Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশ ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম

জাতীয় কবির জন্মদিন উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

ড. শাহনাজ পারভীন | প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৮:০৬ পিএম, ২৪ মে, ২০১৮

‘আমি সেই দিন হব শান্ত

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাশে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রনিবে না।
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।’
এই লাইনগুলির লেখক যিনি তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবিতায় কিছু শর্তের মাধ্যমে এ জাতির কাছে তিনি তাঁর শান্ত হবার কমিটমেন্ট করেছিলেন। এ কবিতা লেখার পর আলো হাওয়াময় পৃথিবীর বুক থেকে চুরাানব্বইটি বছর পেরিয়ে গেলেও সেই শর্ত কি পূরণ হয়েছে আজও? তাই তো তিনি আজও অশান্ত, আমরা তাঁকে মনে রাখি সব সময়। আহা কবি! তুমিই তো পৃথিবীর প্রিয় সব নাম!
আজকের আলোচনার বিষয়কে দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ‘বাংলাদেশ’ এর পেছনে ফিরি তো দেখতে পাই বাঙালি তার নিজস্ব জাতিসত্তাকে কয়েক হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে আজকের রূপ দেয়। এই বাংলা অঞ্চলেই এক সময় পুন্ড্রবর্ধন, সুম্ম, রাঢ়, হরিকেল, বরেন্দ্র প্রভৃতি উপজাতি তাদের নাম অনুসারে বসতি স্থাপন করেছিল। এসব নামের বিভিন্ন অঞ্চল বা রাজ্যসত্তার অস্তিত্বের খবরও ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়। রাজা শশাঙ্ক, পাল সা¤্রাজ্য, সেন রাজা, সুলতানী আমলের স্বাধীন পাঠান সুলতানরা বাংলা অঞ্চলকে প্রায় বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে পরিণত করেছিলেন। মোগল সাম্রাজ্যের শেষ ভাগে মুর্শিদকুলী খাঁ, আলিবর্দি খাঁ, সিরাজদ্দৌলা দিল্লির প্রতি নামমাত্র আনুগত্য স্বীকার করে প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে বাঙালির বাংলা কোনদিন রাষ্ট্রভাষা বা সরকারী ভাষার মর্যাদা পায় নি।
তাই প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের আগে স্বাধীন বাংলা রাজ্য মাঝেমধ্যে সৃষ্টি হলেও স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র কোনদিন সৃষ্টি হয়নি। যেখানে প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি নিজের রাষ্ট্রের সংবিধানে জাতিসত্তার স্ফুরণ ঘটিয়ে নাগরিক হিসাবে মানবাধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য বাঙালি এক মরণপণ মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রাম করেছিল। বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সালেই ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনকে পরাভ’ত করে ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালির প্রথম রাষ্ট্র স্বাধীন প্রজাতন্ত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মানচিত্র।
এর আগে ব্রিটিশ ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট দ্বিজাতিতত্ত¡ নামীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফলে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান অর্থাৎ হিন্দু মুসলিমের দুটি আলাদা দেশের জন্ম হয়।
এর ফলে পাকিস্তানে তথা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নজরুল চর্চাকে রাষ্ট্রীয় মদদে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু ঐ ভারত ভাগের বিপক্ষে ছিলেন ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত হলে ১৯৪২ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম “বাঙালীর বাঙালা” শিরোনামে তার ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন: বাঙালিকে কিভাবে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে জেগে উঠতে হবে। বাংলার এই সবুজ শ্যামল বনভূমি, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, অবারিত আকাশ, সমুদ্রের গর্জন, নদীর ছলাৎ ছলাৎ প্রবাহমানতা সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে সে বলীয়ান কিন্তু ব্যক্তিক অর্থে তারা নিস্তেজ। একটি নিস্তেজ জাতিকে কিভাবে সবল, স্বাধীনতাকামী প্রতিবাদমুখর করে তুলতে হয় তা একজন কবির জানা। তাই তো কবি তার প্রাণশক্তি ক্ষাত্রশক্তি দিয়ে সত্যিকার অর্থেই জাতিকে জাগিয়ে তোলেন, স্বপ্ন দেখান।
কুসংস্কার আর সংকীর্ণ মানসিকতায় আচ্ছন্ন উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িকেরা তাঁকে তাঁর সৃষ্টির পথে বারবার বাঁধা দিয়েছে। দৃঢ়চেতা কবি কখনো থেকেছেন আপোষহীন, কখনো প্রবল প্রতিবাদী। প্রসঙ্গত ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন-
“কেউ বলেন আমার বানী যবন, কেউ বলেন আমি কাফের। আমি বলি এ দুটোর কিছুই নই। আমি মাত্র হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করছি।
মন্দির ও মসজিদ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-
“সকল কালে সকল দেশে সকল লাভ লোভকে জয় করিয়াছে তরুণ। ওগো বাঙলার তরুণের দল-ওগো আমার আগুন খেলার নির্ভীক ভাইয়েরা-এ দশ লক্ষ অকাল মৃতের লাশ তোমাদের দুয়ারে দাড়াইয়া! তারা প্রতিকার চায়!
তোমরা এ শকুনের দলের নও। তোমরা আগুনের শিখা, তোমাদের জাতি নাই! তোমরা আলোর, তোমরা গানের, তোমরা কল্যাণের। তোমরা বাইরে এসো, এই দুর্দিনে তাড়াও ঐ গো ভাগাড়ে পড়া শকুনের দলকে।”
কবিরা সমাজ গঠনের পাশাপাশি স্বপ্ন দেখান। তিনিও এর ব্যতিক্রম কিছু নন। প্রকৃতি, প্রেম, বিদ্রোহ, যুদ্ধ এবং দেশাত্ববোধের মাধ্যমে কবি এগিয়ে যান, স্বপ্ন দেখান। আমরা জানি, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।
যার যত বড় স্বপ্ন তিনি ঠিক তত বড়ই হন। তিনি লেখেন:
“কান্ডারী! তব সম্মুখে এ পলাশীর প্রান্তর
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর।
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর
উঠিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুর্নবার।”
নজরুলের এই উচ্চারণ ছিল বাঙালির স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতা আমাদের বাঙালি জাতির বড় অর্জন। নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর চাওয়া ছিল এক ও অভিন্ন। তাইতো, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্রে দেয়া ভাষণে বলেন-
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুমি এসে দেখে যাও- আমার বাঙালিরা মানুষ হয়েছে। তুমি বলেছিলে- ‘হে মুগ্ধ জননী,
সাত কোটি সন্তানেরে রেখেছো বাঙালি করে
মানুষ করোনি’।
তোমার সে কথা আজ মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফেরার মাত্র চার মাস পর ২৪ মে নিস্তব্দ বিধ্বস্ত রণক্লান্ত কবি নজরুল ইসলামকে ভারতের কোলকাতা থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করেন এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির পাশে ২৮ নং বাড়িটিকে ‘কবি ভবন’ নাম দিয়ে কবির স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে কবি নজরুলকে জাতীয় কবি অভিধায় ভ’ষিত করেন বা স্বীকৃতি দেন। ‘কবি ভবন’ বর্তমানে নজরুল ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। ১৯৭২ সালে প্রথম কবির জন্মজয়ন্তী সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল একাডেমীর ব্যানারে পালন করা হয়।
নজরুল ইসলামের ত্রিশ বছর বয়সে ১৯২৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর কোলকাতার এলবার্ট হলে “বাঙালি জাতির জাতীয় কবি” অভিধায় সংবর্ধিত করা হয়। হিন্দু মুসলিম মিলিত উদ্যোগের সে অনুষ্ঠানে বিজ্ঞানাচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায় সভাপতির ভাষণে বলেন-
আমরা আগামী সংগ্রামে নজরুলের সঙ্গীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রী মান সুভাসের মত তরূণ নেতাদের অনুসরণ করিব।
১৩৪৯ সালের ৩ বৈশাখ ‘নবযুগ’ পত্রিকায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কাব্যছন্দে বাংলাদেশের রোডম্যাপ এঁকে দেন-
‘এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির, আমাদের
দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয়
তাড়াবো আমরা করি না ভয়
যত পরদেশী দস্যু ডাকাত
রামাদের, গামাদের।’
বাঙলা ও বাঙালির স্বাধীনতার এই “মন্ত্র” সব বাঙালি শিশুদের মন-মননে অস্থি ও মজ্জায় গেঁথে দিতেও আহ্বান জানান কবি নজরুল ইসলাম। এ থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হওয়ার প্রায় ত্রিশ বছর আগে তার রূপকল্প বাঙালি জাতির সামনে সুস্পষ্টভাবে হাজির করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নতুন প্রজন্মের কারো কাছে এ প্রশ্ন জাগতে পারে ভারতের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের কাজী ফকির আহমেদের পুত্র কবি নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে স্থায়ী ভাবে নিয়ে আসার কারণ কী? ব্রিটিশ ভারতে নজরুল জন্ম নিয়ে যে বিদ্রোহের বীজ বপন করেছিলেন, সেই বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয় ৫২ ভাষা আন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা। এমনকি তার ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের অর্ন্তগত “পূর্ণ অভিনন্দন” কবিতা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানটি গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অসাধারণ ভাষণে বাঙালি জনগণের স্বাধীনতার চরম আকাক্সক্ষাকে মূর্ত করে তুলেছিলেন। বাঙালির ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে এক অনন্য আবেগে তীব্র জ্বালাময়ী ভাষায় বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পেরিক্লিসের পেলোপোনেসিয়ান, আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ এবং উইনস্টন চার্চিলের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাষণের সঙ্গে এই ভাষণটি বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্যতায় স্থান করে নেবে। বস্তুত নজরুল সাহিত্যের রাজনৈতিক প্রকাশ বঙ্গবন্ধু অস্তিত্বে অনুভব থেকেই- অন্যকথায় ইতিহাসের দায়বোধের তাগিদে স্তব্ধ নিথর তথা ‘রণক্লান্ত’ নজরুলকে তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে এনেছিলেন।



 

Show all comments
  • তানিয়া ২৫ মে, ২০১৮, ২:৩১ এএম says : 0
    আমরা কী আমাদের জাতীয় কবিকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারছি ?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ


আরও
আরও পড়ুন