হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
বাসা থেকে অফিসে আসার ক্ষেত্রে সাধারণত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে আসি। এ পথে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দৃশ্য চোখে পড়ে। যখন কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো সংগঠনের জনসভা থাকে তার শুরুটা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়। আগ্রহ নিয়েই সমাবেশের দৃশ্য দেখি। কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশের সময় দুপুরে থাকলে সকাল থেকেই তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের ব্যানার নিয়ে মিছিল করে শ্লোগান দিয়ে সমাবেশ স্থলে যেতে দেখি। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুরো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রবেশ দ্বারে অসংখ্য পুলিশ নিয়োজিত থাকে। কোনো কোনো প্রবেশ দ্বার বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে যেমন প্রচন্ড যানজটের সৃষ্টি হয়, তেমনি সাধারণ মানুষকেও চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাদের বিরক্তির শেষ থাকে না। তবে গত শনিবার একটি ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা গেল। ঐ দিন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষকদের একমাত্র সর্ববৃহৎ সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসম্মেলন ছিল। সকালে নীলক্ষেত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে প্রবেশ করার পর দেখা গেল অসংখ্য বাস রাস্তার পাশে লাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। ক্যাম্পাসের সব রাস্তার পাশেই এ দৃশ্য দেখা যায়। উদ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায় সফেদ টুপি ও পোশাক পরিহিত অসংখ্য মানুষ সমাবেশস্থলমুখী হয়েছে। তাদের মুখে রাজনৈতিক শ্লোগান নেই। কেবল জিকিরের গুনগুন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এ দৃশ্য অবলোকন করি। সফেদ মানুষের কাফেলা দেখে দেহ-মনে এক অপার্থিব শিহরণ জাগে। মন হালকা হয়ে যায়। সুখ অনুভূত হয়। জিকির করতে করতেই তারা উদ্যানে প্রবেশ করে। সাধারণত রাজনৈতিক সমাবেশ স্থলে প্রবেশের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ তৎপরতা দেখা যায়। প্রবেশ পথে মেটাল ডিটেক্টরসহ আর্চওয়ে বসানো থাকে। নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি দেখে এক ধরনের অস্বস্তি বোধ হয়। অথচ ঐদিন চিরচেনা এ ধরনের কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি। কিংবা পানিকামানসহ পুলিশের সাজোয়া যান দেখা যায়নি। যেন এক ঐশ্বরিক নিরাপত্তায় পুরো উদ্যান বেষ্টিত হয়ে আছে। দূর থেকে মাঠের যে দৃশ্য দেখা যায়, তা কেবল সমুদ্রের সফেদ উর্মিমালার সাথে তুলনীয়। সমাবেশটি সারা দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের মহাসম্মেলন হলেও অসংখ্য সাধারণ মানুষকেও এতে শরিক হতে দেখা যায়। যেন মনের টানে একটু শান্তির পরশ পাওয়ার জন্য তারা এখানে ছুটে এসেছে। মাদরাসা শিক্ষক, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখের একসঙ্গে মিলিত হওয়ার এ ধরনের শান্তির মহাসম্মেলন দেখার সৌভাগ্য সচরাচর তাদের হয় না। ঐ দিন যেন তারা একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ছুটে এসেছিল।
দুই.
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের এই মহাসমাবেশটি ছিল মাদরাসা শিক্ষকদের চার দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। দাবিগুলো হচ্ছে ১. দেশের সকল মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ। ২. শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির বয়স ৬৫ বছর করা। ৩. শিক্ষার্থী সংকট দূর করার জন্য সংযুক্ত ও স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদরাসাগুলোকে প্রাইমারী স্কুলের মতো জাতীয়করণের আওতাভুক্ত করা, উপবৃত্তি, দুপুরে টিফিন এবং এবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেয়া। ৪. শিক্ষার সংকট দূর করতে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন পেশকৃত জনবল কাঠামো অনুমোদন, মাদরাসায় সহকারী মৌলভীদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ দাবীগুলো সময়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত যৌক্তিক এবং তা বাস্তবায়ন জরুরী। এর কারণ, আমাদের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদী এবং যারা সুযোগ পেলেই মাদরাসা শিক্ষাকে অবমূল্যায়ন ও তিরস্কার করেন, মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সাথে তাল মেলাতে নসিহত করেন- জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের উল্লেখিত দাবীগুলো তার চেয়েও যুগোপোযুগী এবং আধুনিক। আমরা জানি, আমাদের মাদরাসা শিক্ষা আদিকাল থেকেই সরকারী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। কেবল দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং ইসলামী মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার কারণে মাদরাসা শিক্ষা এগিয়ে চলেছে। তবে এখন সময় পাল্টেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তিতে পৃথিবী অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকার আধুনিক শিক্ষা এবং শিক্ষকদের সুবিধাদি কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে। এ তুলনায় মাদরাসা শিক্ষা এবং শিক্ষকরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অথচ এই মাদরাসা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরাই আমাদের দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা বজায় রেখে এবং অবক্ষয় ঠেকিয়ে সমাজ গঠনে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বলা যায়, সমাজে এখনও যে মূল্যবোধ রয়েছে, তা এই মাদরাসা শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম, পীর-মাশায়েখ এবং আলেম-ওলামাদের যুথবদ্ধ অবস্থান ও তাদের নসিহতের কারণে। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে তারাই মূল চালিকাশক্তি হয়ে রয়েছেন। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে বলেই নানা অনাচারের মধ্যেও সামাজিক বন্ধন এবং মূল্যবোধ এখনও অটুট রয়েছে। সমাজে এবং দেশে মাদক যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে ও যে হারে মাদকসেবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, মাদরাসা সংশ্লিষ্ট কাউকেই মাদকের সাথে সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যাবে না। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীন মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা উল্লেখ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে মাদরাসা সংশ্লিষ্ট কেউ জড়িত নন। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে প্রকাশিত একটি তালিকা উল্লেখ করে তিনি দেখিয়েছেন, সারা দেশে অন্তত তিন হাজার মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র নেতৃবৃন্দ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, পুলিশের কর্মকর্তা রয়েছেন। অর্থাৎ দেশের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রের মানুষই যদি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েন, তবে সে দেশের তথাকথিত আধুনিকতা দেশের জন্য যে অত্যন্ত ভয়ংকর হয়ে উঠছে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। এতসব অনাচারের মধ্যে আমাদের সমাজ যে এখনো পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েনি, তার কারণ ইসলাম ও এর যথাযথ প্রতিনিধিত্বকারী মাদরাসা শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম, আলেম-ওলামা ও পীর মাশায়েখের দৃঢ় অবস্থান। আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষই ধর্মপ্রাণ। ইসলামের বিরুদ্ধে এবং এর চর্চাকারীদের হেয় প্রতিপন্ন করে হাতেগোনা তথাকথিত প্রগতিশীলরা যত কুৎসা ও বদনাম করুক না কেন, সাধারণ মানুষ তা কখনোই আমলে নেয় না। ইসলামের বদনাম করার জন্য এই শ্রেণীটি মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের ধোঁয়া তুলে মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য হেন কোনো প্রচেষ্টা নেই যা করছে না। তাতেও আমাদের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছে না। তারা জানে, এসব তথাকথিত প্রগতিবাদীরা দেশি-বিদেশি ইসলাম বিদ্বেষীদের উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আশার কথা, সরকারও এসব প্রগতিবাদীদের কথায় কান দেয়নি। বরং আমাদের দেশের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, মানুষের ধর্মবোধকে মূল্যায়ন করে ধর্ম চর্চার মূল সূতিকাগার মাদরাসা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এর আধুনিকায়ন এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে ইসলামী-আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। বলা বাহুল্য, এই যে মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপোযুগী এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, এর মূল কান্ডারি হয়ে আছে মাদরাসা শিক্ষকদের সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন। সংগঠনটির সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীনের সুযোগ্য নেতৃত্ব এবং ইসলামকে নিয়ে তাঁর আধুনিক চিন্তা-চেতনা এবং গবেষণার কারণেই মাদরাসা শিক্ষা আধুনিকীকরণের পথে ধাবিত হয়েছে। যে ইসলামী-আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা তাঁর একক চিন্তা এবং প্রচেষ্টার কারণেই সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এবং এটা আশা করা যায়, মাদরাসা শিক্ষা ও শিক্ষকদের দাবী নিয়ে যে মহাসম্মেলন হয়েছে ও তা পেশ করা হয়েছে, সরকার এসব দাবী পূরণ করবে। এ দাবী উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
তিন.
সারাবিশ্বে এখন যে ধর্মটি সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী তা হচ্ছে ইসলাম। এ তথ্য এখন উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সংস্থার জরিপে উঠে আসছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সমীক্ষা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৭০ সাল থেকে পুরো বিশ্ব দখলে নেবে মুসলমানরা। বর্তমানে খ্রিস্টধর্ম বিশ্বের বৃহত্তম ধর্ম হলেও ২০৭০ সালের মধ্যে ইসলামই হবে বৃহত্তম ধর্ম। আগামী ৫০ বছর পর বিশ্বে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর চেয়ে অনেক বেশি হবে। এ সময়ে মুসলমানের সংখ্যা বাড়বে ৭০ শতাংশ, যা ২৮০ কোটিতে পৌঁছবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে বিশ্বে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছিল ২২০ কোটি। মুসলমানদে সংখ্যা ছিল ১৬০ কোটি। ইসলামের দ্রুত প্রসারের কারণে ২০৫০ সালে খ্রিস্টান ও মুসলমানের সংখ্যা হবে সমান সমান। এরপর ২০৭০ সালে খ্রিস্টানদের ছাড়িয়ে যাবে মুসলমানরা। প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী বছরগুলোতে ইউরোপসহ বিশ্বের বহু অঞ্চলে ইসলামের অনুসারী দ্রুত বাড়তে থাকবে। গত বছর চীনের বেইজিংয়ের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গাবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত ‘চীনা ধর্ম জরিপ’-এ বলা হয়, চীনে ৩০ বছরের নিচে তরুণদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্ম ইসলাম। চীনের সর্বশেষ আদম শুমারি অনুযায়ী, চীনে উইঘুর মুসলমানের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। তবে উইঘুর আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে এ সংখ্যা দেড় কোটি। পিউ রিসার্চ বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনে মুসলমান জনগোষ্ঠী হবে ৩ কোটি। অন্যদিকে সম্প্রতি এক জরিপে বলা হয়েছে, ফ্রান্সে ‘মুহম্মদ’ নামটি সে দেশের জনসাধারণের পছন্দের এক নম্বরে রয়েছে। জার্মানিতে পছন্দের তালিকার ৪৭ নম্বর থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে ২৬-এ এসেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ২০৫০ সালে মুসলমানের সংখ্যা হবে ১০০ কোটি। এখানে এই পরিসংখ্যান তুলে ধরার কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশের তথাকথিত প্রগতিশীল যারা কথায় কথায় ইসলামের বদনাম করেন এবং মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের অপবাদ দেন, তাদের স্মরণ করে দেয়ার জন্য। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের অগ্রগামীতা তাদের ভালো না লাগলেও, এই বাস্তবতা অস্বীকারের উপায় নেই। আর যেখানে আমাদের দেশে শতকরা ৯২ জনই মুসলমান, সে দেশে বসে ইসলাম এবং এর শিক্ষার পীঠস্থান মাদরাসার বিরুদ্ধে কথা বলার অর্থ, দেয়ালে মাথা ঠোকা ছাড়া কিছুই নয়। দেশের মানুষও তাদের অসৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ সম্পর্কে ভাল করেই জানে। তারা এটাও জানে, মাদক ব্যবসা, মাদকাসক্তি ও জঙ্গিবাদে মাদরাসার কোনো শিক্ষক বা শিক্ষার্থী জড়িত নয়। বরং ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মাদক ও জঙ্গীবাদে জড়াতে দেখা গেছে। এই চিত্র আড়াল করেই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা সভা-সেমিনার করে এবং বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তবে গত শনিবার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন মাদরাসা শিক্ষকদের নিয়ে যে মহাসম্মেলন হয়েছে এবং সেখানে শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিগণ উপস্থিত থেকে মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপোযুগী ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির যে কথা বলেছেন, এটাই আমাদের দেশের বাস্তবতা। এ বাস্তবতা অস্বীকার করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আমরা যদি বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল দেখি, তবে দেখা যাবে অত্যন্ত সীমিত সুযোগের মধ্যে থেকেও মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সব চেয়ে বেশি ভাল ফলাফল করছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে ভর্তি হচ্ছে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শতকরা ৬০ ভাগ মাদরাসা শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারছে। এসব মাদরাসা শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা যদি অন্যান্য মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মতো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেত, তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তারাই থাকত শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রসর প্রজন্ম। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন এবং নীতি-নৈতিকতা, একনিষ্ঠতা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে শিক্ষা লাভের কারণে তারাই হয়ে উঠত দেশের অন্যতম উজ্জ্বল জনগোষ্ঠী। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা প্রনিধাণযোগ্য। তিনি বলেছেন, এখন লাখে লাখে আলেম তৈরি হচ্ছে। তাদের সকল ক্ষেত্রে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। যদি তারা ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা লাভ না করে তাহলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অফিসার হতে পারবে না। একজন ভালো আলেম যদি ভাল অফিসার হয় তাহলে তিনি দুর্নীতি করবেন না। শিক্ষামন্ত্রীর এ কথা বাস্তবতার নিরিখে অকাট্য। তবে এ কথার সাথে বলতে হয়, সরকারের উচিত মাদরাসা শিক্ষাকে অন্যান্য শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার দিয়ে এর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। এ কাজটি না করে কেবল বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার মাদরাসা শিক্ষা ক্ষেত্রে যেটুকু সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, তা মোটেও যথেষ্ট নয়। মাদরাসা শিক্ষাকে অন্যান্য শিক্ষার মতো গুরুত্ব দিতে হবে। কাজটি যত দ্রæত করা হবে, ততই মাদরাসা শিক্ষা তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে আধুনিক শিক্ষার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারবে। এর ফলে একটি নম্র, ভদ্র, সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষিত প্রজন্ম যেমন গড়ে উঠবে, তেমনি ধর্মীয় মূল্যবোধ, অনুশাসন, নীতি-নৈতিকতা সমৃদ্ধ সমাজ গঠনেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
চার.
বাংলাদেশ একটি মডারেট মুসলিম দেশ। এখানের মুসলমানরা ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বসবাস করে। উগ্রতা কখনোই পছন্দ করে না। অন্যান্য যেসব ধর্মাবলম্বী রয়েছে, তাদের সাথে সম্প্রীতির বন্ধনে তারা আবদ্ধ। আসলে ঢাকায় বসে বাংলাদেশের মুসলমানদের চিরায়ত এই বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা কঠিন। বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রকৃত চিত্র দেখতে হলে ঢাকা থেকে বের হতে হবে। বিশেষ করে জুম্মাবারে যদি কেউ ঢাকা থেকে বের হয়ে চলতে থাকে, তবে দেখতে পাবে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় চেতনা এবং আত্মশুদ্ধির অভিপ্রায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই যে ধর্মীয় চেতনা ও আত্ম উপলব্ধি-এর উপরই দাঁড়িয়ে আছে সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা এবং একতা। এর পেছনের মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে, মাদরাসা শিক্ষক, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ। তাদের কথা শোনার জন্য সাধারণ মানুষ সবসময়ই উদগ্রীব হয়ে থাকে। ফলে যখন কোনো ওরশ, মাহফিল বা জলসা হয়, তখন দেখা যায় অসংখ্য মানুষ সারারাত জেগে তাদের কথা শোনে। বাংলাদেশের আর কোনো সমাবেশ অসংখ্য মানুষকে এতটা মন্ত্র-মুগ্ধের মতো আবিষ্ট করে রাখতে দেখা যায় না। এসব ইসলামভিত্তিক অনুষ্ঠানে কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক যেসব বয়ান হয়, মানুষ তা শুনে আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজে নেয়। বাংলাদেশে যে হাজার হাজার মাদরাসা রয়েছে এবং সেখানে থেকে যারা আলেম হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন, মূলত তারাই সামাজিক মূল্যবোধ অটুট রাখার ক্ষেত্রে ‘রাডার’ হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন তাদেরই প্ল্যাটফর্ম এবং তাদের নিয়েই কাজ করে চলেছে। আলেম তৈরির কারিগরদের সংগঠিত করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করছে। সংগঠনটির সাথে প্রায় দেড় কোটি মানুষ সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে আছে এবং তাদের ব্যাপক প্রভাব সমাজে রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে উপেক্ষা করা রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই মাদরাসা শিক্ষা, এর শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের সরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার বিকল্প নেই। ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন, মাদরাসা শিক্ষা এবং শিক্ষকদের গুরুত্ব দিতে হবে। আধুনিক শিক্ষার সাথে তাল মেলাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটা বুঝতে হবে, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসম্মেলনে যে দুই লাখ মাদরাসা শিক্ষক, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও সাধারণ মানুষের সমাবেশ হয়েছে, এটাই বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র। তারাই বাংলাদেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট ধারণ করেন। কাজেই তাদের উপেক্ষিত রেখে দেশ এগিয়ে নেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আমরা আশা করব, মহাসম্মেলনে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন যে দাবীগুলো উত্থাপন করেছে, তা দ্রæত বাস্তবায়নে সরকার উদ্যোগী হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।