কুরআন শরীফে পাঁচশটির মতো আয়াত এসেছে শরীআতের নিয়মনীতি সংক্রান্ত। পক্ষন্তরে এক হাজারের মতো আয়াত এসেছে জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনায়। হাজারের বেশি আয়াত এসেছে অতীত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সংবাদ বিষয়ে। তাই একজন মুহাদ্দিস, মুফাসসির বা ফকীহ যখন ইলমে শরীআতের ব্যাপারে কথা বলেন, তখন আমরা শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করব। দ্বীন সম্পর্কে তাঁরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অবগত। তবে তাঁরা যখন জাগতিক জ্ঞানের ব্যাপারে কথা বলেন, তখন আমাদেরকে সেটি খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ সন্দেহের উর্ধ্বে কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যে অকাট্য বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কালামকে গ্রহণ করা হয়, একই রকম বিশ্বাস নিয়ে কারও ব্যক্তিগত রচনা, মতামত বা ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, ওয়াযের মাহফিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানাকিব, মুজিযা, সাহাবায়ে কিরাম ও আউলিয়ায়ে কিরামের মর্যাদা, কারামাত, তাঁদের শিক্ষা ও আদর্শ বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রেও কেউ কেউ এমন বানোয়াট বর্ণনা উপস্থাপন করেন যা ক্ষেত্রবিশেষে ঈমান-বিধ্বংসী। মনে রাখা উচিত, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে মান ও মর্যাদা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বয়ান করেছেন, তার চেয়ে বাড়িয়ে বলা কোনো মাখলুকের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার কেউ এর থেকে বিন্দুমাত্র কমাতেও পারবে না। অতএব কুরআন, হাদীস ও সাহাবীদের আকীদা বাদ দিয়ে নিজের মনমতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা প্রণয়ন করতে গেলে সেটি চরম বেয়াদবি বৈ কিছু হবে না। একই কথা মুজিযার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত, আউলিয়ায়ে কিরামের জীবন ও কারামত ইত্যাদি বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আউলিয়ায়ে কিরামের কারামাত সত্য। তাই বলে পুঁথিসাহিত্য থেকে আজগুবি কল্পকাহিনী তুলে এনে বুযুর্গদের নামে চালিয়ে দেওয়ার কোনো মানে নেই। ওগুলোর আধিক্যের কারণে তাঁদের প্রকৃত খিদমাত দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। অথচ যুগে যুগে আল্লাহর ওলীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ কালিমার ছায়াতলে এসেছে। পার্থিবতাকে দূরে ঠেলে তাঁরা সবর-শুকর ও তাওয়াক্কুলের উপর জীবন পার করেছেন। এগুলোই বর্ণনা করা উচিত। আমাদের বাস্তব জীবনকে প্রভাবিত করে আউলিয়া-মুত্তাকিদের জীবনদর্শন, ত্যাগ ও লিল্লাহিয়্যাত।
তৃতীয়ত, ওয়াযের আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজন। বিষয় নির্ধারণ বলতে তিনটি কথা উদ্দেশ্য। যথা-
(১) বক্তাকে বক্তব্যের বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ এবং দৈনন্দিন জীবনের ফরয ও নফল আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। একই সাথে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও অনাচারের ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করা এবং নব-নব ফিতনার দলীলভিত্তিক জবাব দেওয়াও ক্ষেত্রবিশেষে অনেক জরুরি। বক্তাকে কেবল সমস্যার সূচিপত্র পাঠ করে গেলেই হবে না। সমস্যা থেকে উত্তরণের উপযুক্ত পথও মানুষকে দিয়ে যাওয়া আবশ্যক।
(২) কোন বক্তাকে কী ধরণের বিষয় দেওয়া হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল রাখা। দুটি উদাহরণ দিলে কথা পরিষ্কার হবে। ওয়ায মাহফিলে ‘নারীর পর্দা’ বিষয়ে প্রায়ই আলোচনা শোনা যায়। অনেক জায়গায় দেখি, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে লোক হাসাতে পারদর্শী বক্তাকে এ ধরণের বিষয় দেওয়া হয়। অথচ পর্দা ইসলামের ফরয বিধান, যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে কুরআন শরীফের সূরা নূর ও সূরা আহযাব থেকে তাত্ত্বিক আলোচনা করার পাশাপাশি উপমা হিসেবে উম্মাহাতুল মুমিনীনের জীবনাদর্শকে তুলে ধরাই যথেষ্ট। অথচ সেদিকে না গিয়ে বক্তা নারীর চলন-বলন নকল করে দেখাতেই ব্যস্ত হয়ে যান। আবার কেউ কেউ, ‘ঈমান’ বিষয়ক আলোচনা শুধু তাত্ত্বিক কথাবার্তা বলে শেষ করে দেন। অথচ কিছু তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি সাহাবীদের ঈমানদীপ্ত জীবন থেকে দুতিনটি উদাহরণ দিলে মানুষ সহজেই ঈমানের হাকীকত বুঝে নিতে পারে।
(৩) গৎবাঁধা কটি বিষয় নিয়েই যুগের পর যুগ আলোচনা চালিয়ে না যাওয়া। এমন বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা আমাদের পূর্বসূরীরা দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে সমাধান করে গেছেন। যদি ওসব বিষয়ে সম্পূরক বা অধিক শক্তিশালী আর কোনো দলীল পাওয়া যায়, তাহলে সেগুলো উপস্থাপন করা যেতে পারে। যেসব বিতর্কিত বিষয় ইতোমধ্যে সমাধান হয়ে গেছে এবং সমাজে এর প্রভাবও নেই। সেগুলোর আলোচনা কম করাই ভালো। বিতর্কিত বিষয়কে পুনরায় সামনে এনে নতুন করে মতানৈক্য তৈরি করার প্রয়োজন নেই। বরং যুগের আলোকে নতুন এবং প্রয়োজনীয় বিষয়কে ওয়াযের মধ্যে শামিল করা যেতে পারে।
চতুর্থত, ওয়ায মাহফিলে বক্তা যখন বক্তৃতা দেবেন, তখন তাঁর নিজের পান্ডিত্য নয়, বরং শ্রোতার প্রয়োজন, পর্যায় ও পারিপার্শ্বিকতাকে নযরে রেখে কথা বলা উচিত। ইমাম সারাখ্সী (র.) বলেছেন, “যদি ইমাম মুহাম্মাদ ইবন হাসান শাইবানী (র.) ছাত্রদের সামনে তাঁর নিজের মেধা অনুযায়ী কথা বলতেন, তাহলে আমরা কিছুই বুঝতে পারতাম না।” অতএব যা বলবেন, সহজ ও স্বাভাবিকভাবে বলবেন। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। আমরা আগেই বলেছি, আল্লাহ তাআলা কুরআনকে আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠতম ওয়ায হিসেবে নাযিল করেছেন, যা সব ধরণের বক্রতা ও অসঙ্গতি থেকে মুক্ত। আল্লাহ বলেছেন, -সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং তাতে কোনো বক্রতা রাখেননি। (সূরা কাহাফ, আয়াত-১) সায়্যিদুনা আলী (রা.) বলেছেন, “মানুষকে সেভাবেই বলো, যেভাবে শুনতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তোমরা কি চাও যে, (তোমাদের কথার দ্বারা) তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করবে?” (সহীহ বুখারী, হাদীস-১২৭)
অতএব ওয়াইযদের প্রতি সবিনয় পরামর্শ হচ্ছে, ওয়ায-নসীহতের মূল ভিত্তি বানাতে হবে কুরআন ও সুন্নাহকে। সেই সাথে ইসলামের বাস্তবিক নমুনা হিসেবে সমপরিমাণ গুরুত্বের সাথে আসবে রাসূলুল্লাহ ব ও সাহাবায়ে কিরামের জীবন। এরপর সালফে সালিহীন, উলামা, আউলিয়া ও মুজাহিদদের জীবনাদর্শ আসবে। তবে সকল আলোচনাই তথ্যভিত্তিক ও সনদ যাচাইপূর্বক হওয়া বাঞ্চনীয়।
আকীদার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সরল, সঠিক ও সুদৃঢ় আকীদার ওপর স্থির থাকা অত্যাবশ্যক। স্বপ্রণোদিত ধারণাকে কখনও আকীদার মধ্যে শামিল করা উচিৎ নয়। ওয়াযের মাঠে আকীদার আলোচনাকে ঈমানের মৌলিক বিষয়াদি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখাই যথেষ্ট। ইদানিং কিছু বক্তাকে আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত দুর্বোধ্য এবং অতি সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে জনসাধারণের সামনে আলোচনা করতে শোনা যায়। এটি উপকারী তো নয়ই, উলটো এতে মানুষের ঈমানহারা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের বুঝা উচিৎ যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চতর ইলমী দারস, খানেকার রূহানী তারবিয়াত এবং ওয়ায মাহফিলের বক্তৃতা এ তিনটির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। কিছু জটিল ইলমী বিষয় আছে, যা সুবিজ্ঞ আলিম-উলামার সামনে বলা সাজে। কিছু সুক্ষ আধ্যাত্মিক বিষয় আছে, যা আহলে তাসাওউফের সামনে বলা সাজে। এসব কথা সাধারণ ওয়ায মাহফিলে বললে ভয়াবহ ফিতনা সৃষ্টি হবে। তাই শ্রোতাদেরও উচিৎ নয় মাঠে-ময়দানে এমন অপ্রয়োজনীয় জটিল বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা, যা আদৌ কারও প্রয়োজন নেই। ইমাম আহমাদ (র.) বলতেন, “এমন কিছু জিজ্ঞেস করো না, যার জবাব তুমি বুঝতে পারবে না।” আবার বক্তারও উচিৎ নয় সহজ বিষয়কে পেঁচিয়ে নিজের ইলমের গভীরতা প্রকাশ করা। ইমাম ইবন আকীল (র.) বলেছেন, “এটি মোটেও কাম্য নয় যে, একজন উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন আলিম সাধারণ মানুষের সামনে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলবেন।”
ফিকহী মাসআলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার বশবর্তী না হয়ে মুজতাহিদ ইমামদের অনুসরণ করাই নিরাপদ। হাদীস বর্ণনার সময় নির্ভরযোগ্য হাদীসের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। তাফসীর, ইতিহাস এবং কারও ব্যক্তিগত রচনা থেকে তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন ও তুলনামূলক যাচাই বাছাই করা জরুরি। সর্বোপরি ইসলামকে কোনো ‘অতিপ্রাকৃতিক’ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন না করে মানুষের বাস্তব জীবনে আমলযোগ্য সুসংহত দ্বীন তথা জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করা চাই। এতে আমাদের শ্রম সার্থক হবে, ওয়াযের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে এবং সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, অধ্যয়ণরত- (মাস্টার্স) রিলিজিয়াস স্টাডিজের অধীনস্থ ইসলামিক স্টাডিজ, এয়ারফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানী