Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

“দৈনিক ইনকিলাবের গেল একযুগ এবং অজানা কিছু কথা”

খা লে দ সা ই ফু ল্লা হ সি দ্দি কী | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

১৯৮৬ সালের ৪ জুন ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর জন্মলগ্ন থেকে ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রæয়ারি ওফাত পর্যন্ত আলহাজ মাওলানা এম.এ. মান্নান (রহ:), পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-মহাপরিচালক-এর শেষের দিনগুলোতে শারীরিক অবস্থার কারণে সক্রিয় থাকতে না পারলেও তাঁর সুযোগ্য উত্তরসুরী এএমএম. বাহাউদ্দীন পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে সম্পাদক হিসেবে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনার অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করতে থাকেন।
‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর জন্মলগ্নের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। এই লেখক ঢাকার একটি প্রাচীনতম বাংলা দৈনিকে কর্মরত থাকাকালে সহকর্মী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বৈঠকি আলাপ-আলোচনাকালে প্রায় লক্ষ্য করেছেন যে, ‘দৈনিক ইনকিলাব’ নামক একখানা বাংলা পত্রিকা প্রকাশের খবরের উপর মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে কেউ কেউ তাচ্ছিল্য করে বলতেন, প্রস্তাবিত দৈনিক আদৌ প্রকাশের মুখ দেখবে কিনা সন্দেহ! যদি প্রকাশিত হয়েও যায়, তার আয়ুষ্কাল বেশি দিন হবে না, অকালেই তা ‘অধুনালুপ্ত’ হয়ে যাবে। যারা মরহুম মাওলানা এম.এ. মান্ননকে বাঁকা চোখে দেখতেন তাদের মুখেও নেতিবাচক মন্তব্যের অন্ত ছিল না। তাদের মন্তব্যের সার ছিল এই যে, তিনি ‘বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন’ নামক মাদ্রাসা শিক্ষকদের একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান মাত্র। সাংবাদিকতার সাথে তাঁর দূরের সম্পর্কও নেই। এমনকি তার এ সংগঠনের খবরাখবর দুই একটি দৈনিক সংবাদপত্র ব্যতীত অপর কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখা যায় না। মোটামুটি ঢাকার সংবাদপত্র অঙ্গনের সর্বত্র এইরূপ নেতিবাচক ধারণাই বিরাজ করছিল প্রবলভাবে। অর্থাৎ ‘দৈনিক ইনকিলাব’ সম্পর্কে একটি নিন্দুকের দল ও সংশয়বাদীদের উদ্ভব হয়ে যায় পত্রিকাটির আত্ম প্রকাশের আগেই।
এ পর্যায়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের ওপর সামান্য আলোকপাত করা, নিকট হতে প্রত্যক্ষ করা এই লেখকেরই নৈতিক দায়িত্ব মনে করি। এ কারণে যে, তা না হলে ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর আত্ম প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অজানা থেকে যাবে। কেননা ‘দৈনিক ইনকিলাব’ এখন বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম। একে বিচ্ছিন্ন রাখার সুযোগ নেই, নিন্দুক-সমালোচকদের সকল প্রকারের টিটকারী, উপহাসকে উপেক্ষা করে ধাপে ধাপে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ এর অগ্রযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপ গবেষণা ও অনুসন্ধানের দুর্লভ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাই ইনকিলাব সংক্রান্ত বহু অজানা বিষয়ে গবেষণার খোরাক হিসেবে সকলের সামনে উপস্থাপিত হওয়া এখন সময়ের প্রয়োজনীয় চাহিদা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের পরবর্তী আলোচনা।
জানা মতে, মরহুম মাওলানা এম.এ. মান্নান তাঁর প্রত্যাশিত ‘দৈনিক ইনকিলাব’ বের করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সকল প্রকারের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পাশাপাশি তিনি প্রকাশনা-সম্পাদনার বিষয়টি প্রধান বিবেচ্য হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এ বিষয়ে পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে কাজ করতে সক্ষম, যোগ্য, নিষ্ঠাবান, দক্ষ, অভিজ্ঞ, কর্মঠ লোক মনোনীত করতে থাকেন। এক্ষেত্রে মাওলানা এম.এ. মান্নান (রহ:)-এর একান্ত ভক্ত, বিশ্বাসী, তাঁর দক্ষিণ হস্ত হিসেবে পরিচিত এবং তাঁর সার্বক্ষণিক জমিয়াত সহকর্মী মাওলানা কবি রুহুল আমিন খান তাকে সহযোগিতা করতে থাকেন। অত:পর সক্রিয় সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন মরহুম এ.কে.এম. মহিউদ্দীন। মাওলানা সাহেবের সাথে তাঁর কোন আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিল না, তখন তিনি ছিলেন ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত। এ সুবাদে মাওলানা সাহেবের সাথে তাঁর পরিচয় সম্পর্ক।
মহিউদ্দীন সাহেব প্রতিদিন ‘দৈনিক আজাদ’-এর দায়িত্ব শেষ করে তাঁর রামপুরাস্থ বাসায় ফেরার পথে মাওলানা এম.এ. মান্নান এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং ‘দৈনিক ইনকিলাব’ প্রকাশের ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতবিনিময় হত। যেহেতু বিষয়টি ছিল মহিউদ্দীন সাহেব এর জন্য অতি গোপনীয়, ‘দৈনিক আজাদ’-এর মালিক বিষয়টি জানলে তা সুনজরে নাও দেখতে পারেন, তাই তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তিনি সহ আমরা সম্পাদকীয় বিভাগের কয়েক জন যেহেতু একই রুমে বসে কাজ করতাম, তাই বিষয়টি আমরা ব্যতীত অফিসের আর কারো জানা ছিল বলে মনে হয় না। তাঁর মুখে আমরা শুনতাম, মাওলানা এম.এ. মান্নান তাঁর প্রস্তাবিত ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর স্টাফ মনোনীত করার দায়িত্ব তাঁকে দিয়েছেন এবং তাঁকে নামের তালিকা পেশ করতে বলেছেন। তিনি তাঁকে আরও বলেছেন যে, পত্রিকা বাজারে ছাড়ার আগে তা পরীক্ষামূলকভাবে ছাপা হবে, মনোনীতদের এই কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে।
মহিউদ্দীন সাহেব ‘দৈনিক আজাদ’-এ কর্মরতদের মধ্যে থেকে বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজনের এবং বাইরেরও কতিপয় সাংবাদিকদের নাম লিখলেন। উল্লেখ্য, ‘দৈনিক আজাদ’-এর ক্ষেত্রে মুশকিল ছিল এই যে, ‘দৈনিক আজাদ’ ছেড়েই তাদেরকে ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এ যোগদান করতে হবে। একসঙ্গে অনেকের বিনা নোটিশে ‘দৈনিক আজাদ’ ছাড়া ছিল তখনকার মত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। এতে মহিউদ্দীন সাহেব ও মালিকের বিরাগ ভাজন হতে পারেন। মাওলানা এম.এ. মান্নান সাহেবও নিজস্বভাবে একটি তালিকা প্রণয়ন করেন বলে অনুমিত হয়। তাদের মধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর প্রকাশনা পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল গফুর সাহেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এ শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত তিনি প্রধান ফিচার সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। মহা সম্পাদক হিসেবে এ.কে.এম. মহিউদ্দীন, নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে মাওলানা রুহুল আমিন খান এবং বার্তা সম্পাদক হিসেবে সুলতান আহমদ ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে ইউসুফ শরীফ প্রমুখ প্রথমেই যোগদান করেন।
সুকৌশলী, দূরদর্শী মাওলানা এম.এ. মান্নান (রহ:) ‘দৈনিক ইনকিলাব’ প্রকাশের পরিকল্পনা অতি সুচিন্তিতভাবে ধীরে ধীরে, নীরবে চ‚ড়ান্ত বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে থাকেন। বাজারে আসার পর পত্রিকা নিন্দুকদের সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে এরূপ আশঙ্কার ব্যাপারে তিনি সতর্ক ছিলেন বলে, ধীরস্থিরভাবে মাসের পর মাস পত্রিকা পরীক্ষামূলকভাবে বের করতে থাকেন। তিনি এ কাজের জন্য দেশের খ্যাতনামা সুদক্ষ, প্রাজ্ঞ এবং প্রবীণ সাংবাদিকদের এককর্মী বাহিনী নিয়োজিত করেন। সকল দিক থেকে নিশ্চিত হওয়ার পর ১৯৮৬ সালের ৪ জুন ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকা প্রথমবারের মত ‘জামিমা’ বা বিশেষ সংখ্যা আকারে আত্ম প্রকাশ করে। পত্রিকা দেখে সংশ্লিষ্টভক্ত সকল মহলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বাজারে ছাড়া পত্রিকার সকল কপি হাতে হাতে বিক্রি হয়ে যায়।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি, মেশিনপত্রের সাহায্যে প্রকাশিত রঙ্গীন, সুসজ্জিত, সচিত্র এবং আকর্ষণীয় ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর প্রথম এ বিশাল সংখ্যা দেখে সবাই হন অবাক-বিস্মিত। চতুর্দিক থেকে মাওলান এম.এ. মান্নান (রহ:)-এর নামে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা বাণী আসার এক অব্যাহত ধারা শুরু হয়ে যায়। সর্বদিক থেকে অতি উচ্চ মানের এ সংখ্যাটি ছিল বাংলা সংবাদপত্র জগতে এক বিরল দৃষ্টান্ত। নিন্দুকদের মুখে ছাই পড়ে যায়, তবুও ঈর্ষাকাতর ছিদ্রানুসন্ধানী কিছু লোক বলতে থাকে যে, ‘এই নবপ্রকাশিত ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কোন প্রবীণ, অভিজ্ঞ সম্পাদক পাওয়া যায়নি। মাওলানা এম.এ. মান্নান নিজেও কোন সংবাদপত্রের লোক নন, অথচ তিনি তাঁর তরুণ পুত্রকে পত্রিকার সম্পাদক করেছেন, সাংবাদিকতায় যার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। সুতরাং এ পত্রিকা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।’ এরূপ আরও নানা অভিযোগ ছিল ঈর্ষা পরায়ণদের।
‘দৈনিক ইনকিলাব’ চালু হয়ে যায়। এক সুদক্ষ কর্মী বাহিনী পত্রিকা সর্বাঙ্গীন সুন্দর, আকর্ষনীয় ও সুপাঠ্য করার কাজে নিয়োজিত হন। মাওলানা এম.এ. মান্নান (রহ:) সরাসরি পত্রিকার তদারকি করতে থাকেন। রাত তিনটার মধ্যে পত্রিকা ছাপার কাজ আরম্ভ হলে প্রথমে এক কপি তাঁর বাসায় চলে যায়। তখন পর্যন্ত তিনি পত্রিকার অপেক্ষায় বিনিদ্র থাকতেন এবং পত্রিকা হাতে নিয়ে এক নজর দেখে নিতেন, কোথাও কোন অসঙ্গতি বা ভুল পরিলক্ষিত হলে সঙ্গে সঙ্গে তাতে কলমের দাগ দিয়ে রাখতেন। সকালে অফিস সময়ে পত্রিকা অফিসে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব প্রাপ্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন টেলিফোনে।
এদিকে অফিসে উপস্থিত হয়ে সম্পাদক সাহেবও সবকিছু দেখভাল করতেন, সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলাপ আলোচনা করতেন, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন। মহা সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত মরহুম এ.কে.এম. মহিউদ্দীন সহকারী সম্পাদকদেরকে নিয়ে বসতেন, সম্পাদকীয় বিষয় ও উপ-সম্পাদকীয় বিষয় নির্ধারণ করতেন এবং কে কি লিখবেন তা ভাগ করে দিতেন। সকল লেখা তাঁর নিকট দুপুর তিনটার মধ্যে জমা দিতে হত, তিনি সম্পাদনা করে প্রেসে পাঠিয়ে দিতেন। সম্পাদকীয় বৈঠকে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে মাওলানা কবি রুহুল আমিন খান নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। এটি ছিল সম্পাদকীয় বিভাগের দৈনন্দিন কার্যক্রম।
‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর প্রথম সংখ্যা হতে অনেকটা ফিচার পৃষ্ঠাও চালু হয়ে যায়। প্রধান ফিচার সম্পাদক হিসেবে প্রবীণ সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং ভাষা সৈনিক অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল গফুর সাহেব পত্রিকার জন্মলগ্ন হতে এ পদে অধিষ্ঠিত। তাঁর নির্দেশ, উপদেশ অনুযায়ী ফিচার সম্পাদকগণ নিজ নিজ পাতা পরিচালনা করে থাকেন। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যাগুলো অধ্যাপক সাহেব সরাসরি সম্পাদনা ও পরিচালনা করে থাকেন। তিনি বছরের বার মাসের ঐতিহাসিক স্মরণীয় ঘটনা ও ব্যক্তিত্বের ওপর একটি বিস্তারিত তালিকা প্রণয়ন করে রেখেছেন এবং সে তালিকা অনুযায়ী বিশেষ সংখ্যাগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এজন্য সম্পাদক সাহেবের অনুমোদন ও পরামর্শক্রমে প্রধান ফিচার সম্পাদক লেখকদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর লেখা সংগ্রহ করেন। তাঁর যোগ্য পরিচালনায় ও সম্পাদনায় ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর বিশেষ সংখ্যাগুলো অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
মাওলানা এম.এ. মান্নান সাহেবের ওফাত ২০০৬ সাল পর্যন্ত এক কথায় এটি ছিল ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর প্রথম যুগ, যা কুঁড়ি বছর মদ্দতে (১৯৮৬-২০০৬) বিস্তৃত। এ সময়কার বিশাল স্বতন্ত্র ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবরণ লিখিত না হলেও অধ্যাপক আব্দুল গফুর সাহেবের পরিচালনায় ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও মাওলানা এম.এ. মান্নান (রহ:) এর ওফাতবার্ষিকী স্মরণে এযাবত প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যাগুলোতে প্রচুর বিক্ষিপ্ত তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। আমাদের নিবন্ধের প্রতিপাদ্য ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর দ্বিতীয় বা চলমান অধ্যায়।
আমরা বলেছি যে, এ যুগটির আরম্ভ মাওলানা এম.এ. মান্নান-এর ওফাত থেকে, অর্থাৎ ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রæয়ারি থেকে। সে হিসেবে এখন পূর্ণ একযুগ। যদিও ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর বর্তমান সম্পাদক সাহেব পত্রিকাটির জন্মলগ্ন থেকে মাওলানা সাহেবের ওফাত পর্যন্ত সম্পাদক হিসেবে একটানা কুঁড়ি বছর একই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। অর্থাৎ আলহাজ এ.এম.এম. বাহাউদ্দীন টানা ৩২ বছর যাবত ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত, যা বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। প্রায় তিন যুগের বহুমুখী অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ‘দৈনিক ইনকিলাব’ সম্পাদকের সংবাদপত্র সংক্রান্ত কর্মকীর্তি পর্যালোচনা মূল্যায়ণের দাবিদার।
একযুগের ইতিহাসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নানা প্রকারের নানা পরিবর্তন এসেছে নানা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, ‘দৈনিক ইনকিলাব’ তা প্রত্যক্ষ করে আসছে। বাংলাদেশে ও বহির্বিশ্বের নানা প্রভাবের ছোঁয়াও এখানে লেগেছে। এসব প্রভাবের মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও বহুল আলোচিত, সমালোচিত জঙ্গি তৎপরতার হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলী অন্যতম। এ দেশের ইতিহাসে এ জঙ্গি তৎপরতা নজিরবিহীন। এ ধ্বংসাত্মক ইসলামবিরোধী তৎপরতা দমনে সরকারি কঠোর হস্তক্ষেপগুলোর পাশাপাশি সমগ্র জাতির, সকল স্তরের, সকল শ্রেণী পেশার মানুষ সঙ্গবদ্ধ ও একতাবদ্ধ হয়ে যার যার স্থান থেকে জঙ্গি দমনের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল, যা তুলনাবিহীন। বিশেষভাবে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে বাহাউদ্দীন এর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভ‚মিকা ছিল অসাধারণ। আর তা এই ভাবে যে, তাঁর পত্রিকায় ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে জঙ্গী তৎপরতার বিরুদ্ধে রীতিমত কলমী জেহাদ ঘোষণা করা হয়। পত্রিকার ভেতর থেকে তথা পত্রিকার পক্ষ থেকে নানা আঙ্গিকে ভুরি ভুরি প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, ফিচার, প্রতিবেদন প্রকাশের এক লাগাতার ধারা শুরু হয়ে যায়, যা সাধারণ জনতাকে প্রভাবিত করতে থাকে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে খোদ সম্পাদক সাহেব স্বনামে বহু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এমনকি বহু সমাবেশ-সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতার মধ্য হতে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন এবং প্রতিহত করার আহ্বান জানান। তাছাড়া ‘জমিয়াতুল মোদার্রেছীন’ -এর সভাপতি হিসেবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বহু সমাবেশ, প্রতিবাদ সভা, মানব বন্ধন ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন। তাঁর নির্দেশে জমিয়াত কর্মকর্তা ও কর্মীবৃন্দ এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং অনেক ক্ষেত্রে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ সম্পাদক হিসেবে উপস্থিত থেকে তিনিও জঙ্গীবাদের আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানান। তাঁর নির্দেশে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ -এ প্রকাশিত হতে থাকে প্রচার, প্রচারণার এক সুদূরপ্রসারী বিশাল ধারা।
সরকারি, বেসরকারি এবং ধর্মীয়সহ সকল পর্যায়ের জঙ্গিবিরোধী অভিযান-সংগ্রামকালে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ তার উদার ও নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় তথা সকল শ্রেণী পেশার জঙ্গিবিরোধী আন্দোলনের খবরাখবর যথাযথ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করতে থাকে এবং পত্রিকার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে খবর, নিন্দা, প্রতিবাদে পূর্ণ থাকে। কাদের, কোন দলের বা মতাদর্শের তা ‘দৈনিক ইনকিলাব’ বিবেচনায় রাখেনি। সকল স্তরের, সকলের খবরা খবর ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এ অবাধে প্রকাশিত হওয়ার ফলে জঙ্গিবিরোধী জনমত নি:সন্দেহে জোরদার, শক্তিশালী ও ব্যাপকতর হতে পেরেছিল। বিশেষত ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এ অহরহ প্রকাশিত ওলামা, মাশায়েখ ও মুফতিয়ানে কেরামের ফতোয়া অভিমতগুলো সর্বস্তরে প্রশংসিত ও সমর্থিত হয়েছে, যা জঙ্গিবিরোধী অভিযান আন্দোলনকে বেগমান করেছে। জঙ্গিবিরোধী আন্দোলনের খবরা-খবর প্রকাশে ঢাকার দৈনিক বাংলা সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে দৈনিক ইনকিলাব এর ভ‚মিকা শীর্ষে, যার নেতৃত্বে ছিলেন দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক নিজেই।
মাওলানা এম.এ. মান্নান (রহ:)-এর অসমাপ্ত কাজগুলো তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী ‘দৈনিক ইনকিলাব’ সম্পাদক পূর্ণতা দান করে চলেছেন এবং বহু ক্ষেত্রে আরও অগ্রসর হয়েছেন, যার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া এখানে সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলা যায়;
১. ‘বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন’-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এ অরাজনৈতিক মাদ্রাসা শিক্ষক সংগঠনের উন্নয়নের জন্য মরহুম মাওলানা সাহেব যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তার সবই বর্তমান জমিয়াত প্রধান প্রয়োজনে সরকারের সাহায্য সহযোগিতায় পূরণ করে যাচ্ছেন।
২. জমিয়াতকে শক্তিশালী ব্যাপকভিত্তিক করার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা বিস্ময়করভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি ঝটিকা সফরের ন্যায় সর্বত্র গণসংযোগ করে সংগঠনকে অধিক সক্রিয় ও তৎপর করে তুলেছেন। পাশাপাশি ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর দায়িত্বও সুচারু রূপে পালন করে যাচ্ছেন। এটি তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতার পরিচায়ক।
৩. ইসলামী আরবী বিশ^বিদ্যালয় কায়েম করা এবং তা দ্রæত চালু করা বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন প্রসারে চলতি শতকের এক অনন্য অবদান, যার দ্রæত বাস্তবায়নে ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর প্রচার-প্রচালণার ভ‚মিকা ছিল খুবই বলিষ্ঠ। যার নেতৃত্ব দিয়েছেন ‘দৈনিক ইনকিলাব’ সম্পাদক। সরকারি উচ্চ মহল হতেও এ জন্য তাঁর ভ‚মিকার ভ‚য়সীপ্রশংসা করা হয়ে থাকে।
৪. মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন প্রসারে অর্জিত অবদানগুলোকে তুলে ধরার জন্য ‘দৈনিক ইনকিলাব’ যে মুখপাত্রের ভ‚মিকা পালন করে যাচ্ছে, তাতে জমিয়াতের মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্রদের উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেক দূর বেড়ে গেছে।
৫. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি বিশেষভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের উজ্জ্বল সম্ভাবনাগুলোকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর নিরলস প্রচেষ্টা একটি ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ। সম্পাদক খোদ এ ব্যাপারে স্বনামে উৎসাহ ব্যঞ্জক লেখাও লিখে থাকেন।
৬. ইসলাম সংক্রান্ত নানা বিষয়ের অন্তর্ভ‚ক্তি ‘দৈনিক ইনকিলাব’-কে যে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য দান করেছে তা কেবলমাত্র এ পিত্রকারই পাওয়ার যোগ্য। পত্রিকার পাতাগুলোজুড়ে বিশেষত ইসলামের নানা বিষয়ের যে সমাহার থাকে, বাংলা সংবাদপত্র জগত তো দূরের কথা, অন্য কোন ভাষার সংবাদপত্রেও ইসলামী বিষয়াবলির এরূপ উপস্থিতি হয়তো দেখা যাবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইনকিলাব

২৭ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন