষ্টার্ন রোমান সাম্রাজ্যের অংশ বলেই বিবেচনা করা হয়। সে অর্থে প্রায় দুই হাজার বছরের গ্রীক সভ্যতার পর রোমান সভ্যতার স্থায়ীত্বকাল ছিল প্রায় দেড় হাজার বছর। আর রোমান, বাইজান্টাইন ও পারস্য সা¤্রাজ্যের উপর গড়ে ওঠা অটোমান সা¤্রাজ্য বা উসমানীয় সা¤্রাজ্যের স্থায়ী ছিল প্রায় ৭০০ বছর। অতিমাত্রায় যুদ্ধব্যয় এবং জনগণের উপর বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে বাইজান্টাইন স¤্রাটরা নিজেদের সা¤্রাজ্যকে ভেতর থেকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তুলেছিল। অটোমানরা কনস্টান্টিনোপল দখলের পর ইউরোপে স্পেন-আন্দালুসিয়ার বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয়ার পর সেখানকার খ্রিস্টানদের উপর জোর জবরদস্তিমূলক ইসলাম ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার কোন চেষ্টা না করলেও বিজিত অঞ্চল থেকে খ্রিস্টান বুদ্ধিজীবী, ধর্মবেত্তা ও অ্যাকাডেমিসিয়ানরা ইতালী, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় শহরে অভিবাসন গ্রহণ করে বলে কোন কোন ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়। কনস্টান্টিনোপল থেকে বেরিয়ে আসা এসব ইন্টেলেকচুয়ালরাই পরবর্তিতে ইউরোপীয় রেনেসাঁর অনুঘটক হয়ে উঠেছিলেন বলে জানা যায়। সে বিষয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। এখানে স্মতর্ব্য বিষয় হচ্ছে, গ্রীস থেকে রোমান-বাইজান্টাইনের পতন ইসলামের বিস্তার এবং প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯১৮-’২০ সালে উসমানীয় খিলাফতের পতন পর্যন্ত প্রতিটি সা¤্রাজ্যের ব্যপ্তি ছিল হাজার বছরের। একেকটি সা¤্রাজ্য গড়ে ওঠা, স্থিতি এবং পতনের জন্য শত শত বছরের পর্যায়ক্রমিক ইতিহাস রয়েছে।
বিশ্ব সভ্যতার পুরনো ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সা¤্রাজ্যবাদের ক্রমবিস্তারের মধ্যদিয়ে শত বছরে উসমানীয় খিলাফতের পতনের পর আধুনিক ঐতিহাসিকরা একটি অপরিণত মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছেন বটে, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ একটি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পরিকাঠামো ছাড়া আর কিছুই নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত বিশ্বে ‘নিউওয়ার্ল্ড অর্ডার’ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরির ধারণা বিশেষত পশ্চিম ইউরোপ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উপর চাপিয়ে দেয়া হলেও পঞ্চাশের দশকে কোরীয় যুদ্ধ, ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের মধ্যদিয়ে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের ভিত্তি মজবুত হওয়ার আগেই অনিশ্চিত যাত্রায় সামিল হয়। মূলত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের মধ্যদিয়ে অর্থনৈতিক ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে মার্কিনীরা লড়াই আমেরিকন রেভ্যুলেশন করে লিবারেল ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা করলেও ঔপনিবেশিকতার ¯্রােতে ভেসে আসা পুঁজিবাদ ও কর্পোরেট অলিগার্কিও মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গভীরভাবে শেকড় গেড়েছিল। পুঁজিবাদের সেই কর্পোরেট আগাছা মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদারদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাম্যনীতির মহীরূহকে ধসিয়ে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বাকি দুনিয়ার উপর একচ্ছত্র পুঁজিতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আটলান্টিকের সীমা পেরিয়ে একের পর পররাজ্য গ্রাস করতে গিয়ে শুরু থেকেই মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ পতনের আশঙ্কায় পতিত হয়। দেশে দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ ও মতপার্থক্যকে পুঁজি করে একপক্ষে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার মার্কিন নীতির প্রতি সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের সমর্থন ছিল না। ভিয়েতনামে উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মার্কিনীরা ২০ বছরব্যাপী গণবিধ্বংসী যুদ্ধে পরিণত করে। ১৯৫৪ সালে শুরু হওয়া ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রলম্বিত করা হয়েছিল শুধুমাত্র মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স (এমআইসি)’র ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য। এমআইসির মুনাফা এবং যুদ্ধবাদী অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কখনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে স্থিতিশীল অবস্থান নিশ্চিত হতে দেয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন রাজনীতিতে এমআইসি এবং কর্পোরেট পুঁজিবাদের প্রতিনিধিরা একের পর এক চরমপন্থি ইস্যু তৈরি করেছে এর প্রতিটি ইস্যুই যুক্তরাষ্ট্রকে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকার সম্ভাবনাকে দুর্বল ও অনিশ্চিত করেছে। পঞ্চাশের দশকে উইসকনসিনের রিপাবলিকান সিনেটর যোসেফ ম্যাকার্থার মার্কিন প্রশাসনের ভেতর কমিউনিস্টদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ব্যাপকহারে ডিপোর্টেশন করার প্রস্তাব দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। মার্কিন ইতিহাসে ম্যাকার্থিজম নামে পরিচিত এই রাজনৈতিক ফর্মুলা প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান ভালোভাবেই গলাধঃকরণ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে হাজার হাজার চীনা বংশোদ্ভূত শিক্ষক-ছাত্র, বিজ্ঞানী, শিল্পোদ্যোক্তাকে জোর করে বের করে দেয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কৃত এই চীনা দক্ষ ও অভীজ্ঞ জনশক্তি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত গণচীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার নতুন শক্তি হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কৃত চীনা নাগরিকরা চীনের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিশাল অবদান রেখেছিল। ইতোমধ্যে চীনের বাণিজ্য ও অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সমাজ মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদারদের স্বপ্নের রিপাবলিক বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখলেও এখন তারা যেন সে কথা অনেকটা ভুলতে বসেছে। তাদের মধ্যে ক্রমাগত ক্ষোভ ও হতাশা পুঞ্জীভূত হতে হতে একটি বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। ম্যাকার্থিজম থেকে ইসলামোফোবিয়া এবং রিপাবলিকানদের মুসলিমবিদ্বেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনকেই ত্বরান্বিত করেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন বিট জেনারেশনের অন্যতম প্রধান কবি অ্যালেন গিনসবার্গের একটি যুদ্ধবিরোধী কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন ‘দি ফল অব আমেরিকা’। ১৯৬৫ সাল থেকে একাত্তরের নভেম্বর সময়কালে লিখিত প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ যে কবিতাটি স্থান পেয়েছিল তার নাম ‘সেপ্টেম্বর ইন যেশোর রোড’। একাত্তর সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া শরণার্থী এবং যুদ্ধের বিভীষিকা নিয়ে লেখা এই কবিতাটি এখন জনপ্রিয় সঙ্গীতে রূপ দেয়া হয়েছে। অ্যালেন গিনসবার্গ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের কপট ভূমিকার কথা কবিতায় তুলে ধরেছেন। মার্কিন বিট জেনারেশনের লেখকরা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যুদ্ধনীতি, কর্পোরেট গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী হলেও গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী মূল্যবোধের মূলধারাকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন। গিনসবার্গ তার ফল অব আমেরিকা কাব্যগ্রন্থটি উনবিংশ শতকের মার্কিন জাতীয়তাবাদী কবি ও লেখক ওয়াল্ট হুইটম্যানকে উৎসর্গ করেছিলেন।
ম্যাকার্থিজম এবং ভিয়েতনামযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সায়গনের পতনের মধ্যদিয়ে আমেরিকান সা¤্রাজ্যবাদের যে পতন শুরু হয়েছিল একবিংশ শতকের একেবারে শুরুতে ২০০১ সালে নাইন-ইলেভেন বোমা হামলা এবং তথাকথিত ‘ওয়ার অন টেররিজম’র মধ্যদিয়ে তার একটি পরিণতি লাভ করেছে এই যুদ্ধে মার্কিনী ও পশ্চিমাদের সামরিক ও কৌশলগত পরাজয় ঘটেছে। ২০১৬ সালে ৫৮তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় এবং তার অভিবাসনবিরোধী ও মুসলিমবিদ্বেষী ফ্যাসিবাদী ভূমিকা মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতন আরো ত্বরান্বিত করবে। দেড়শ’ বছর আগে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের হত্যাকা-ের মধ্যদিয়ে মার্কিন গণতন্ত্র পুঁজিবাদী পাওয়ার এলিটদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। ডেমোক্রেটদলীয় প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন সেই রাজনৈতিক ধারারই প্রতিনিধি। তিনি মার্কিন সমাজের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি এবং কর্পোরেট অর্থনীতির গতানুগতিক ধারাকে এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দায়িত্ব গ্রহণ করতে চেয়েছেন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে গ্লোবালাইজড ওপেন মার্কেটে মার্কিন অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর বিকল্প চিন্তা হচ্ছে ওখান থেকে লাখ লাখ আনরেজিস্টার্ড অভিবাসীকে বিদায় করে দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের জন্য কর্মক্ষেত্র প্রশস্ত করা। সেই সাথে কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের প্রাধান্য আরোপ করাও ট্রাম্পের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল। বোস্টন বন্দরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চায়ের চালানে আগুন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার সংগ্রাম বিজয় লাভের প্রায় শত বছর পর ১৮৬১-৬৫ সালে সিভিল ওয়ার শুরু হয়েছিল মূলত দাসত্ব প্রথা ও শ্বেতাঙ্গদের প্রাধান্য রক্ষাকে কেন্দ্র করে। ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্র পক্ষশক্তির জয় এবং কনফেডারেশনপন্থিদের পরাজয়ের মধ্যদিয়ে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটলেও মার্কিন সমাজের ভেতরকার সেই বিভেদ যেন এখনো রয়ে গেছে। আমেরিকান স্বাধীনতার যুদ্ধ, সিভিল ওয়ার এবং স্পেনিশ-আমেরিকান ওয়ার পর্যন্ত প্রতিটি যুদ্ধে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ও শিল্পায়নসহ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার প্রতিটি কর্মকা-ে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রো-আমেরিকানদের অবদান অবিস্মরণীয়। সত্তুরের দশকে মার্কিন রেগি তারকা গায়ক বব মার্লির ‘বাফেলো সোলজার’ গানের লিরিক্সে বাফেলো সোলজার নামে পরিচিত নবম ক্যাভালরি ডিভিশনের কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। প্রথম ছত্রের শেষ দু’লাইনে ‘স্টোলেন ফ্রম আফ্রিকা, ব্রট টু আমেরিকা/ ফাইটিং অন অ্যারাইভাল, ফিইটিং ফর সারভাইবাল’ মার্কিন ইতিহাসের সেই অগ্রঘেনানিরা এখনো সারভাইবালের জন্য যুদ্ধ করছে। ব্রিটিশ ও স্পেনিশ ঔপনিবেশিকরা আফ্রিকা ও এশিয়া থেকে কালো মানুষদের ধরে জাহাজ ভর্তি করে আমেরিকায় এনেছিল সেখানকার উদীয়মান কৃষি, শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রয়োজনীয় শ্রমিকের চাহিদা পূরণের জন্য। মূলত এসব দাস বিক্রির পুঁজি ও শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক সা¤্রাজ্যবাদ অর্থনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করেছিল। উনবিংশ শতকে মার্কিন শিক্ষাবিদ বুকার টি ওয়াশিংটন এবং বিংশ শতকে বারাক ওবামার পরিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রো-আমেরিকান ক্রীতদাস এবং ইমিগ্রান্টদের দুই সমুজ্জ্বল প্রতিনিধি। এবারের মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের কনভেনশনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচ- মুসলিমবিদ্বেষী ও অভিবাসনবিরোধী বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে পাকিস্তান থেকে অভিবাসী পরিবার খাইজার খান ট্রাম্পের প্রতি শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। খাইজার খানের একমাত্র পুত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে ইরাকে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইরাকি গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছেন। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সিভিল ওয়ার থেকে শুরু করে চলমান ‘ওয়ার অন টেররিজম’ পর্যন্ত প্রতিটি যুদ্ধ ও দেশ গড়ার ইতিহাসের সাথে আফ্রো-আমেরিকান, এশিয়ান এবং মুসলমানরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
যুদ্ধবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং কর্পোরেট কালো অর্থনীতির ক্রীড়নকে পরিণত হওয়ার মধ্যদিয়ে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ পতনের পথ বেছে নিয়েছে। ২০১০ সালে একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধে মার্কিন গবেষক ও ইতিহাসবিদ, উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আলফ্রেড ম্যাককয় আগামী ২৫ বছরের মধ্যে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতনের একটি রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তী ৪০ বছরের মধ্যে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতনের একটি ধারণাকে খ-ন করে তিনি বলেন, ২৫ বছর বা তারও কম সময়ের মধ্যে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতন ঘটলে বিষ্ময়ের কিছু থাকবে না। সে সময় (২০১০ সাল) পরিচালিত এক জনমত জরিপে দেখা যায়, সাধারণ মার্কিনীদের শতকরা ৬৫ ভাগ মনে করণে তাদের দেশ ক্রমে অবনতির দিকে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমরশক্তি, শিল্পবাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা এখন চীন এবং রাশিয়ার মত ট্রাডিশনাল মার্কিনবিরোধী শক্তির কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ববাণিজ্যে মার্কিনীরা এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীনের পেছনে তৃতীয় নম্বরে নেমে গেছে। কোন সংরক্ষণবাদী নীতি ও কর্মপরিকল্পনার মধ্যদিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক-সামরিক পরাশক্তি হয়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ ও স্পেনিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশ থেকে কোটি কোটি ইমিগ্রান্ট নাগরিক আমেরিকাকে একটি নতুন বিশ্বশক্তিতে পরিণত করেছিল। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পদের মত নব্য প্রজন্মের একশ্রেণির মার্কিন নেতৃত্ব অভিবাসী ও অশ্বেতাঙ্গদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করে আমেরিকাকে আবারো উচ্চ মর্যাদার আসনে (টু মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) সমাসীন করার অলীক স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। গত বছর প্রকাশিত এক নিবন্ধে একজন মার্কিন লেখক ৫টি কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনের আশঙ্কা তুলে ধরেছিলেন। এগুলো হচ্ছেÑ ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ ও বাজেট ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান কেন্দ্র শাসিত সরকারব্যবস্থা, অতিরিক্ত ও ক্রমবর্ধমান ইনকাম-ট্যাক্স, নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় এবং পশ্চাৎপদ অভিবাসন নীতি। এসব বিষয়ের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবনতিশীল পরিস্থিতি সাধারণ ধারণার চেয়ে অনেক বেশি আশঙ্কাজনক। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দায়-দেনা খাতের সামাল দিতে সমগ্র বিশ্বের জিডিপি’র ২০ ভাগের সমান ব্যয় করতে হবে। মার্কিন সরকারের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং সাংবিধানিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত রাজনীতিকদের দুর্নীতি পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। মার্কিন সাংবাদিক, পলিটিক্যাল স্যাটায়ারিস্ট প্যাট্রিক জেইক ওরাউরকের বলেন, ‘হোয়েন বায়িং অ্যান্ড সেলিং আর কন্ট্রোল্ড বাই লেজিসলেশন, দ্য ফার্স্ট থিংগস টু বি বট অ্যান্ড সোল্ড আর লেজিসরেটরস’। সংবিধান ও আইন প্রনেতারা কেনা-বেচা হওয়ার বাস্তবতা শুধু আমেরিকা নয় পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বত্র এই বাস্তবতা বিরাজমান। সদ্য নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত কোন সরকারি অফিস পাওয়ার আগেই একজন ব্যবসায়ী হিসেবে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস বলেছিলেন, আমাদের সংবিধান রচিত হয়েছিল শুধুমাত্র নৈতিক মানসম্পন্ন ধার্মিক মানুষদের জন্য, অন্যদের জন্য এই সংবিধান প্রযোজ্য বা যথেষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আজকের বাস্তবতা হচ্ছেÑ সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে সেখানে এখন শতকরা ৪১ ভাগ শিশুর জন্ম হয় পিতা-মাতার বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে। অন্যদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে, শতকরা আশিভাগ সম্পদ, শতকরা একভাগ কর্পোরেট পাওয়ার এলিটের হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পরা সমস্যার মূল উৎস থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে বর্ণবাদী ইস্যুগুলোকে ব্যবহার করছেন। এভাবে প্রকারান্তরে মার্কিন সমাজে হেইট ক্রাইম ও অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। একটি অপরিণত পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদকে ফ্যাসিবাদে রূপান্তরের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন এখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়াছে। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মার্কিন নাগরিক সমাজের অভূতপূর্ব অসন্তোষ ও গণবিক্ষোভ বিশ্বের সামনে মার্কিন গণতন্ত্রের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করছে। গত ৫০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক-অর্থনৈতিক সার্মথ্য নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর সেখানকার রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঘাটতি উন্মোচিত হওয়ার মধ্যদিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ‘দি ফল অব আমেরিকা’ এবং সাম্প্রতিক বাস্তবতা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ