শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মালিকের পাঁচতলা বাসাবাড়ি। কিন্তু মোটেও বাসা ভাড়া দিতে চান না। কোনো এক সময় তাঁর ছোট ছেলেকে বাসায় পড়ানোর সুবাদে নিচতলা জোরজুলুম করে ভাড়া দিয়েছিলেন হোম টিউটরের কাছে। হিজিগিজি করে এখন সেখানে থাকে সাতজন ব্যাচেলর। মালিকের বড় ছেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে শশুড় বাড়ি থাকেন। মাঝে মাঝে আসেন, আবার যান। ছোট ছেলে চাকুরী করেন। সকালে যায় আর রাতে বাসায় ফেরেন। মালিকের স্ত্রী দু’বছর যাবৎ প্যারালাইসিস হয়ে বিছানাগত। ধরা চলে, তাঁর জীবন এই আছে, এই নেই। মালিক আগে সরকারী চাকরী করতেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। তবে বয়স কিন্তু তেমন বেশি নয়। কোনো এক দু’নম্বর কাজ করতে গিয়ে ধরা খেয়ে চাকরী হারিয়েছেন। তবে এ নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। প্রচুর টাকা পয়সাওয়ালা লোক তো। এছাড়া দু’ছেলে চাকরী করে। এর জন্য হয়তো বাড়িও ভাড়া দেন না। বড় কথা, বাড়ি ভাড়া দেওয়া এক প্রকার ঝামেলা মনে করেন। এই ধরুন, বারবার গেট খোলা, ট্যাংকের পানি বারবার ফুরিয়ে যাওয়া কিংবা যখন তখন হাকডাক ইত্যাদি তিনি পছন্দ করেন না। শুধু মাত্র মোজাইকের সিঁড়ি আর ঘর মোছার জন্য একজন ও রান্না করার জন্য একজন, এই দু’জন কাজের লোক তিনি রেখেছেন। এরা কম বয়সী। হয়তো দরিদ্রতার কারণে কম বয়সে এসব কাজ করে। মালিকের বাহ্যিক সুখ অনেক। কিন্তু মানসিকভাবে মোটেও শান্ত নয়। সরকারী চাকরীর স্বার্থে বউ-বাচ্চা রেখে বাহিরে বাহিরে থাকতেন। কিন্তু যেই না ফিরলেন, তখনই স্ত্রীটার রোগে ধরল। তাহলে আর মানুষের জীবনে সুখ বলে কিছু থাকে? দূরত্ব যেন কমলোই না। এর জন্য তাকে বিষন্ন লাগে।
মালিক প্রতিদিন বিকাল চারটা নাগাদ বাসার নিচতলার পশ্চিমপাশের বেলকুনিতে বসে থাকেন। কেন বসে থাকেন, তাঁর হয়তো অনেক কারণই থাকতে পারে। প্রথমত, সারাদিন বিছানা পড়া রোগীকে দেখতে তার আর ভাল লাগে না। দ্বিতীয়ত, নিজেকে একা রাখার অভ্যাস করেন। যাতে বাইচান্স স্ত্রীর বিদায়ে বাঁকী জীবনটা পাড়ি দিতে পারবেন। তৃতীয়ত, ছেলেদের পথ চেয়ে বসে থাকে। ছোট ছেলে বিয়ে করে নি। কিন্তু বড় ছেলের তো একটা মেয়ে আছে। তারা যদি এ বাসায় থাকত তাহলে নাতনীর, ছেলের বউয়ের মুখ দেখতে পারত। অন্তত নাতনীকে নিয়ে হাসি-তামাশা করার একটা মূহুর্ত্ব পেতেন। কিন্তু সে আশায় তো গুড়েবালি। শাশুড়িকে পরিচর্যা করা লাগবে ভেবে ছেলের বউ এ বাড়িতে একদমই পা রাখে না। শেষ কবে এসেছিল তার কোনো ডেট ফিক্সড নেই। এটাই বর্তমান সমাজের একপ্রকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈ কি। কেউ কারও নয়, সবাই শুধুু সম্পদের আশা করে। যদিও ছেলেরা বিয়ের আগে এমন থাকে না, কিন্তু পরের ঘরের মেয়ে এলে বদলে যায় আবদার। এ পরিবারেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি বললে একদম ভুল হবে না।
নিচতলার ব্যাচেলররা সবাই ছোট বড় চাকরী করে। তাই কেউ সকাল আটটায় যায়, রাত দশটায় ফেরে। আবার কেউ দশটায় যায়, রাত আটটায় বাসায় ফেরে। তাদের কাজের বুয়ার সাথে ছুটির দিন কিংবা শুক্রবার ছাড়া দেখা হয় না। সব কিছু রুটিন অনুযায়ী কেনাকাটা করা থাকে, বুয়া সকাল ছয়টার আগেই রান্না করে চলে যায়। আবার বিকাল চারটায় এসে রাতের রান্না করে। এই বুয়া এখানে প্রায় দেড় বছর ধরে চাকরী করেন। তাঁর বয়স আনুমানিক চল্লিশ বা তার একটু বেশি হবে। স্বামী সড়ক দূর্ঘটনায় প্রায় পনের বছর আগে মারা যায়। অর্থাৎ বিয়ের পাঁচ সাত বছর পরপরই বিধবা হতে হয়। একটা সন্তান নেওয়ারও সুযোগ হয় না। বাকী জীবন চালাতে পরের বাড়িতে কাজ করে বেড়ায়। মহিলাটি দেখতে বেশ ভালই। যেমন আচার আচরণে, তেমনি সৌন্দর্যে। হয়তো যৌবনে অনেক পুরুষই তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে। কিন্তু এখনও যে তার রুপের যৌলুশ কমে নাই। ব্যাচেলরা যদি নিয়মিত দেখত, হয়তো তাদের কেউ কেউ প্রেমে পড়ে যেত। কিংবা অচেনা নম্বরে কল করে আলাপ-ঠাট্টা করার সুযোগ নিতো।
বুয়ার প্রতিদিন বিকালে রান্নার করার জন্য আসতেই বাসার মালিকের চোখে চোখ পড়ে যায়। মালিক হয়তো অপলক দৃষ্টিতে তাকায়, কিন্তু তিনি লজ্জায় আঁচলে মুখটি ঢাকেন। নিজের দূরত্ব বাড়িয়ে দেন। তিনি যতদিন থেকে এই ব্যাচেলরদের রান্নার কাজ করছেন, ততদিন থেকে বিকালে এমন দৃশ্যের অবতারনা করতে হয়। কিন্তু আর কত! সবারই তো মন-জীবন-যৌবন বলে কিছু আছে। বুয়াটি রান্না করে আর ভাবেন, ‘লোকটি আমার দিকে এমন করে তাকায় কেন? সে কি আমাকে দিয়ে তার স্ত্রীর অভাব পূরণ করতে চায়?’ এমন সাত পাঁচ ভেবে তওবা করেন। কিন্তু মালিকও চায় বৈ কি এভাবে প্রতিদিন বেলকুনিতে বসে থাকেন কেন? হয়তো মালিক চিন্তা করেন, ‘আমার কপালপোড়া বউটি গত হলেই ঐ সুন্দরীকেই জীবনের দ্বিতীয় বুয়া করে নেব। এ জীবন আর ভাল লাগে না।’ কাজের বুয়াকে দেখলে যে কারোরই মনে হবে, তার তেমন কোনো লোভ-লালসা নেই। লোভ-লালসা থাকলে হয়তো এমনই কোন এক পুরুষের সাথে সংসার গড়ে তুলত। কিন্তু এই বাড়িওয়ালার প্রতি তার কেমন যেন একপ্রকার দূর্বলতা কাজ করে। জিজ্ঞেস করতে চায়, ‘সাহেব আপনি কি চান?’ কিন্তু পরক্ষণে ভাবেন, ‘না তিনি সাহেব আর সামান্য দাসী। তার সাথে যেমন আমার কথা বলা মানায় না, তেমনি স্বপ্ন দেখাও হাস্যকর ব্যাপার।’ আর দু’জনের মাঝে এমনই দূরত্ব সর্বদা খেলা করে।
দেড় বছরের যাতায়াতে দু’জন দু’জনকে ঠিক বিকাল চারটায় কতবার যে দেখেছে তার কোনো শুমারি নাই। কিন্তু এই তিনদিন যাবৎ বুয়াটি বাসার মালিককে একবারও দেখেন নি। স্বভাবতই তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। কাজেও তেমন মন বসে নি। কাজের ফাঁকে বারবার এসে বেলকুনি দেখে গেছে। কিন্তু সে পুরুষ যেন হারিয়ে গেছে, এমনটা ভেবে বুয়া ব্যর্থ হয়েছেন যতবার হওয়া যায়। কিন্তু চতুর্থ দিন কিংবা তারও ক’দিন পর মালিক সেই একই জায়গায় আবার ফিরে এসেছেন। বুয়া তাকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ল। আর মুখ ফস্কে বলেই ফেলল,
: সাহেব, আপনি আইজক্যা আসিছেন?
সাহেব তার দিকে ঘুরে তাকাতেই ওমনি বুয়া তার জিব্বায় কামড় দিয়ে সব কিছু ভুলে বলল উঠল,
: আপনাকে বলি নাই যে, সাহেব।
মালিকের সামনে একটি বাক্য বলেই বুয়া রীতিমত ভয় পেয়ে যায়। নিজেকে সামাল দিতে পারে নাই। তাই সাহেবকে অন্তর থেকে ডেকে ফিরেছেন। কিন্তু সাহেব তার ডাক বুঝতে পারলেও প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় করে উঠতে পারেন নি। বুয়ার জিব্বায় কামড়কে ধ্রুব সত্য জেনে তাঁর মুখটি বন্ধ করে দিয়েছেন। অথবা তার অভিমান থেকে তার সাথে কথা বলতে বোধ করেন নি। সত্যই আসলটা বোঝা বড় দায়।
মধ্যবয়সী দু’জনের এভাবেই চোখাচোখিতে বাকী দিনগুলোও চলছে। মালিক সেই আগের মত একাকী বেলকুনিতে প্রহর গোনেন। ওদিকে বুয়া এসে ব্যাচেলরদের রান্না করে ফিরে যায় বেদনার গন্তব্যে। এখন আর নিজেকে ছাড়া আর দ্বিতীয় কাউকে ভাবে না। স্বামীর কথা ভেবে কেঁদে ওঠে মাঝে মাঝে। চোখের জল ঝরে আর বলতে থাকতে, ‘ওহে সাহেব, আপনি তো আপনার প্রিয় জনের মুখ দিনে একবার হলেও দেখতে পাচ্ছেন আর আমি অন্তরে স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি জনম জনম ধরে।’
-শিল্পী : মকবুল ফিদা হোসেন
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।