হাই হিল ফ্যাশান সচেতন নারীদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজকাল মেয়েরা ফ্যাশন নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, পোশাকের সঙ্গে মানানসই হাই হিল জুতা তাদের চাই-ই চাই র্যাম্প মডেল থেকে শুরু করে সাধারণ মেয়েরা সবাই পরেন এই হাই হিল। সৌন্দর্যেও অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে উচ্চতাকে ধরা হয়। তাই জুতার হিলের চাহিদাও বেড়ে গেছে বহুগুনে। কিন্তু ‘সৌন্দর্যবর্ধক’ এই নিরীহ বস্তুটি, হাঁটু এবং পায়ের মারাত্বক ক্ষতি করতে পারে।
ইদানিং এই সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় অল্পবয়সী রোগী আসছেন। তাদের অনেকেই আসছেন গোড়ালি বা হাঁটুর ব্যথা নিয়ে। ইতিহাস জেনে দেখা যাচ্ছে, সব অসুবিধার ম‚লে এই জুতার হিল। অস্বাভাবিক উঁচু হিল পরায় গোড়ালি উঁচু হয়ে থাকে। যখন-তখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে এদিক-সেদিক বেঁকে যায় পা। ফলে হাঁটুতে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে। ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে হাঁটুর মালইচাকির পেছনের কার্টিলেজ। এর কারণে অল্প বয়সেই অস্টিও-আর্থ্রাইটিস দেখা দিচ্ছে ।
গবেষনায় দেখা গেছে গোড়ালি, হাঁটু ও কোমর ঠিক রাখতে মেয়েদের জন্য জুতা বা ব্যাকস্ট্র্যাপ দেওয়া কম হিলের জুতা সব থেকে ভাল। হিল পরার ইচ্ছা হতেই পারে, তবে তার জন্য একটু সতর্ক থাকা প্রযয়োজন। যেখানে অল্প হাঁটতে হবে, সেখানে উঁচু হিল পরা যেতে পারে।
কিন্তু প্রতিদিনের জীবনে হাঁটাহাঁটির ক্ষেত্রে সামান্য উঁচু বা ফ্ল্যাট জুতাই ভাল। কারণ শারীরিক সুস্থ্যতা না থাকলে সৌন্দর্য অধরাই থেকে যাবে। সুতরাং হাই হিল ব্যবহারে একটু সাবধান থাকুন!
আসুন জেনে নিই নিয়মিত হাই হিল ব্যাবহারে কি কি ক্ষতি হতে পারে -
১. পায়ের ছোট ছোট জয়েন্টে ব্যাথা:
অন্যান্য জুতার মতো হাই হিল জুতায় কোনও অভিঘাত শোষণ করার ক্ষমতা থাকে না। তাছাড়া চলার সময় শুধু সামনের দিক ছাড়া পায়ের পাশের দিকটা আড়ষ্ট করে দেয় হাইহিল জুতা। ফলে পা শুধু সোজা রাখা যায়। তাই পদক্ষেপের সমস্ত আঘাত এসে পড়ে হাঁটুর উপর এ থেকেই শুরু হয় পায়ের ছোট ছোট জয়েন্টে ব্যাথা এবং আর্থ্রাইটিসের সমস্যা। তবে হিলের কারণে শুধু হাঁটুর উপর না, গোড়ালির উপরেও অতিরিক্ত চাপ পড়ে। কাজেই সারাদিন হাইহিল পড়ে কাটানোর পরে পায়ের প্রতিটি জয়েন্টে ব্যাথা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
২. পায়ের পেশীর সমস্যা :
এটা হিল জুতার পরার সব থেকে খারাপ দিক, দীর্ঘ সময় যাবত হিল জুতা ব্যবহার করলে গোড়ালি অনেকটা উঁচু হয়ে থাকে। ফলে গোড়ালির সাথে যে পেশীগুলি টেনডনের মাধ্যমে যুক্ত, তারা ছোট হয়ে যায় এবং পেশীগুলির ভিতরে নানা পরিবর্তিত হতে শুরু করে। যার ফলে প্লান্টার ফ্যাসাইটিস এবং একিয়ালিস টেন্ডিনাইটিস নামে রোগ দেখা দিতে পারে।
৩. কোমরে ব্যাথা:
হাইহিল জুতা আপনার গোড়ালিকে উঁচু রেখে কোমরকে অস্বাভাবিক ভাবে সামনে ঠেলে রাখে। প্রকৃতির নিয়মের বিপরীতে দীর্ঘ দিন ধরে এমন অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটা-চালার কারণে মেরুদন্ডের স্বাভাবিক বক্রতা নষ্ট হয়ে কোমরে প্রচন্ড ব্যাথার সৃষ্টি হতে পারে।
৪. পায়ের পাতা শক্ত হয়ে যায়:
প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে গোড়ালি শরীরের সমস্ত ভার বহন করে। সেখানে পায়ের পাতা আপনাকে ভারসাম্য দেয় তার নরম প্যাডের মাধ্যমে। কিন্তু হাইহিল প্রকৃতির এই স্বাভাবিক নিয়মকে লঙ্ঘন করে। উল্টো করে দেয় গোড়ালি আর পায়ের পাতার কাজ। আসলে হাইহিল পড়ার সময় পায়ের পাতা নেয় সমস্ত শরীরের ভার, আর গোড়ালি তখন সহায়ক হয় মাত্র। ফলে ধীরে ধীরে পায়ের পাতা থেকে এই প্যাডের মতো মাংসল অংশটি সরে যায় বা ক্ষয়ে যায়।
৫ গোড়ালির সমস্যা:
খালি পায়ে হাঁটলে পায়ের পাতা ও গোড়ালির উপর দেহের ওজনের ভারসাম্য বজায় থাকে। ফলে গোড়ালির অস্থিসন্ধিতে কম চাপ পড়ে। কিন্তু, হাইহিল জুতো পরলে পায়ের পাতা ও গোড়ালির ভারসাম্য নষ্ট হয়, সেই সঙ্গে গোড়ালির অস্থিসন্ধিতে এসে পড়ে পুরো শরীরের ভার। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই গোড়ালি মচকে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে এবং সৃষ্টি হয় প্রচÐ যন্ত্রণার।
৬. নখকুনির সমস্যা হয়:
এ সমস্যায় প্রায় অনেকেই ভুগে থাকেন। সাধারণত হাইহিল জুতার সামনের দিকটি ছড়ানো না হয়ে নৌকার মতো সরু হয়। উল্টোদিকে, আপনার আঙ্গুলগুলি খানিকটা চৌকা আকারের হয়ে থাকে। ফলে সারা শরীরের ভার আঙ্গুলগুলিকে আরও বাইরের দিকে ঠেলতে থাকে। এতে নখকুনি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। অর্থাৎ পায়ের নখ, ম‚লত বুড়ো আঙ্গুলের নখ সোজা না বেড়ে ঢুকে যায় আঙ্গুলের মাংসের ভিতরে। আর এমনটা হলে কেমন যন্ত্রণা হতে পারে, তা নিশ্চয় আপনার জানা আছে।
তাই হাই হিল ব্যাবহার না করায় ভাল, তবে কেউ যদি দীর্ঘদিন হাই হিল ব্যাবহার এর কারনে কোমর কিংবা পায়ের ব্যাথায় ভুগে থাকেন, তাহলে হাই হিল ব্যাবহার বন্ধ করুন ও দ্রæত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের এর পরামর্শ নিন।
বাত, ব্যথা ও প্যারালাইসিস রোগে ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ
কনসালটেন্ড ও বিভাগীয় প্রধান
প্রো-অ্যাকটিভ মেডিকের কলেজ ও হাসপাতাল,
চীফ- কনসালটেন্ড, ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল
ধানমন্ডি, ঢাকা। মোবাঃ ০১৭৮৭১০৬৭০২