পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মাছে ভাতে বাঙ্গালীর খাদ্য চাহিদা পুরণে আবহমানকাল ধরেই দেশের হাওরগুলোর বিশেষ অবদান রয়েছে। দেশের খাদ্য চাহিদার অন্তত ২০ ভাগ এ অঞ্চলের কৃষক জেলেরা পুরণ করে থাকে। হাওরের কঠিন জীবনযাত্রায় জনসংখ্যার ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় সেখানে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত খাদ্যপণ্য ঘাটতি এলাকার চাহিদা পুরণে অবদান রাখে। তা’ ছাড়া বাংলাদেশের হাওড় ও সুন্দরবন বাংলাদেশের ভ‚-প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নিয়ামক। এ কারণেই হাওর বা সুন্দরবনের তথাকথিত উন্নয়নের চেয়ে এসব বন ও জলাভ‚মির বৈশিষ্ট ও নিরাপত্তা টিকিয়ে রাখা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের সরকার, পরিবেশবাদি এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে এক ধরনের উন্নাসিকতা ও দায়সারা মনোভাব দেখা যাচ্ছে। গত বছর এপ্রিলে দেশের হাওরাঞ্চলের অধিবাসিরা নজির বিহীন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। সাদা চোখে অনেকে একে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করলেও অনেকেই তা মানতে নারাজ। এমনতি হাওরের সাধারণ অধিবাসিরাও হাওরে অকাল বন্যা, বাঁধ তলিয়ে যাওয়া এবং ভয়াবহ পানি দূষণের জন্য দেশি-বিদেশি চক্রের অপরিনামদর্শি কর্মকান্ডকে দায়ী করেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ হিসেবে একমাত্র বাংলাদেশেই এমন বৈচিত্রময় ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হাওর আছে। হাওরের জীববৈচিত্র্য ও হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে বিশ্ব পরিবেশবাদিদের বিশেষ নজরদারি থাকলেও হাওরে সাম্প্রতিক পরিবেশ বিপর্যয়ে পরিবেশবাদিরা কিছু উষ্মা,উদ্বেগ প্রকাশ করেই যেন তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। গত বছর এপ্রিলের প্রথম দিকে হাওরের কৃষকরা তাদের ধান কেটে গোলায় তোলার অল্প কিছুদিন আগে আকষ্মিক বন্যায় সবর্স্ব পানির নিচে তলিয়ে যায়। প্রথমে নজিরবিহীন শিলাবৃষ্টি হাওরে হাজার হাজ্রা কৃষক পরিবারের টিনের ঘরগুলোকে ঝাঁঝরা করে দেয়। অত:পর উজানের পাহাড়ি ঢলের বাঁধভাঙ্গা বন্যা প্রায় পেকে যাওয়া ধানক্ষেতগুলোকে রাসায়নিক দূষিত পানিতে তলিয়ে এক নজিরবিহীন দুর্যোগ সৃষ্টি করে। যদিও উজানের ঢলে হাওরবাসিদের নিরব কান্নার ইতিহাস কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে পানির সাথে তীব্র রাসায়নিক দূষণের ঘটনা এবারই প্রথম। গ্রীস্মের অল্প কিছুদিন হাওরের শুকনো মওসুমের একটি ফসলের উপর হাওরের খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নির্ভরশীল। এছাড়া হাওরের রূপালী সম্পদ মাছ। সিলেট, শুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রেকোনার হাওর ও উত্তরের বিলগুলোগুলো দেশের মিঠা পানির মাছের অন্যতম যোগানদার। হাজার হাজার একর ধানের জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর হাওরের মৎস্য সম্পদকে ঘিরে বেঁচে থাকার একটি ক্ষীন প্রত্যাশ্ াজেগে থাকে। গত বছরের বন্যায় সে প্রত্যাশা ভয়াবহ দু:স্বপ্নে পরিনত হয়। উজানের ঢলের পানির সাথে মিশে আসে ইউরেনিয়ামের রাসায়নিত দূষণ। এ দূষণের শিকার হয়ে বন্যায় তলিয়ে যাওয়া ধানক্ষেতের উপর মরে ভেসে ওঠে হাজার হাজার টন মাছ। শুধু মাছ নয়, অসংখ্য জলজপ্রাণী, স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি, হাঁস মুরগি, গবাদি পশু। এ যেন আগ্নেয়গিরির লাভা¯্রােতে তলিয়ে যাওয়া এক মড়কের জনপদ। হাওরের মানুষের চিরায়ত জীবনধারায় কোন উচ্চাভিলাষ নেই। ধান, মাছ এবং গবাদি পশুপাখি লালনের মধ্য দিয়েই তারা তাদের প্রাচুর্যের শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল। শিলাবৃষ্টি, অকাল বন্যা, ইউরেনিয়াম দূষণের মহামারিতে সম্ভবত শত বছরে এই প্রথম হাওরাঞ্চলে এক নজির বিহিন হাহাকার দেখা দেয়। আমাদের গণমাধ্যমে তার পুরোটার তুলে ধরা হয়তো সম্ভব না হলেও যতটুকু তথ্য উঠে এসেছিল তা’ যে কোন বিবেকবান মানুষকে বিচলিত করে তোলতে পারে।
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের নদী বিধৌত অববাহিকার বিস্তৃত কৃষিভ‚মিতে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মেনে নেয়ার পরও লাভ হিসেবে যে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে তা হচ্ছে বাণের পানির সাথে ভেসে আসা লাখ লাখ টন উর্বর পলিমাটি। গত বছর হাওরের বন্যা ও রাসায়নিক দূষণে অর্থনৈতিক ও জীবপ্রাকৃতিক বিপর্যয় সংঘটিত হওয়ার পর এই বন্যা এবং রাসায়নিত দূষনের কারণ সম্পর্কে কিছু অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এসব রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বাঁধ ভেঙ্গে ও বাঁধ উপচে হাওরে পানি ঢুকে লাথ লাখ হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে অপরিকল্পিত, অপর্যাপ্ত ও ভুল উন্নয়ন প্রকল্প। গত চল্লিশ বছরে হাওরের উন্নয়নে কত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, কতটা তার কাজে লেগেছে আর কতটা চুরি, দুর্নীতি ও ভাগাভাগিতে লোপাট হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। গত বছরের বন্যা ও পানি দূষণের ক্ষয়ক্ষতি শুধুমাত্র অর্থমূল্যে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন রির্পোটে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে প্রায় ৩০ লাখ টন বোরো ধানের আধিক ক্ষতির পরিমান ১০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ২ হাজার টন মাছ, ১০ হাজার হাঁস, কেঁচো, ব্যাঙ, কাঁকড়া, কচ্ছপসহ অসংখ্য জলজ প্রানী ও উদ্ভিদের ক্ষতির আর্থিক মূল্য পরিমাপ করা অসম্ভব। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইউরেনিয়াম খনির বর্জ্য থেকে হাওরে বিপর্যয় সৃষ্টির অভিযোগ জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ সঞ্চারিত হওয়ার পর হাওড়ে মড়কের কারণ অনুসন্ধানে সরকার তড়িঘড়ি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল এবং অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তারা দায়সারা গোছের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়, হাওরের মাছ, হাঁস ও জলজ প্রানী মড়কের জন্য ইউরেনিয়াম দূষণের কোন প্রমান নেই। এই রিপোর্ট দেখে মনে হয়েছিল, এমন একটি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর এমন একটি বিপর্যয়ের পেছনে ভারতের ইউরেনিয়াম খনির বর্জ্য দূষণের দায় থেকে মানুষের দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করতেই যেন আনবিক শক্তি কমিশনের এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। রিপোর্টে ইউরেনিয়াম দূষণের দায়মুক্তি দেয়া হলেও ঠিক কি কারণে হাওরাঞ্চল এমন একটি ভয়াবহ দূষণজণিত পরিবেশগত বিপর্যয় ও মড়কের সম্মুখীন হল তার কোন সদুত্তোর এবং এর স্থায়ী সমাধান বা প্রতিকারের সুপারিশমালা কি ছিল তা সাধারণ্যে জানা যায়নি। সরকারী তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি বেসরকারী সংস্থার তরফ থেকেও হাওরের বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। হাওরের পাশে বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামকে সভাপতি এবং হাসনাত কাইউমকে সদস্য সচিব করে ২৮ বিশিষ্ট ‘গণতদন্ত কমিশন’ গঠন করে এই কমিশনের সদস্যরা হাওরের জেলাগুলোতে সরেজমিন ভুক্তভোগিদের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেশ আশা জাগানিয়া এই তদন্ত কমিশনের রিপোর্টও আমাদের চোখে পড়েনি। কোন অদৃশ্য ইশারায় তারাও মাঝপথে থেমে গিয়েছিলেন কিনা তা খুঁেজে দেখতে হয়তো আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। আমাদের হাওরে বিপর্যয় সংঘটিত হওয়ার আগে এবং পরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিপজ্জনক ইউরেনিয়াম খনি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সেখানকার নাগরিক সমাজকে শক্ত প্রতিবাদী ভ‚মিকা গ্রহণ করতে দেখা গেলেও ভাটির দেশ হিসেবে ইউরেনিয়াম বর্জ্যরে জন্য সবচে ঝুঁকির মধ্যে থাকা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কখনো কোন আশঙ্কা ও প্রতিবাদের কথা শোনা যায়নি। মেঘালয়ের খাসি পার্বত্য এলাকা থেকে বছরে পৌনে ৪ লক্ষ টন ইউরেনিয়াম আকরিক আহরণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থা ইউরেনিয়াম কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লি:। একত গোপণীয়তা সাথে এর দরপত্রসহ আনুসাঙ্গিক তৎপরতা সম্পন্ন হয় যে, খো;দ মেঘালয় রাজ্য সরকারকেও কিছু জানানো হয়নি। ইউরেনিয়াম উত্তোলনে ওপেনপিট মাইনিংয়ের বিরুদ্ধে মেঘালয়ের নাগরিক সমাজের প্রতিবাদি অবস্থানের পর গত বছর জুলাইমাসে মেঘালয়ের মূখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমাও ঝুঁকিপূর্ণ ওপেনপিট ইউরেনিয়াম খনি সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
হাওরের পানিতে দূষণের কারণে হাজার হাজার টন মাছ, লাখ লাখ জলজ প্রানী ও উদ্ভিদের যে অপুরনীয় ক্ষতি হয়েছে তা যদি ইউরেনিয়াম দূষণের কারণে ঘটে থাকে বাংলাদেশ তার ক্ষতিপুরণ চাইতেই পারে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ক্ষতিপুরণের দাবী তোলা দূরের কথা, ভবিষ্যতে এর চেয়েও বড় ধরনের পারমানবিক বর্জ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা সত্বেও প্রতিকারের কোন ন্যুনতম আওয়াজও শোনা যাচ্ছেনা। হাওরের পানিতে ইউরেনিয়াম দূষণের অভিযোগ প্রমানীত না হওয়ার দাবী সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক, পানি দূষণের মাধ্যমে এত বড় ক্ষয়ক্ষতির কোন বিশ্বাসযোগ্য কারণ এখনো খুঁজে বের করতে সরকারের সংশ্লিষ্টরা সচেষ্ট কিনা এ নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। হাওরের কৃষকদের ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য সরকারের ভুল উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং প্রতিবেশী দেশের পানি আগ্রাসনকে দায়ী করা যায়। বিপর্যয়ের পর পানিউন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হাওরের মানুষদের ফুঁসে উঠেতে দেখা গেছে। গণরোষের মুখে কোন কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। তবে এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যে সীমাহীন ব্যর্থতার দায় বর্তাচ্ছে তা নিয়ে এখনো তেমন কোন উদ্বেগ দেখা যাচ্ছেনা। বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের দাবী তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি বছরের পর বছর ঝুঁলিয়ে রেখে তিস্তা অববাহিকার হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ঊষর মরুকরণের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প হিসেবে এক সময় তিস্তা সেচ প্রকল্প আমাদেরকে খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে প্রকল্প এখব কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। পক্ষান্তরে বিদেশী কোম্পানীর অপরিক্ষিত কৃষিবীজ, প্রচুর রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ফাঙ্গিসাইড ও ব্যাপক সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে দেশের কৃষি অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে যেনতেন প্রকারে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে এখন আমাদের সরকার খাদ্যে স্বয়ম্বর হওয়ার দাবী তুলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। বহুজাতিক কোম্পানীর স্বার্থে এবং রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকদের গোপণ কমিশন বাণিজ্যের স্বার্থে কৃষকের সামনে একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এমন ফাঁদে পড়ে ভারতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় অর্ধশত কৃষক আত্মহত্যা করছে, বছরে এ সংখ্যা ১৬ হাজারের বেশী। ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কারণে আমাদের দেশে কৃষকের আত্মহত্যার হার এতটা শোচনীয় পর্যায়ে না গেলেও আমাদের কৃষকদের অবস্থা ভারতীয় কৃষকদের চাইতেও খারাপ। এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন জেলায় বোরোধান আবাদ করে হাজার হাজার কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে হাজার হাজার একর বোরোধানের জমি ইতিমধ্যেই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ার আগে যে সব কৃষক তাদের পাকা বা আধাপাকা ধান কেটে গোলায় ভরার চেষ্টা করছেন তাদের দুর্গতি যেন আরো অনেক বেশী। ধান বোনা থেকে শুরু করে মাড়াই করে ঘরে তোলা পর্যন্ত যে খরচ পড়ছে বাজার মূল্যে তা দাঁড়াচ্ছে উৎপাদন খরচের দ্বিগুণ। শুধু ধান নয়, আলু, টমাটোসহ রবিশস্যেও প্রায়শ একই রকম বাস্তবতা দেখা যায়। দেশের কৃষকরা এখন কৃষিকাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। আমাদের মত জনবহুল দেশে এটি একটি আশঙ্কাজনক বাস্তবতা। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, কোন নেপথ্য শক্তি অনেকটা পরিকল্পিত উপায়ে দেশকে বড় ধরনের খাদ্য ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে।
সাড়ে ৩ কোটি টনের বেশী উৎপাদনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ। আলুর পাশাপাশি গম ও ভ‚ট্টা উৎপাদনেও বাংলাদেশ দ্রæত সামনে এগিয়ে চলেছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই আমাদের সরকার খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্নতা অর্জনের দাবী করছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণতা অর্জন করা মানে হচ্ছে, আমাদেরকে আর খাদ্য আমদানী করতে হয়না। নানা সংকট সত্বেও বোরো মওসুমে প্রতিবছরই বাম্পার ফলনের খবর পাওয়া যায়, সেই সাথে উৎপাদন খরচ না উঠায় আর্থিক লোকসানে কৃষকের নি:স্ব হয়ে যাওয়ার খবরটিও যেন সাধারণ বিষয়ে পরিনত হয়েছে। অনেকটা পরিকল্পিতভাবেই যেন কৃষকের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। গত মওসুমে বোরোতে বাম্পার ফলনের পরও চলতি অর্থ বছরের ১০ মাসে দেশে ৯২ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানী করা হয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে চালের আমদানী হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টন। কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল কেনার আগেই মূলত ভারত থেকে নি¤œমানের লাখ লাখ টন চাল আমদানী করে বাজারে ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে মূল্যপতন ঘটানো হয়। ঋণ ও দাদন নিয়ে বিপাকে পড়া কৃষকরা ঋণ শোধ করতে উৎপাদন খরচেরও কম মূল্যে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে এ দেশের কৃষকদের নি:স্ব ও নিরৎসাহিত করা হচ্ছে। এক কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের উৎপাদন খরচ যখন ২৫ টাকা তখন ১৫ টাকা কেজি দরে ধান বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। অথচ সাধারণ ভোক্তারা ৫০ টাকার নিচে কোন চাল কিনতে পারেনা। সাড়ে ৩ কোটি টন চালের তিনভাগের একভাগও যদি এমন লোকসানী মূল্যে বিক্রি করতে হয়, তাহলে কৃষকদের পুঁজি থেকে এক মওসুমে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা গায়েব হয়ে মধ্যস্বত্বভোগিদের পকেটে চলে যায়। আমদানীকৃত চালের ডাম্পিংয়ের কারণে বাংলাদেশের কৃষক নি:স্ব হলে, নিরুৎসাহিত হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা আমদানী নির্ভর হতে বাধ্য। দেশে ধানের বাম্পার ফলনের মধ্যেও ভারত থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানীর অনুমতির পেছনে থাকে কিছু প্রভাবশালী আমলা ও রাজনীতিকে কমিশন বাণিজ্য আর কৃষকদের জিম্মি করে রাইস মিলারদের অতিরিক্ত মুনাফাবাজি। দেশের লাখ লাখ কৃষক পরিবারকে নি:স্ব করার মধ্য দিয়ে স্বার্থান্বেষী চক্রের এই মুনাফাবাজি বন্ধ না হলে বাংলাদেশ কখনো সামাজিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়নের আর্ন্তজাতিক মানদন্ড ও রূপকল্প এবং উন্নয়নশীল ও মধ্য আয়ের বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই আমাদের নদী, হাওর এবং কৃষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। হাওরে পানিদূষণ, মড়ক ও বিপর্যয়ের কারণ উদঘাটন এবং এ ধরনের বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জাতীয় নিরাপত্তার মতই গুরুত্বপূর্ণ।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।