পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সরকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ করে জনসাধারণের কাছ থেকে। এ জন্য আইন অনুযায়ী জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। অবশ্য বিষয়টি যত সহজ বলে মনে হচ্ছে তত সহজ নয়। অধিগ্রহণে সমস্যা নেই; সমস্যা দেখা দেয় ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে। এ অভিযোগ পুরানো, ক্ষতিপূরণের টাকা জমির মালিক কখনো যথাসময়ে পায় না। এজন্য ৫ বছর, ১০ বছর এমন কি ২৫-৩০ বছর বা তার চেয়েও বেশী সময় পার হয়ে যয়। এই সময়ে জমির মালিকের দশা হয় অবননীয়। অনেকে মারা যায়, অনেকে অন্যত্র চলে যায়। অধিকাংশই অভাব-অনটন ও দু:খ-কষ্টে পরিবার-পরিজন নিয়ে দিন টাকাতে বাধ্য হয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বেশ কিছু নজির তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকার নর্দারটেকের এক আদি বাসিন্দার ২০০ বিঘা জমি ছিল। উত্তরা মডেল টাউনের ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের বেশিরভাগ বাড়িঘর গড়ে উঠেছে সেই জমির ওপর। অথচ এই শহরে বসবাসের জন্য তার এক টুকরো জমি জোটেনি। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের এক অজগ্রামে তার পরিবারের সদস্যরা এখন বসবাস করে। পাকিস্তান আমলে অধিগ্রহণকরা তার জমির ক্ষতিপূরণ এখনো মেলেনি। জমির বর্তমান বাজারমূল্য এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা। পরিবারটি অভাবে-দারিদ্রে-অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা দুই-পাঁচটা, নয়, অসংখ্য। ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি এবং আইনগত কিছু ফাঁক-ফোকড়ের ফলে জমির মালিকদের অকথ্য হয়রানি, বঞ্চনা ও ক্ষতির শিকার হতে হয়। জমির মালিকানা নির্ধারণ, দখল ও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ একজন সার্ভেয়ার ও কানুনগোই করতে পারেন। এ জন্য সময়ও খুব বেশি লাগায় কথা নয়।
এই সহজ কাজটিই কঠিন হয়ে যায় দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দুর্বল আইনের কারণে। দেশের প্রায় সব জিলাতেই জমির মালিকদের হয়রানি ও ঘুষ আদায়ের জন্য একটি সাধারণ ফর্মূলা অনুসরণ করা হয়। জমির মালিকানাবদল অতি সাধারণ ঘটনা। একটা জমি বহুবার হাতবদল হয়। এক্ষেত্রে সর্বশেষ দলিলগ্রহিতা এবং নামজারি ও দখিলা যার নামে, তিনিই জমির প্রকৃত মালিক। তাকে নোটিশ করলেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্তারা পূর্বে যারা জমির মালিক ছিলেন তাদের নামেও নোটিশ জারি করেন। তারা ও টাকার লোভে আপত্তি দায়ের করেন এবং এভাবে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি ঝুলে যায়। আর ক্ষতিপূরণ ঝুলে গেলে ঘুষের দুয়ারও খুলে যায়। প্রতিটি অফিসেই একাধিক চক্র রয়েছে যারা মামলা সাজানোর কাজ করে। ঢাকার একটি জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৩৬৪টি আপত্তি মামলা হয়েছে। ফলে ক্ষতিপূরণের এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা আটকে আছে। কবে জমির মালিক প্রাপ্য ক্ষতিপূরণপাবেন কেউ বলতে পারে না। এভাবেই বহু জমির মালিক হয়রানি ও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এই ধরনের ঘটনায় জমির মালিকই কেবল নন সরকারও বিপাকে পড়ে যায়। উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত, ব্যহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। ক্ষতিপূরণের টাকা ঠিক সময়ে না পাওয়ার মূল বাধ্য ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশের আওতায় ৩ ধারায় নোটিশ জারির পর বিভিন্ন জনের মামলা দায়ের। এছাড়া অনেক সময় মালিকানা চিহ্নিত হওয়ার পরও ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানে বিলম্ব হয়। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ম্যানুয়াল ১৯৯৭-এর ৫০ অনুচ্ছেদটি এ ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মামলা হলে ক্ষতিপূরণের টাকা সরকারি তহবিলে জমা থাকবে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত। একারণে ক্ষতিপূরণের টাকা বন্টন করতে যুগের পর যুগও পার হয়ে যায়। এই অনুচ্ছেদটির পাশাপাশি ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশের ৩ ধারাটি পরিবর্তন বা সংশোধন অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন অনেকেই।
ভূমি অফিসে অনিয়ম-দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি ও ঘুষবাণিজ্য অতিসাধারণ ঘটনা। বলা হয়, ভূমি অফিসের বড় কর্তা থেকে পিয়ন-দারোয়ান, এমন কি চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত ঘুষ খায়। জমিজমার বিষয়টি এমনিতেই খুব জটিল। কূটবুদ্ধিতে ওস্তাদ ঘুষখোর কর্মকর্তারা যে কোনো জটিল বিষয়কে আরো জটিল করে তোলেন। জমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের কাজ-কারবার থেকে এটা বিশেষভাবে প্রতিভাত হয়। অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে ঘুষবাণিজ্য ডেড স্টপ করা না গেলেও একটা মার্জিনাল অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। মানুষ ঠিক না হলে আইনবিধি বা ধারা-অনুচ্ছেদ পরিবতন অথবা বাদ দিলেও কোনো ফায়দা আসবে না। কাজেই মানুষগুলোকে শাসনে-নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষেত্রে আপত্তি মামলার বাধা দূর করতে মিথ্যা মামলাকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। জমির মালিকানা ও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বেধে দিতে হবে। এর অন্যথা হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্নয়নের জন্য জমি দরকার। ভবিষ্যতেও দরকার হবে। জমি অধিগ্রহণ তাই কখনো বন্ধ হবে না বা বন্ধ করা যাবে না। যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে, সেই জমি হয়তো তাদের শেষ সম্বল, এমন কি ঘরবাড়িও হতে পারে। অতএব তাদের ক্ষতি পূরণ যতদ্রুত সম্ভব প্রদান করতে হবে যাতে তারা অন্যত্র পুনবার্সিত হতে পারে। যাদের জমির ওপরই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হোক, অন্যরা তার সুফলভোগী হবে। এমতক্ষেত্রে জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে পথে পথে ঘুরবে তা হতে পারে না। শেষ কথা, অনিয়ম-দুর্নীতি-সময়ক্ষেপন বন্ধ করতে হবে, বিনা হয়রানিতে জমির মালিকদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে। তদারকি কমিটি করে নজরদারি বাড়াতে হবে। কোনো কারণে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বিলম্ব হলে জমির বর্তমান মূল্য অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। বলা বাহুল্য, এটা দীর্ঘদিন ধরেই একটা গুরুতর সমস্যা হয়ে আছে। দেশজুড়ে যখন নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে এবং জমি অধিগ্রহণ অব্যাহত আছে তখন ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা, সহজ, হয়রানিমুক্ত ও দ্রুত করার বিকল্প নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।