Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উলামায়ে দেওবন্দের অবদান ও আমাদের প্রত্যাশা

আতিকুর রহমান নগরী

| প্রকাশের সময় : ১ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম



আমি বকলমের পক্ষে উলামায়ে দেওবন্দের অবদান উল্লেখ করা, মহাপন্ডিতের পরিচয় দেয়ার সমান। তাছাড়া ইলমি মাহারাত তো নেই বললেই চলে। জানি আমার সমবয়সী আর কওমী পড়ুয়ারা লেখার মুকাদ্দিমা দেখে বাঁকা চোখে তাকাবেন। আর কেউবা হাসবেন। উলামায়ে দেওবন্দের অবদান লিখতে গেলে কলমের কালি আর জ্ঞানশূন্যতার সম্মুখিন হবো আমি। যারপর নাই ইলমে তারিখ মুতাআলা করতে হবে। কিতাবের ইবারাত বুঝার মত ইলমও নেই আমার। আমি সেরেফ দুটি মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলের মুসলমানদের অতীত ও হালযামানার হালের কথা বলবো যেখানে মুসলমানরা ছিলেন একসময় অনেক প্রভাবশালী।
প্রথমতঃ আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ আর দ্বিতীয়তঃ পূর্ব ইউরোপ। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম শাসকরা প্রায় ১২০০ বছর দেশ শাসন করেছেন। বিভিন্ন সময় এখানে মুসলমানের সংখ্যা কমবেশী হয়েছে। সর্বশেষ যখন মুসলমানরা এখানকার শাসনের কতৃত্ব হাতছাড়া করেন, তখন সেখানকার মুসলমানের সংখ্যা ২০-২২% ছিল বলে ধারণা করা হয়। এখন এই সংখ্যা ৩০-৩৫% এর মধ্যে অবশ্য কাদিয়ানী-শিয়ারাও আছে। পক্ষান্তরে পূর্ব ইউরোপে মুসলমানদের শাসনামল নির্দিষ্ট করা কিছুটা দূরহ ব্যাপার, কেননা মুসলমানরা সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময় কাল ধরে শাসন করেছেন। যেমন তুরস্ক, সাইপ্রাস, আজারবাইজান সেই খুলাফায়ে রাশেদীনের সোনালি যুগ থেকেই। আবার কিছু কিছু অঞ্চল শত বছরও মুসলমানদের রাজত্বে ছিল।
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো মোটামুটি তুরস্ক, সাইপ্রাস, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, বসনিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রিস, আলবেনিয়া, কসোভো, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া, মন্টিনিগ্রো, মেসিডোনিয়া ও রাশিয়ার বেশ কিছু অংশ। এর মধ্যে তুরস্ক ও আজারবাইজানে প্রায় ৯৮% মুসলমান। তুরস্কের এরা ২৫% আজারবাইজানে ৮০% আলাভী আছে। এছাড়া অন্যান্য দেশগুলোতে মুসলমানের সংখ্যা- কসোভোতে ৯৫% আলবেনিয়াতে ৯০% বসনিয়াতে ৫০% মেসিডোনিয়াতে ৩৫% সাইপ্রাসে ৩০% বুলগেরিয়া, জর্জিয়া, মন্টেনিগ্রো ও রাশিয়াতে ২০% সার্বিয়ায় ২% এ সংখ্যা অবশ্য কসোভো স্বাধীন হয়ে যাবার পর এবং স্লোভেনিয়াতে ৪% মুসলমান আছেন। আর আর্মেনিয়াতে একসময় প্রচুর পরিমাণে মুসলমান থাকলেও এখন তা ১% এর কম। মোটামুটি এ পুরো অঞ্চলে ১৫%-২০% এরমত মুসলমান আছেন। তবে এ পরিসংখ্যান জরিপ ভিত্তিক। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশী হতে পারে। ১৯২৩ সালে তুর্কি খেলাফত বিলুপ্ত হওয়ার আগমুহুর্ত পর্যন্ত (কম বেশী) মুসলমানদের শাসনাধীন ছিল। ধারণা করা হয় সেসময় নাগাদ এখানে ৪৫-৫০% মুসলমানগণ বাস করতেন। এরপর ৭০-৮০ বছরের জন্য এখানে কমিউনিজমের অভিশাপ নেমে আসে। এবছর গুলোতে মুসলমানদের ভাগ্যে কী ঘটে ছিল তা জানা যায়নি। কোনো সংবাদ মাধ্যমেও এর খবর আসেনি। আর কোনো ইতিহাসও সেভাবে পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদদের ধারণানুযায়ী মুসলমানদের বেশ বড় একটা অংশ শহীদ হয়েছেন, কিছু সংখ্যক মুসলমান নাস্তিক বা ধর্মান্তরিত হয়েছেন আর কিছু হিজরত করে আরব ও পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশে চলে গিয়েছেন। আবার কিছু বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশগুলো যেমন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী ইত্যাদি দেশগুলোতে পাড়ি জমিয়েছেন। আর যারা থেকে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মুসলমানিত্ব অবশ্য খুব কম লোকদেরই ছিল। শুধু মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেয়া ছাড়া আর কোন আলামত ছিল না। অনেকে অবশ্য তাও দিতে চায়নি। এছাড়া তাদের চলাফেরা, জীবন যাপন পদ্ধতি, বিয়ে-শাদী, চিন্তা-ভাবনা, পোষাক-আষাক, সংস্কৃতি-কালচার কোন দিক দিয়েও মুসলমান হিসেবে চেনার কোন উপায় নেই। বিভিন্ন মুসলিম অকেশনে এসব দেশের বাইরের মুসলমানদেরই শুধু কিছু কর্মকা- নজরে আসে, যাদের বেশীর ভাগই নওমুসলিম অথবা আরব বা উপমহাদেশীয় অভিবাসী। আজ অবস্থা তো এই, অধিকাংশ মানুষ জানেও না যে, এসব দেশে এতো সংখ্যক মুসলমান আছেন। মানুষ ইউরোপের মুসলমান বলতে শুধু ফ্রান্স, ইংল্যান্ড আর জার্মানীর অভিবাসী মুসলমানদেরই বুঝে। অথচ এসব এলাকায় যুগ যুগ ধরে মুসলমানরা বাস করে আসছেন।
পক্ষান্তরে আমাদের উপমহাদেশে ১৭৫৭ সালের পর থেকেই মুসলমানদের তেমন কোন রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রভাব ছিল না। আর ১৭৯৯ সালের মহীশুরের সিংহ টিপু সুলতানের পরাজয়ের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে হাত ছাড়া হয়ে যায় শাসনের চাবিকাঠি। এরপর মুসলমানদের ইতিহাস শুধু অপমান, লাঞ্ছনা, অত্যাচার আর গণহত্যার ইতিহাস। এর আগে মুসলমানদের প্রতিটি জনপদে মাদরাসা ছিল। এসব মাদরাসা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় চলত। আর বড় বড় জায়গীর ছিল এসব মাদরাসার নামে। এ দিয়েই এর খরচ চলত। কারও কাছে সাহায্যের হাত পাততে হতো না এসব মাদরাসার। কাউকে পাত্তা দেয়ার দরকারও পড়তো না। কাউকে বেতন দিয়ে পড়তে হতো না। ইংরেজরা একে একে সব মাদরাসা ধ্বংস করে কিলার মিশন চালায় উলামায়ে কেরামদের উপর। যাকে যেখানে যেভাবে পেয়েছে কোন ধরনের অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই নিত্য নতুন প্রক্রিয়ায় প্রাণদ- দিয়েছে। লোমহর্ষক সব উপায়ে শাস্তি দিতে থাকে। বিরতিহীনভাবে অত্যাচারের ষ্টিম রোলার চালাতে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, মুসলমানদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে ভূমিদাস বানানো হয়। মুসলমানদের দৈনন্দিন আ’মালে বাঁধা প্রদান করা হয়। দাঁড়ির উপরও উচ্চ হারে কর বসানো হয়। মুসলমানদের ঈমান-আকীদা ধ্বংস করার জন্য সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ফেরকা বা দলের জন্ম দেয়া হয়। একই সাথে বিভিন্ন ভাবে ভুল বুঝিয়ে অনেক সরলমনা মুসলমানদের খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। এর সাথে পর্তুগিজ ও ফরাসী দস্যুদের অত্যাচার তো ছিলই। এদেশীয় হিন্দুদেরও মুসলমান সম্পর্কে খারাপ ধারণা ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে বিবাদ বাঁধিয়ে দেয়া হয়।
এরই প্রেক্ষাপটে কিছু উলামায়ে কেরাম অন্তরালে চলে যান। আর জনবসতিশূন্য একটি গ্রামে আল্লাহওয়ালা, আল্লাহভীরু প্রকৃত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে একটি দ্বীনের দূর্গ তৈরি করেন। দেওবন্দ নামক গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় কালজয়ী, বিশ্বসেরা ইসলামি বিদ্যাপিঠ।
আমাদের ভাবনায় দেওবন্দ ও উলামায়ে দেওবন্দ: দেওবন্দ সেরেফ একটি মাদরাসার নাম নয়, এটা হচ্ছে মুত্তাকি তথা আল্লাভীরু মানুষ গড়ার মিশন। দেওবন্দ শুধু দারস-তাদরিস তথা দ্বীন শেখা আর শেখানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং দ্বীনে এলাহির শত্রুদের দমন আর শক্তহাতে বাতিল অপশক্তির মোকাবেলা করার জন্য যার পথচলা।
দেওবন্দ মাদরাসা নতুন কোন সম্প্রদায় বা নতুন কোন আকীদা নয়। নতুন কোন ধারাও নয় আবার কোন ফেরকাও নয়, বরং উপমাহাদেশের ইসলামের ধারাবাহিকতাই দেওবন্দ মাদরাসা। অবশ্য এরপর থেকে উপমহাদেশের ইসলামের ইতিহাস আর দেওবন্দের ইতিহাস সমার্থক। কেননা উলামায়ে দেওবন্দের নিস্বার্থ শ্রম-সাধনা আর কুরবানীর বদৌলতে, ত্যাগ তিতিক্ষা আর বিচক্ষণ কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমেই ইসলামের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রেখেছেন। বলতে পারেন মহানবী সা. এর মক্কি জীবনের এক প্রতিচ্ছবি ছিল দেওবন্দের শুরুর দিকটা। পরবর্তীতে উলামায়ে দেওবন্দের উপরও চলে ইংরেজদের লোমহর্ষক সব অত্যাচার। দেওবন্দের প্রথম ছাত্র মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে মাল্টায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইতিহাস বলে শায়খুলহিন্দ রাহ. এর উপর হযরত খাব্বাব রা. এর মত অত্যাচার চলে। আজকের গুয়েন্তানামো বে এর জেলখানার কথা শুনেই আমরা অবাক হই। সারা দুনিয়ার কাফেররা পর্যন্ত সোচ্চার। কিন্তু মাল্টার জেলখানার তুলনায় গুয়েন্তানামোবে অনেক আরামের জায়গা। এভাবে দু’শ বছর অত্যাচার চলে। আসল ব্যাপার হল ইংরেজরা চেয়েছিল ইসলাম মিটে যাক। ইসলাম মেটানোর জন্য সম্ভাব্য যত পদ্ধতি তাদের জানা ছিল সবই তারা প্রয়োগ করেছিল।
]কিন্তু এই সব মহান আলেমদের কুরবানী এ অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা তো বাড়ছেই। আজও এখানে নবীজির সুন্নত ১০০% পালন করার জন্য আগ্রহী মানুষের অভাব হয় না। নবীজির শানে বেয়াদবীর প্রতিবাদে, ইসলাম বিদ্বেষীদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতে, ইসলামকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে জীবন দেয়ার জন্যও মানুষের অভাব নেই এখানে। পূর্ব ইউরোপে এমনটা হয়নি, কেননা সেখানে দেওবন্দ ছিল না। এজন্যই মাত্র আশি বছরেই ইসলামের নাম বাদে সবই মিটে গেছে। এমনকি যে তুরস্ক একসময় পুরো মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব দিয়েছিল তারা আজ ধর্ম নিরপেক্ষতার নেতৃত্ব দিচ্ছে। পূর্ব ইউরোপ আর ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামের অতীত ও বর্তমানের তুলনাই দেওবন্দের ভূমিকা তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।’
উলামায়ে দেওবন্দ হচ্ছেন ‘লা খাওফুন আলাইহিম ওয়ালাহুম ইয়াহযানুন’ এর প্রতিচ্ছবি। ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবি’ এর পূর্ণ যোগ্যতা সম্পন্ন জামাতের নাম হচ্ছে ‘উলামায়ে দেওবন্দ’। ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতের মূর্ত প্রতীক তারা। নাস্তিক-মুরতাদ, কুফুরি-বিদআতসহ সকল অপশক্তি আর বাতিল মতবাদের বিরুদ্ধে এক হুংকার। যুগ যুগ ধরে উলামায়ে দেওবন্দ নিরলসভাবে জাতিকে তাওহীদের তালিম দিয়ে আসছেন। কোনো গোলামীর শিকলে তারা জাতিকে আবদ্ধ হতে দেননি বরং এক আল্লাহর গোলামীতে মুসলিম উম্মাহকে সদা উৎসাহ দিয়ে আসছেন।
উলামায়ে দেওবন্দের কাছে আমাদের অনেক আশা। চাওয়া-পাওয়াও কম নয়। মনের চাহিদা অনেক আছে। প্রত্যাশাও সীমাহীন। যেখানে আশা বেশী সেখানে আশাভঙ্গের বেদনাও বেশী। আমরা চাই আজও সেই কুরবানী বজায় থাকুক। আজও সেই কুরবানীর চাহিদা আছে; বরং আরও বেশী। আমরাও আছি আপনাদের সাথে। যুগ চাহিদার খোরাক মেটাতে যখন যা প্রয়োজন, পর্যায়ক্রমে উলামায়ে দেওবন্দ পদক্ষেপ নিবেন। আমরা তাঁদের স্বর্ণালি পদক্ষেপের অপেক্ষায় থাকলাম।

লেখক: শায়খুল ইসলাম ইন্টারন্যাশনাল জামেয়া
ই-মেইল : ংুষ.ধঃরশহড়মড়ৎর@মসধরষ.পড়স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন