পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের গ্রাম-গঞ্জ, জনপদ থেকে শুরু করে শহর ডুবে যাওয়ার মতো ঘটনা বিগত ১২২ বছরের মধ্যে ঘটেনি। কেন পুরো বিভাগ এভাবে ডুবে গেল এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা এবং গবেষণা ও অনুসন্ধান স্বাভাবিক। বন্যার শুরুতেই ভয়াবহ রূপ দেখে বিশেষজ্ঞরা এর জন্য হাওর ও নদীর ভরাট হওয়া এবং পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলাকে দায়ী করেছেন। বুয়েটের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের দুই শিক্ষার্থী এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)-এর করা এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ৩২ বছরে দেশের হাওর অঞ্চলের ৮৬ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। হাওরে বৃষ্টির পানি ধারণক্ষমতা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। সিলেটসহ আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি হাওর ভরাট হয়েছে ২০০০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে। হাওরের বাকি অংশ রক্ষা করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আগে বৃষ্টি হলে হাওর অতিরিক্ত পানি ধরে রাখত এবং সেখান থেকে নদী দিয়ে নিষ্কাষিত হতো। হাওর ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণক্ষমতা কমেছে এবং তা জনপদ ডুবিয়ে দিচ্ছে।
দেশের নদ-নদী, হাওর, জলাশয়, খাল ভরাট হওয়া নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে অবৈধ দখল ও দূষণের কারণে অসংখ্য জলাশয় যেমন ভরাট হয়ে গেছে, তেমনি নদ-নদী নাব্য হারিয়ে মরে গেছে। আমরা যদি রাজধানীর চারপাশের চার নদীর কথাই ধরি তাহলে দেখব, অবৈধ দখল ও দূষণে এগুলো নাব্য হারিয়ে মরে গেছে। ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বহু চেষ্টা করেও এগুলোর প্রাণ ফেরানো যাচ্ছে না, অবৈধ দখল ও দূষণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। যেখানে চারপাশের নদীর কারণে রাজধানী অপূর্ব সৌন্দর্যের নগরীতে পরিণত হতে পারত, সেখানে তা আবর্জনা দ্বারা ঘিরে রয়েছে। রাজধানীর যে পানিবদ্ধতা এর জন্য নদ-নদীর নাব্য হারানো ও ভরাট হয়ে যাওয়াই অন্যতম কারণ। দেশের বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে সর্বত্রই নদ-নদী ও জলাশয়ের একই অবস্থা। এ এক ভয়াবহ এবং প্রকৃতিকে ধ্বংস করার আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড ছাড়া কিছু নয়। একশ্রেণীর মানুষই এই অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। সরকার প্রধান প্রধান নদ-নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য বছরে শত শত কোটি টাকা ড্রেজিংয়ে ব্যয় করলেও তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। হাওর, জলাশয়, খাল-বিল ভরাট হয়ে পানি ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় বন্যা ও বৃষ্টির পানির অতিরিক্ত চাপ নদ-নদীতে পড়ছে। এতে জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে পলি পড়ে নদ-নদী, হাওর ও জলাশয় বন্ধ হওয়া এক বিষয়, আর মানুষের দখল-দূষণে ভরাট হওয়া আরেক বিষয়। এই দুইয়ের মধ্যে মানুষের অপকর্মই বেশি হচ্ছে এবং হাওর ও জলাশয় ভরাট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এটা কল্পনাও করা যায় না, দেশের ৮৬ শতাংশ হাওর ভরাট হয়ে গেছে, অথচ তা খননের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ পরিস্থিতিতে বন্যা হওয়া স্বাভাবিক এবং খনন না করলে আরও ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে। সিলেটে বন্যা ভয়াবহ বন্যা হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, সুরমা ও কুশিয়ারা ভরাট হয়ে যাওয়া। নদী দুটির তলদেশ বুড়িগঙ্গার মতোই পলিথিনের পুরো স্তর জমেছে। এতে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি ধারণ করতে না পারায় সিলেট শহরসহ পুরো বিভাগ বন্যায় ডুবে যায়। চট্টগ্রাম ডুবে যাওয়ার মূল কারণ কর্ণফুলীর অবৈধ দখল ও দূষণ। অন্যান্য বিভাগ ও জেলা শহরের নদ-নদী ও জলাশয় ভরাট হওয়ায় সেখানে বন্যা দেখা দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বন্যা থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাওয়া যাবে না।
আমরা সবসময়ই পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের কথা বলি। তবে তা কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে। নদ-নদী, জলাশয়, খাল-বিলের অবৈধ দখলের একধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। যে যেভাবে পারছে দখল করে ভরাট করে ফেলছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার একশ্রেণীর প্রভাবশালী জড়িয়ে আছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে প্রকৃতিও আমাদের ওপর যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে। আবহাওয়ার উষ্ণায়ন এবং বিরূপ পরিবর্তন ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে লবণাক্ত পানি ভূভাগে প্রবেশ করছে। নদ-নদীর পানি প্রবাহ সাগরে যেতে বাধা পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া আমাদের মতো দেশের মোকাবিলা করার সক্ষমতা নেই। তবে আমরা বন্যা থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেতে পারি নদ-নদী নাব্য রেখে এবং হাওর, জলাশয়, খাল-বিলের ভরাট ও অবৈধ দখল দূষণ বন্ধ করে। এদিকে সরকারের বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। এজন্য বৃহৎ পরিকল্পনা নিতে হবে। আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। ড্রেজিং করে হাওর ও জলাশয়গুলোর পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। তা নাহলে, প্রতিবছরই ভরাট হবে এবং ভয়াবহ বন্যা দেখা দেবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।