(পূর্বে প্রকাশিতের পর)/ মুসলিম মনীষীদের মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ:
মাতৃভাষা মানুষের জীবনে কত যে গুরুত্বপূর্ণ তার প্রতি লক্ষ রেখে মনীষীরা ম‚ল্যবান উক্তি করেছেন। যেমন- হজরত ইবরাহীমের আ. সহিফায় লেখা ছিল, “জ্ঞানীর জন্য উচিত তার ভাষা ও সাহিত্যের সংরক্ষণ করা, যুগসচেতন হওয়া ও স্বীয় কর্তব্যে সদা মগ্ন থাকা।” হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি র. তাঁর এক ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, “যদি হিন্দুস্থানে দ্বীনি খেদমত করতে চাও, তবে উর্দু ভাষায় যোগ্যতা অর্জন করো।” প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, “প্রত্যেকেরই শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষা হওয়া উচিত। অপর ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর।” সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী র. বলেন, “কোনো দেশে দ্বীনি খেদমত করতে আগ্রহী ব্যক্তিকে সে দেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি বোধ পূর্ণ মাত্রায় অর্জন করতে হবে।” হুসাইন আহমদ মাদানী র. বলেন, “যতক্ষণ না তোমরা আপন ভাষা সাহিত্যের অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা রাখবে, ততক্ষণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।”
ইমাম আযম আবু হানিফা র. এর মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ: ইমাম আবু হানিফা রহ. মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার দেশবাসীর জন্য মাতৃভাষা ফারসি ভাষায় আল কুরআন অনুবাদ করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তা নামাজে তিলাওয়াতের অভিমত প্রদান করেন। অবশ্য এই অভিমত তিনি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের স্বার্থে প্রত্যাহার করে নেন। এ ঘটনায়ও ইসলামে মার্তৃভাষা মূল্যায়নের প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া মনের আকাঙ্খা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে হলেও মাতৃভাষায় সর্বোত্তম সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে মাতৃভাষায় ইসলাম প্রচার :
ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর খিলাফতকালের মাঝামাঝিতে অর্থ্যাৎ ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি দেশ হতে ইসলাম প্রচারকগণ বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করার জন্য এসেছেন। তারা এ দেশে এসে এ দেশের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করেছেন এবং এ দেশের মানুষের ভাষাতেই ইসলাম প্রচার করেছেন। এ দেশের মানুষ অতি সহজেই তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে, ফলে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
মুসলিম মননে মাতৃভাষাপ্রীতি সঞ্চারিত হয়েছে ইসলামের মাতৃভাষার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপের কারণে। সুতরাং নিজ মাতৃভাষা বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা অপরিহার্য বিষয়। পবিত্র কুরআন মজিদ ও হাদিসে নববি তথা ইসলামের আলোকে ধর্মপ্রাণ মানুষের সৎ মনোভাব প্রকাশের দ্বারা মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, ইসলাম প্রচারে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা এবং সর্বোপরি বিশ্বমানবতার কল্যাণে মাতৃভাষার চর্চা, অনুশীলন, সংরক্ষণ ও উৎকর্ষ সাধনে ভাষা শহীদদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনে সবাইকে দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করতে হবে।
১৯৫২ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনকে উদযাপন করলেও কয়েক বছর ধরে এ দিবসটি আর্ন্তজাতিকভাবে প্রতিটি দেশে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এটা আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের মানুষের জন্য বড় অর্জন। কাজেই এ দিন আমরা বিভিন্ন জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের তত্তকে এই ভাষায় আলোচনা করা এবং বাংলাভাষায় ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে এই ভাষাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করব। এই ভাষা এই দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে যেন সুস্থ থাকে। অপসংস্কৃতির কু-প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে, শিরকের প্রভাব থেকে যেন মুক্ত থাকে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, ইসলাম মাতৃভাষাকে যথার্থ মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদানের শিক্ষা দেয়। আর এই শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদেরকে মাতৃভাষাকে সম্মান করতে হবে, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের সংগ্রাম করতে হবে এবং প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আরবি ভাষা আমরা চর্চা করব। কারণ এটি কুরআন ও হাদিসের ভাষা। আর আল্লাহ পাক একুশের যে গৌরব বাঙালি মুসলমানদেরকে দান করেছেন, তা যেন ইসলামের কল্যাণে, এই দেশের মুসলমানদের কল্যাণে আমরা ব্যবহার করতে পারি ও এ ভাষার মাধ্যমেই যেন আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারি, মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে সে তাওফিক দান করুন।