পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঢাকার চিত্র দেখলে যে কারো মনে হতে পারে, কোনো দেশের রাজধানী এমন হতে পারে না। মনে হবে, এ যেন এক বিশৃঙ্খল নগরী, যেখানে কোনো নিয়ম-নীতির বালাই নেই। সড়কের দিকে তাকালে মনে হবে, এগুলো যেন ছোট ছোট খালে পরিণত হয়েছে। এমন কোনো সড়ক নেই যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করে নালা বানিয়ে রাখা হয়নি। উন্নয়নের নামে যেভাবে খুশি সেভাবে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তাতে বৃষ্টির পানি জমে মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে। এমন রাজধানী বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। অথচ বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই ঢাকাই স্বপ্নের শহর। প্রতিদিনই এর টানে হাজার হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রবেশ করছে। তাদের আশা, একবার ঢাকায় পৌঁছতে পারলে আর চিন্তা নেই। কিছু একটা করেকেটে খেতে পারবে। ফলে জনভারে দিন দিন ঢাকা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বর্তমানে এর জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০৩৫ সালে এর জনসংখ্যা হবে আড়াই কোটি। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ ঢাকায় বসবাস করে। এর মধ্যে ৪০ লাখের বেশি মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। ভাসমান অবস্থায় রয়েছে আরও কয়েক লাখ। রাজধানীর এই করুণ দশা নিয়েই মধ্যম আয়ের দেশ থেকে শুরু করে উন্নত দেশের আশা করা হচ্ছে। ঢাকার প্রতি মানুষের এতই টান যে জীবনজীবিকার তাগিদে যেসব বাংলাদেশী প্রবাসে বসবাস করে, তাদের মনও পড়ে থাকে ঢাকায়। প্রখ্যাত আইরিশ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েস প্রবাসকালীন জীবনে তার প্রিয় শহর ডাবলিনকে প্রতি মুহুর্তে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন, এর স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। ডাবলিনকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি যদি ডাবলিনের হৃদয় স্পর্শ করতে না পারি, তবে বিশ্বের আর কোন শহরের হৃদয় স্পর্শ করতে পারব না।’ ঢাকাকে নিয়েও সাধারণ-অসাধারণ মানুষের মধ্যে এমন আকুতি প্রতি নিয়তই ঝরে পড়ে। তারা প্রিয় শহরকে অনুভব করে। যত সমস্যা থাকুক না কেন, এ শহর ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। সবাই ঢাকায় থাকতে চায়। ফলে ঢাকা অনেকটা মৌচাকের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৌমাছির মতো সারাদেশের মানুষ ঢাকার দিকে ছুটছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ প্রবেশ করে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের স্থান সংকুলান, কর্মসংস্থান, চিকিৎসাসেবা, শিক্ষাসেবাসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা দেয়া ঢাকার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তাদের ভার বইতে গিয়ে ঢাকা হয়ে পড়েছে ক্লান্ত-শ্রান্ত। জনসাধারণের মনে যদি এই মনোভাব কাজ করে, কোন রকমে ঢাকা পৌঁছতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তবে তা কোনভাবেই ভারমুক্ত হবে না। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের বসবাস অযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকা বেশ কয়েকবার চিন্হিত হয়েছে। ২০১২ এবং ২০১৩ সালে পরপর দুইবার দুই নম্বর স্থানে ছিল। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবার মান, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো-এই পাঁচটি মূল বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ১০০ পয়েন্টের সূচকে সর্বনিম্ন ৩৮.৭ পয়েন্ট পেয়ে ঢাকা বিশ্বে বসবাস অযোগ্য শহর হিসেবে চিিহ্নত হয়। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত একই প্রতিষ্ঠানের জরিপে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য শহরে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ প্রায় সবকিছুরই অবনতি ঘটেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের সূচকের চেয়েও ঢাকা দুই ধাপ পিছিয়েছে। ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৯। গত বছর ছিল ১৩৭। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ঢাকা পেয়েছে ৩৮ পয়েন্ট। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না আমরা কত ভয়াবহ এক শহরে বসবাস করছি। অথচ ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে নগরবিদ ও বিশেষজ্ঞরা অনেক পরিকল্পনা এবং পরামর্শ দিলেও তাতে কোন লাভ হয়নি।
দুই.
যে কোন দেশের রাজধানীর চিত্র সেদেশের সভ্যতা ও উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। চেহারায় যেমন মানুষের মনের ভাব ফুটে উঠে, তেমনি রাজধানীর চিত্র দেখে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা যায়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পিছিয়ে থাকা এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেগুলোর রাজধানীর চিত্র ঢাকার চেয়ে সুশৃঙ্খল, পরিপাটি ও বাসযোগ্য। মেট্রোপলিটান সিটি বা মাদার সিটি বলতে যা বোঝায়, ঢাকায় তার সবকিছু থাকলেও সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিত নয়। অনেকটা পরিত্যক্ত শহরের মতো। একটি মেট্রোপলিটান সিটি’র মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া। সুদীর্ঘকাল ধরে ঢাকা মেগা বা মাদার সিটি হিসেবে পরিচিতি পেলেও এর গঠন ও বিন্যাস পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেনি, গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগও খুব একটা দেখা যায় না। অপরিকল্পিতভাবে এর বিস্তৃতি ঘটে চলেছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত মানের নয়। প্রতিদিনই রাজধানীকে যানজটে স্থবির হয়ে পড়তে দেখা যায়। গবেষণায় উঠে এসেছে, শুধু যানজটের কারণে প্রতিদিন দেশের প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এই বিপুল ক্ষতির বোঝা সামগ্রিক অর্থনীতিকে সুদীর্ঘকাল ধরেই বয়ে চলতে হচ্ছে। বলা যায়, যানজট অর্থনীতির ক্ষত হয়ে আছে। সাধারণত আন্তর্জাতিক মানের একটি শহরে চলাচলের জন্য ২৫ ভাগ রাস্তা থাকে। ঢাকা শহরে রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ। যানজট সহনীয়মাত্রায় রাখা, স্বচ্ছন্দ চলাফেরা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখার জন্য যে পরিমাণ রাস্তার প্রয়োজন ঢাকায় তা নেই। যেটুকু আছে, তাও বিভিন্নভাবে দখল হয়ে আছে। নগরবিদরা মনে করছেন, বিদ্যমান রাস্তাগুলোকে যদি পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবহার করা যেত, তাতেও যানজট অনেকাংশে সহনীয়মাত্রায় রাখা যেত। নগর বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘যানজট ঢাকার প্রধান সমস্যা। একটি নগরের প্রধান দিক হলো পরিবহণ ব্যবস্থা। ২০০৬ সালে একটি পরিবহণ কৌশলপত্র নেয়া হয়েছিল, যেটি অনুমোদিত হয়। সেখানে মেট্রোরেল, কমিউটার ট্রেনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। যানজট নিরসনে এসব অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ আগে বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তবে যানজট নিরসনে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে রয়েছে, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, রাস্তার মাঝপথে বাস থামিয়ে যাত্রী-উঠানাম করানো, রাস্তায় বাজার বসা, ফুটপাত দখল এবং ট্রাফিক নিয়ম না মানার প্রবণতা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটু তৎপর ও সদিচ্ছা পোষণ করলেই এসব সমস্যার সামাধান সহজেই করা যায়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ৫৫টি প্রতিষ্ঠান দুর্বল, তাদের কাজের সমন্বয়ের কৌশলও অকার্যকর। ঢাকার উন্নয়নের জন্য যেসব পরিকল্পনা অতীতে নেয়া হয়েছে, সেগুলো আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে, রাজধানীর সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠান অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ নগরবাসীকে এসব প্রতিষ্ঠানকে ঠিকই সেবার ট্যাক্স দিয়ে যেতে হলেও তারা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য রাজধানীবাসীর আর কী হতে পারে!
তিন.
ঢাকার ক্ষতির বেশিরভাগ এর বাসিন্দারাই করছে। এক সময় ঢাকার শিরা-উপশিরা হিসেবে পরিচিত প্রায় ৪৬টি ছোট-বড় খাল ছিল। এসব খাল নগরীর সৌন্দর্য, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং ঢাকাকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও সজীব রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কয়েক যুগ ধরে অবৈধ দখলকারীদের কবলে পড়ে সেগুলোর সিংহভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেখানে খাল ছিল, সেখানে সড়ক ও বড় বড় ইমারত গড়ে উঠেছে। বোঝার কোনো উপায় নেই যে এখানে এক সময় প্রবাহমান খাল ছিল। এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, গত এক যুগে ঢাকার জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চলের ৯০ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। ঢাকার প্রাণ বলে খ্যাত বুড়িগঙ্গা দখল ও দূষণের কবলে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নদীটি নিয়ে এত টানাহেঁচড়া চলছে যে, একদিকে দখল ও ভরাট করে স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে, অন্যদিকে রাজধানীর আবর্জনা ও শিল্পবর্জ্য নিক্ষিপ্ত হয়ে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। পরিবেশবিদরা বলেছেন, ঢাকার নদী ও খালগুলো রক্তনালির মতো। ঢাকা শহরকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে খালগুলো সচল রাখা প্রয়োজন। খাল, নালা, বিলসহ বিভিন্ন জলাভূমি ও প্লাবনভূমির অস্তিত্ব বিলোপ হলে রাজধানীর পরিবেশে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে। মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। এসব সমস্যা উত্তরণে রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়ন করা জরুরী। খাল-নদী দখল যেমন ঢাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে, তেমনি ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে নগরবিদ ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাঝারি মানের ভূমিকম্প হলে রাজধানীর শতকরা ৬০ ভাগের বেশি ভবন ধুলোয় মিশে যাবে। লাখ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটবে। বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে না মেনে অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণের ফলে এই বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঢাকাকে বাসযোগ্য ও নিরাপদ করতে এসব সমস্যা এবং শঙ্কামুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য যত কঠোর হওয়া প্রয়োজন, তত কঠোর হতে হবে। খাল ও নদী দখল করে যারা বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করছে, তারা যত ক্ষমতাবান হোক না কেন, ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে তাদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। তাদের ক্ষমতার দিকে না তাকিয়ে অপরাধী হিসেবে চিিহ্নত করে আইনানুগ শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। জিডিপিতে এর অবদান ২০ শতাংশ। তবে শহরটি পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। শহরে যানজটের কারণে দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। এই বিপুল ক্ষতি দেশের অর্থনীতিকে শ্লথ করে দিচ্ছে। মানুষের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অপরিমেয় ক্ষতি করছে। কর্মশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনিটি প্রধান কারণ ঢাকার উন্নতি-অগ্রগতি ব্যাহত করছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বন্যা ও পানিবদ্ধতা, ঘনবসতি ও এর ঘিঞ্জি পরিবেশ এবং বিশৃঙ্খলা। কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন ঘটালে এই শহর বসবাসের উপযুক্ত হবে। এজন্য এখনই কাজে নামতে হবে। অতীতে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কাজে যেসব দ্বৈততা ও বিশৃঙ্খলা ছিল, তা পরিহার করতে হবে। প্রতিবেদনে পরামর্শ হিসেবে বলা হয়েছে, বন্যা সমস্যা মোকাবিলার জন্য বালূ নদের পূর্ব পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঘিঞ্জি পরিবেশ এড়াতে সড়ক ও পরিবহনব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে আকর্ষণ করার জন্য শক্ত নীতি পরিকল্পনার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এসব করা গেলে বাড়তি ৫০ লাখ মানুষ শহরে সুস্থভাবে বসবাস করতে পারবে এবং ১৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কলকাতা যদি পারে, তবে আমরা কেন পারব না? কলকাতা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এবং নীতি ও ধারণার ঐকমত্য হলে ঢাকাও ঘুরে দাঁড়াবে। তারা উদাহরণ টেনে বলেন, হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ঢাকাকে বদলানোর অন্য পরিকল্পনার বাস্তবায়নও সম্ভব।
চার.
ঢাকার সমস্যা এবং একে বাসযোগ্য করে তুলতে বহু পদক্ষেপের কথা শোনা যায়। বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন নেই। যে সমস্যাগুলো দ্রæত সমাধান সম্ভব, সেগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যার আধিক্য। বিশ্বব্যাংকের এক হিসেবে ঢাকার পশ্চিমাংশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪১ হাজার মানুষ। নিউইয়র্কে প্রতি একরে যেখানে ২৫ থেকে ২৬ জন লোক বসাবাস করে, সেখানে ঢাকায় বসবাস করছে ৫০০ থেকে ৬০০। নগরবিদরা মনে করছেন, ঢাকার উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কমাতে হলে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের বিকল্প নেই। স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করা অত্যাবশ্যক। এতে জেলা-উপজেলার মানুষ যদি তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সেখানে পান, তবে তাদের ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। ঢাকার ভেতরে শিল্পকারখানা স্থাপনে নিরুৎসাহী করতে হবে। রাজধানীর বাইরে আলাদা শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার উন্নয়ন বা উন্নয়ন পরিকল্পনা যেভাবে করা হচ্ছে, জেলা শহরগুলোকেও একইভাবে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার মতোই সমান গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। ঢাকার সাথে জেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থাও সহজ করা প্রয়োজন, যাতে মানুষ ঢাকা এসে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে দিনে দিনে নিজ অবস্থানে ফিরে যেতে পারে। গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-আদালতের সুবিধা, জেলা-উপজেলায় এমনভাবে পৌঁছে দেয়া, যাতে সেখানের মানুষকে ঢাকামুখী না হতে হয়। যদি এমন হয়, একজন রুগীকে উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষার্থীকে উন্নত শিক্ষা, বেকারকে চাকরি, দিনমজুরকে কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকায় ছুটে আসতে হয়, তবে ঢাকাকে কোনভাবেই নির্ভার ও সুষমভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। নিউইয়র্ক শহর থেকে মানুষ ২০০ কিলোমিটার দূরে বসবাস করেও প্রতিদিন অফিস শেষে বাড়ি ফিরে যেতে পারছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেও কলকাতায় অফিস-আদালত ও নিত্যদিনের কাজ করে তারা ফিরে যেতে পারছে। ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও এমন করতে হবে যাতে, দূর দূরান্তের মানুষ ঢাকায় অফিস করে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে স্ট্যান্ডার্ড বা বাসযোগ্য নগরীর যে মানদÐ তুলে ধরা হয়, ঢাকা তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। স্থিতিশিলতা, স্বাস্থ্যসেবার মান, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো-এই পাঁচটি বিষয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ঢাকার স্কোর গড়ে ৪০-এর নিচে। উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী হিসেবে এই স্কোর কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। এই স্কোরকে ধাপে ধাপে উন্নীত করতে না পারলে ঢাকার বাসযোগ্য হয়ে উঠার স্বপ্ন ধূসর এবং ক্রমেই তা দূস্তর হয়ে পড়বে। নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিভাগ, সর্বোপরি সরকারকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের ‘হার্ট’ ঢাকা যদি ভাল না থাকে, তবে দেশের ভাল থাকার কোন কারণ নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।