Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নতুন জোটের ৫ ও ৯ দফা : বিএনপি পাকে পড়েছে, ব্যাঙেও লাথি মারছে

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

কথায় বলে যে হাতি পাঁকে পড়লে নাকি বাঙেও লাথি মারে। বিএনপির এখন হয়েছে সেই দশা। রাজনীতির অঙ্গনে বিএনপি অবশ্যই একটি হাতি। কিন্তু সেই বিএনপি পাঁকে পড়েছে। দলটির অবিসংবাদিত নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছর জেল দেওয়া হয়েছে। তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ১০ বছর জেলা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অনেক দিন আগেই মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকার তাকে জানে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। রাখে আল্লাহ মারে কে, মারে আল্লাহ রাখে কে। সে যাত্রা তারেক রহমান প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তার জেল হওয়ায় দেশে আসলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং জেলখানায় নিক্ষেপ করা হবে। এর মধ্যে আবার ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে মাস্টার মাইন্ড হিসাবে দেখানো হচ্ছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের যে কোনো দিন ঐ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সহ আওয়ামী লীগের হোমরা-চোমরারা বলছেন যে, এই মামলায় যে রায় ঘোষণা করা হবে তার ফলে বিএনপি আর এক দফা বড় বিপর্যয়ে পড়বে। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন যে, এই মামলায় বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ফাঁসি হতে পারে। আমার হিসাব-নিকাশ বলে যে, বেগম খালেদা জিয়ার ফাঁসির আদেশ হবে না। তবে তারেক রহমানের গুরুদন্ড হতে পারে।
দলের এই দুই শীর্ষ নেতা ছাড়াও বিএনপির তৃণমূলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা করা হয়েছে। বিগত ৫টি বছর ধরে এই লক্ষ লক্ষ কর্মী তাদের বাড়ি ঘরে থাকতে পারছেন না। তারা সকলেই ফিউজিটিভ বা পলাতক। আজ রাতে এর বাসা, কাল রাতে ওর বাসা, এভাবেই তারা তাদের দিন এবং মাস যাপন করছেন। এভাবে কোনো সংগঠন চলতে পারে না। বিগত ৫ বছরে বিএনপির মাটির সাথে মিশে যাওয়ার কথা। কিন্তু মানুষ বিপন্ন বিস্ময়ে লক্ষ করেছে যে, মাথার ওপর ঝুলন্ত তরবারি নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েও বিএনপি তার অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। বিএনপির লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীর মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য একজনকেও সরকার ভাগিয়ে নিতে পারেনি। সংগঠন হিসেবে বিএনপি আজও অক্ষত রয়েছে। শুধু তাই নয়, দিনের পর দিন এই সংগঠনটি শক্তিশালী হচ্ছে। এখন খালেদা জিয়া নাই, তারেক রহমান নাই। কোনরূপ পাবলিসিটি ছাড়া মির্জা ফখরুল ডাকলেও মাত্র ১২ ঘণ্টার নোটিশে বিএনপির জনসভায় লক্ষ মানুষ জড়ো হয়। তেমনি মোবাইল ফোনে খবর দিলেও বিএনপির মানববন্ধনেও অর্ধ লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটে।
দুই
সেই বিএনপিকে বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের ব্যক্তিসর্বস্ব সংগঠনও নানান শর্ত দেয়। বি চৌধুরীর পুত্র মাহি বি চৌধুরী তো আরো এক কাঠি সরেস। তিনি বিএনপির নিকট থেকে ১৫০টি আসন দাবি করেন। তাদের যদি ১৫০টি আসন দেওয়া হয় তাহলে বিএনপির কি থাকলো? ২০ দলের শরিক দলসমূহের দাবি ১০০টি সিট। তাহলে বিএনপি কি ৫০টি সিট রেখে মাইক্রোস্কোপিক মাইনরিটি হয়ে বসে থাকবে? তারপরেও আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই যে, ১৫০টি সিট তারা নেবেন, কিন্তু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মুক্তি চাইবেন না। তাহলে বিএনপির কি এমন ঠেকা পড়ে গেছে তাদের সাথে জোট বাঁধতে। তাদের শক্তিমত্তার পরিচয় তো পাওয়া গেছে সেদিন। শনিবার দিন তাদের ৫ দফা ও ৯ দফা ঘোষণা করার কথা ছিলো শহীদ মিনার থেকে। কিন্তু সরকারের ইঙ্গিতে ঢাকা ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাদের শহীদ মিনারের অনুমতি দেয়নি। এই কথা শুনে তারা করলেন এক নাটক। বেলা দুটো থেকেই তারা প্রেস ক্লাবে এসে জড়ো হলেন। তারপর ১০/১৫ জনের এক মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের দিকে রওয়ানা। মনে হয় ২০ কদমও যেতে পারেননি। পুলিশ বললো, আপনারা শহীদ মিনার যেতে পারবেন না। এটি শুনে তারা আবার প্রেসক্লাবে ফিরে আসেন। এই হলো তাদের সাহস, এই হলো তাদের শক্তি। আত্মবিসর্জন দিয়ে, খালেদা এবং তারেকের মুক্তি ইস্যুকে কার্পেটের তলে ঠেলে দিয়ে বিএনপি তাদের সাথে আতাঁত করতে যাবে কেন? বিএনপি কি এতটাই পানিতে পড়েছে?
তিন
এই আতাঁতে লাভ হচ্ছে কার? ১৬ আনা লাভ হচ্ছে যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের। তাদের নেতাদের মধ্যে একমাত্র মাহমুদুর রহমান মান্না ছাড়া আওয়ামী সরকারের আমলে আর কাউকে জেল খাটতে হয়নি। কাউকে পলাতক থাকতে হয়নি। দিব্যি ব্যবসা-বাণিজ্য করে, বহাল তবিয়েতে থেকে, সংসারধর্ম পালন করে এখন তারা ১৫০টি আসনে নমিনেশন নেওয়ার জন্য দুই পায়ে দÐায়মান। বিএনপির এটুকু ‘উপকার’ করার জন্য তাদের কতো আবদার। মৌলবাদীদের সাথে নেওয়া চলবে না। অর্থাৎ তাদের অ্যালায়েন্সে ইসলাম এবং মুসলমানের নামগন্ধ থাকা চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকতে হবে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো ব্যাখ্যা, কোনো সংজ্ঞা আওয়ামী লীগও দিতে পারেনি, তারাও দিতে পারেননি। যেহেতু খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান বিপাকে তাই তারা গোঁফে তা দিয়ে বসে বসে অপেক্ষা করছেন, কবে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর শিকেটি তাদের ভাগ্যে ছিঁড়বে।
যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের এই জোট গঠনের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে যে বিএনপি এই জোটে যোগদান করবে কিনা। বিএনপি যদি এই জোটে যোগদান না করে এবং এক মঞ্চে যদি তারা সভা সমাবেশ মিটিং মিছিল না করে তাহলে শুধুমাত্র যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম মিলে কয়জন লোক হবে? তাদের এই ঐক্য জোট গঠন করার সংবাদ শুনে প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে টিটকারি মেরে বলেছেন, বি চৌধুরী এবং কামাল হোসেনরা যাতে সোহরাওয়ার্দীতে সভা করতে পারেন সে উদ্দেশ্যে তাদের জন্য সেখানে একটি স্থায়ী বক্তৃতা মঞ্চ নির্মাণ করা হবে। কামাল হোসেন ও বি চৌধুরীরা সেখানে ৬০/৭০ জন লোক নিয়ে যত খুশি চিৎকার করুক। লোক সমাবেশ না হলে আমরাই সেখানে লোক দেবো।
প্রধানমন্ত্রীর কথা না হয় ধর্তব্যের মধ্যে নাইবা আনলাম। কিন্তু একথা তো ঠিক যে, বিএনপি তাদের সাথে একমঞ্চে না থাকলে তারা সমাবেশ করার লোক পাবে কোথায়? বাংলাদেশে বিশেষ করে দুটি দলের মিটিংয়ে বা মিছিলে জনসমাবেশ হয়। এর একটি বিএনপি, অপরটি আওয়ামীলীগ। এখন জামায়াতকে নেওয়া হচ্ছে না, কারণ তারা ‘স্বাধীনতা বিরোধী’। কোনো সাম্প্রদায়িক দলকেও নেওয়া হবে না। অর্থাৎ নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলন, চরমোনাইয়ের পীর সাহেবের ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী পার্টি প্রভৃতি দলকেও নেওয়া হবে না। কারণ যেহেতু তাদের রাজনীতিতে ইসলাম রয়েছে তাই তারা বিবেচিত হচ্ছেন সাম্প্রদায়িক হিসাবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কি তাদের সাথে যাবে?
কারণ বিএনপির জন্য এখন এক নম্বর মাথা ব্যাথা হলো তার অবিসংবাদিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কারামুক্তি। অথচ, যুক্তফ্রন্ট-গণফোরামের জোটে যে ৫টি দফা রয়েছে সেখানে বেগম জিয়ার নামগন্ধও নাই। গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেকের গুরুদÐ হবে বলেই আওয়ামী লীগ মনে করে। তারেক জিয়ার যদি গুরুদÐ হয় তাহলে সে ব্যাপারেও যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম কোন কথা বলবে না। অথচ এই দুটি ইস্যুই এখন বিএনপির কাছে প্রধান। এই দুটি ইস্যু নিয়ে বিএনপি যদি মাঠ গরম না করে তাহলে তাদের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা নিষ্ক্রীয় হয়ে যাবে।
বিএনপির সব নেতাই প্রতিটি সেমিনার এবং গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন যে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে তারা নির্বাচনে যাবেন না। আবার তারাই বলেছেন যে, আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। কারণ এটি আইনগত বিষয় হলেও সরকার প্রভাব খাটিয়ে পদে পদে বেগম জিয়ার মুক্তি বিঘিœত করছে। যেহেতু খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি ইলেকশনে যাবে না তাই তাদের এক নম্বর এজেন্ডা হবে খালেদা জিয়ার মুক্তি।
ব্যরিস্টার মওদূদ আহমেদ প্রতিটি সভা-সমিতিতে বলেছেন যে, রাজপথ কাঁপিয়ে তুলতে না পারলে বেগম জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। এ উদ্দেশ্যে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তিনি বিএনপির নেতা কর্মীদের প্রতি বার বার আহবান জানাচ্ছেন। আকার-ইংগিতে এমন কথা বলা হচ্ছে যে, বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য আগামী মাসেই নেতা কর্মীদেরকে রাজ পথে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি যদি রাজ পথে রাজনৈতিক লড়াই শুরু করে দেয় তাহলে সেখানে কি যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম শরিক হবে? আর তারা যদি শরিক না হয় তাহলে বিএনপি তাদের জোটে শরিক হবে কেন?
বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল নিউইয়র্ক হয়ে লন্ডন গেছেন। যখন এই লেখাটি প্রকাশিত হবে তখন তিনি সম্ভবত দেশে ফিরেছেন। লন্ডন থেকে তিনি কি নির্দেশ নিয়ে ফিরে এলেন সেটি তারাই জানেন। নিউইয়র্ক এবং লন্ডন অবস্থান কালে ড. কামাল ও বি চৌধুরীর ৫ দফা ও ৯ দফা তারেক রহমানকে অবহিত করা হয়েছে কিনা এবং এর মধ্যে একই বিষয় কারাগারে বেগম জিয়াকে জানানো হয়েছে কিনা সেটি আমরা জানি না। এই কয়েক দিনে যা কিছু ঘটলো তারপর বিএনপি কি পদক্ষেপ নেয় সেটি দেখার জন্য জনগণ গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে।
[email protected]



 

Show all comments
  • মানিক ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৫:১০ এএম says : 0
    কলামটিতে বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে
    Total Reply(1) Reply
    • Md. Ashraf-Ul-Alam ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১:০৫ পিএম says : 4
      excellent analyisis
  • সাজ্জাদ ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৫:১০ এএম says : 0
    লেখককে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি
    Total Reply(0) Reply
  • Sumon ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:২০ পিএম says : 1
    BNP আপনাদের সকল হিসাব নিকাশ ভুল প্রমান করবে - কারন এ দলটি সত্য ও দেশপ্রেমের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে ।
    Total Reply(0) Reply
  • Imamul Hoque Jahangir ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:২১ পিএম says : 0
    সিরোনাম আমার পচন্দ হয়েছে। বিএনপি আরো দশ বৎসর ক্ষমতায় না আসলেও এদের সাথে জোটের দরকার নেই। তারা নিজেদের কি ভাবে?
    Total Reply(0) Reply
  • Mahamudul Hasan ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:৩৩ পিএম says : 0
    মনের কথা লিখেছেন। দলের প্রতি কারো ভালোবাসা কমে নি। সালাম সব জাতীয়তাবাদী ভাইদের।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Juber Ahmed Juber ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:৩৩ পিএম says : 0
    কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক বিএনপি যেন সিদ্ধান্ত নেয় আর না হয় মারাত্মক সংকট দেখা দিবে
    Total Reply(0) Reply
  • Mahbob Rahman ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:৩৭ পিএম says : 0
    একদম মনের কথা লিখেছেন স্যালুট আপনাকে
    Total Reply(0) Reply
  • Imam Hossain ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:৩৮ পিএম says : 0
    অসংখ্য ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • Md Jafor Ullah ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:৩৯ পিএম says : 0
    BNP ke kowsholi hote hobe
    Total Reply(0) Reply
  • Citizen ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১০:৫২ পিএম says : 0
    Thanks for the justified analysis. In the name of greater unity they wants to break and divide 20 party alliance. People think their activity is in favor of govt in place of public. BNP should not give them scope to materialize lig ambition.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিএনপি


আরও
আরও পড়ুন