পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিএনপির ইফতার মাহফিলে বিকল্প ধারার সভাপতি ডা. বি. চৌধুরীর দেয়া বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। সর্বত্র একই কথা। এ কিসের ইঙ্গিত দিলেন বর্ষীয়ান এই নেতা? কী বোঝাতে চাইলেন তিনি? নাকি চলমান সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সতর্ক করলেন সব পক্ষকে? বিষয়টি চিন্তার এবং চৌধুরী সাহেব নিজেই বলেছেন, তিনি সবার জন্য চিন্তার খোরাক দিয়ে গেলেন।
গত ১৯ মে রাজধানীর ইস্কাটনস্থ লেডিস ক্লাবে বিএনপি আয়োজন করেছিল রাজনৈতিক নেতাদের সম্মানে ইফতার মাহফিল। সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিকল্প ধারার সভাপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। সেখানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকে চিন্তা করে দেখুন, এখানে বেশিরভাগ বিএনপি নেতারাই আছেন, কর্মীরা নেই। আজকে কর্মীদের বুক কাঁপে, ভয়ে দুরু দুরু। কাঁপবে না কেন? কারণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা শঙ্কিত, কী হবে যদি আবার সরকারি দল ক্ষমতায় আসে? অভিজ্ঞতা বলে যে, খুব সুবিধা হবে না। একইভাবে সরকারের রাজনৈতিক কর্মীরাও আমার কাছে আসছে, তাদেরও বুক কাঁপে। যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে তাদের কী হবে! এটা কি খুব ভালো কথা? এটা কি রাজনীতির জন্য শুভ? এটা কি দেশের ভবিষ্যতের জন্য শুভ? এটা কি ইঙ্গিত নয় যে, ভবিষ্যতে এমন একটি পর্যায়ে যেতে পারে দেশ, যেখানে মানুষ মানুষকে হত্যা করবে, নিগৃহীত করবে, জেলে দেবে, আগুন জ্বালাবে। এটা কি সম্ভব? এটা কি ভালো জিনিস? কিন্তু থামাবে কে? চিন্তার খোরাক দিয়ে দিলাম।’ এরপরই তিনি বলেন, ‘এমন একটা শক্তি দরকার যে ওদিকেও (আওয়ামী লীগ) কন্ট্রোল করতে পারে, আবার এদিকেও (বিএনপি) কন্ট্রোল করতে পারবে। তারা যদি উঠে আসতে পারে এবং বলে, তোমরা যদি একটা মানুষের গায়ে হাত দাও তাহলে তোমাদের প্রতি সমর্থন উইথড্রো করব, বিরোধী দল হয়ে যাব। এদেরও বলবে, ওদেরও বলবে। একমাত্র তাহলেই দেশ রক্ষা পেতে পারে।’
বি. চৌধুরীর বক্তব্যে চিন্তার খোরাক যে যথেষ্ট পরিমাণে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথমত. তিনি আমাদের দেশের রাজনীতির একটি অত্যন্ত কঠিন সত্যকে তুলে ধরেছেন, যেটা নিয়ে কেবল রাজনীতিকদেরই নয়, সমাজের সচেতন সবারই চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। দ্বিতীয়ত. তিনি বিদ্যমান সে সমস্যার সমাধান হিসেবে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা নিয়েও চিন্তার দরকার আছে। তিনি যে বলেছেন, ‘ চিন্তার খোরাক দিয়ে গেলাম’ তা একবারে অর্থহীন নয়।
বস্তুত আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সম্পর্কটা এখন সাপে-নেউলে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। একদল আরেক দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে ভিন্ন পন্থায় পর্যুদস্ত করতে বেশি তৎপর। বিশেষত ক্ষমতাসীনরা নিজেদের গদী রক্ষা এবং পুনরায় ক্ষমতায় যাবার পথের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রতিদ্ব›দ্বী দলকে পিঁপড়াসম দলে মারতেও যেন কুণ্ঠিত নয়। ফলে শাসকদল এখন বিরোধী দলের কাছে এক মূর্তিমান বিভীষিকা। সরকার এবং সরকারি দলের কর্মী-ক্যাডারদের জুলুম-নির্যাতনে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা আজ অতিষ্ঠ। হাজার হাজার মামলায় আসামী লাখো নেতাকর্মী। কেউ মাসের পর মাস বিনা বিচারে ভোগ করছে কারাবাস। আবার কেউ স্বজন-পরিজনদের ছেড়ে যাযাবরের মতো জীবন কাটাচ্ছে এখান থেকে সেখানে পালিয়ে বেড়িয়ে। গত নয় বছরের এই যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, এ থেকে মুক্তি পাবার উপায় কী, তাই এখন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রধান ভাবনা।
গণতান্ত্রিক পন্থায় এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন। কিন্তু সে পথ এ মুহূর্তে সহজ নয়। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই যদি সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে সে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে তাতে নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ সবারই আছে। আর সে জন্যই বিএনপির নেতাকর্মীরা শঙ্কিত। তাদের এ শঙ্কাকে অমূলক বলা যাবে না। কেননা, তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে বর্তমানের চেয়ে অধিকতর বেপরোয়া হয়ে উঠবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গত নয় বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলটির নেতাকর্মীরা যেসব ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছে, তাতে তারা আবার ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি কী হবে, তা ভেবে উদ্বিগ্ন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। শুধু বিএনপি নেতাকর্মীরাই নয়, সাধারণ মানুষও এ নিয়ে ভাবনার মধ্যে আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনাবলীর বিস্তারিত ফিরিস্তি এখানে উল্লেখ না করলেও চলে। কেননা, সেসব ঘটনার ভুক্তভোগী এ দেশেরই মানুষ। আবার তার প্রত্যক্ষদর্শীও তারাই।
এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, বর্তমান সরকারের শাসনকালে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা নির্যাতনের স্টিম রোলারের নিচে পিষ্ট হচ্ছে। তাদের মনে যে তীব্র ক্ষোভের আগুন ধূমায়িত হচ্ছে তাও অনুমান করা যায়। ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে নির্যাতিত ওইসব নেতাকর্মী যদি বেপরোয়া হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে দেশে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ফলে সরকারি দলের লোকজন যে আশঙ্কার কথা ডা. বি. চৌধুরীর কাছে ব্যক্ত করেছে, তাও অমূলক নয়। শুধু তারাই নয়, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদককে পর্যন্ত বলতে শোনা গেছে, আবার ক্ষমতায় আসতে না পারলে কামানো ধন-সম্পদ নিয়ে পালাতে হবে। একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মনে যখন এ ধরনের আশঙ্কা বাসা বাঁধে, তখন বুঝে নিতে হবে দুষ্কর্মের পাল্লাটা।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটবে, একদল বিদায় নেবে আরেকদল রাষ্ট্র ক্ষমতার দৃশ্যপটে আসবে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে যেমন আক্রমণ বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চিন্তাভাবনা থাকার কথা নয়, তেমনি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকারও কথা নয়। অথচ বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় তা মিলছে না। কেন এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো? এ প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই জানা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পারষ্পরিক শত্রæ মনোভাবাপন্ন মানসিকতা এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এখানে যারা ক্ষমতায় আরোহন করেন, তারা ভুলেই যান যে এটা চিরস্থায়ী কোনো বন্দোবস্ত নয়। আর ক্ষমতাকে স্থায়ী ভেবে এমনসব কাজকর্ম করতে থাকেন, যেগুলো জনগণকে অতিষ্ঠ করে তোলে। পাশাপাশি তাদের জুলুম-নির্যাতনের দ্বারা বিরোধী পক্ষ এতটাই পিষ্ট হয় যে, তারা থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। সুযোগ এলেই প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়ে উঠে। ফলে রাজনীতির মাঠ হয়ে উঠে সংঘাতময়, প্রাণসংহারি। অথচ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাজ করত তাহলে এমনটি হতো না। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে যদি তারা বেপরোয়া হয়ে না উঠতেন, তাহলে অন্য দল ক্ষমতায় এল তাদের শঙ্কার কিছু ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, এ বোধ যতদিন রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্তরে স্থায়ী আসন না নেবে, ততদিন এ শঙ্কা, এ ভয় দূর হবে না।
এবার আসা যাক চৌধুরী সাহেবের বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে। তিনি সেখানে উভয় দলকে কন্ট্রোল করার মতো একটি শক্তির আর্বিভাবের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু পরিষ্কার করে বলেননি, সে তৃতীয় শক্তির অভূদ্যয় কীভাবে কোথা থেকে হবে। তিনি কি বড় দুই দলের বাইরে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির কথা বলেছেন, নাকি অন্য কোনো শক্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন? মি. চৌধুরী কোন শক্তির কথা বলেছেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে, আমরা ধরে নিতে চাই, বিএনপি-আওয়ামী লীগের বাইরে আরেকটি রাজনৈতিক শক্তির কথাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন আসে, সে শক্তির অভূদ্যয় কীভাবে হবে? দীর্ঘদিন ধরেই আমরা তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তার কথা শুনে আসছি। বিশেষ করে ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকা রাজনীতিক এবং সুশীল সমাজের অনেকেই এ প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছেন। কেউ কেউ চেষ্টাও করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। কিন্তু সফলতার মুখ এখনও দর্শন করতে পারেননি। বি. চৌধুরী সাহেব নিজেও সে চেষ্টা কম করেননি। এখনও তিনি যুক্তফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক জোটের প্রধান হিসেবে আছেন। কিন্তু তাদের সে জোট জনমনে এতটুকু রেখাপাত করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বিএনপি-আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও এই দুই পক্ষে বিভক্ত। কিছু আছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে। আর কিছু আছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে। এর বাইরে যারা আছে তারা যে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির ওপর কোনো প্রকার প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে না, তা বলাই বাহুল্য। ফলে এই বড় দুই রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এমন শক্তির দেখা মেলার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এর বাইরে যে ঘটনা ঘটার আশা বা আকাক্সক্ষা কেউ কেউ করেন, তা যে দেশ, জাতি এবং গণতন্ত্রের জন্য শুভফল বয়ে আনে না, তা ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সংঘটিত ঘটনা থেকেই প্রমাণিত।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে এই অস্বস্তিকর বা আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় কী? উপায় একটাই। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মন মানসিকতার পরিবর্তন। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সর্বনাশা চিন্তা বাদ দিতে হবে এবং মৌখিক নয়, নিখাদ বিশ্বাসে গণতন্ত্রী হতে হবে। ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট’ নীতি পরিত্যাগ করে তাদের আক্ষরিক অর্থে গণতন্ত্রের অনুশীলন করতে হবে। দেশটি সবার এবং সংবিধান সবাইকে সমান অধিকার দিয়েছে, এ কথাটি অন্তরে লালন এবং কর্মে প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আমার ক্ষমতা আছে, আমি যা খুশি তাই করব, অন্যকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করব, এ মানসিকতা বুকে পুষে আর যাই হোক একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। আর যতদিন এ দেশে গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ না ঘটবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত না হবে, পরমতসহিষ্ণুতা সৃষ্টি না হবে ততদিন অবস্থার কোনো উন্নতি হওয়ার আশা করা যায় না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।