Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিএনপির নেতা-কর্মীদের খালেদা জিয়ার আপসহীন রাজনীতিকে ধারণ করতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বর্তমান রাজনীতিতে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার পরিবর্তে রাজনৈতিক দল ও তার নেতা-কর্মীদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। ক্ষমতায় থাকা, ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় গিয়ে নিজেরা লাভবান হওয়ার প্রবণতা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অতিমাত্রায় বিদ্যমান। জনগণকে তারা কী দিতে পারল, কী দিতে পারল নাÑএ বিষয়টি গৌণ হয়ে গেছে। রাজনীতি এবং রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের মূল লক্ষ্যই যেন হয়ে উঠেছে আত্মউন্নয়ন। জনগণের উন্নয়ন নিয়ে তারা খুব একটা ভাবেন বলে মনে হয় না। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল জনগণের মুক্তি, কল্যাণ এবং তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে। আমরা দেখেছি, ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করার পর যখন ক্ষমতা হস্তান্তরে অবিভক্ত পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার টালবাহানা করছিল তখন তিনি জনসভা করে সরকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমি বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি চাই।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে সেনাকর্মকর্তা থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জিয়াউর রহমানও জনসম্পৃক্ত রাজনীতি করে জনগণকে খুশি করার জন্য নিরলস কাজ করে গিয়েছিলেন। দল বা ব্যক্তি উন্নয়নকে প্রাধান্য দেননি। জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর, জনকল্যাণের এ ধারার রাজনীতির ব্যত্যয় ঘটিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতার লোভে এবং জনগণকে শাসন করার মানসে তিনি একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। কায়েম করেছিলেন জোরজবরদস্তি ও নিষ্পেষণের রাজনীতি। সেই থেকে মূলত ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়া এবং রাজনৈতিক দলের নিজেদের চাওয়া ও পাওয়ার রাজনীতির প্রারম্ভিক সূচনা। তার ধারাবাহিকতা আজও রয়ে গেছে। গত ১ জানুয়ারি এরশাদ অনেকটা ক্ষোভ নিয়েই বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তিনবার আমাদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় এসেছে, বিনিময়ে কিছুই পাইনি।’ তার এ কথা থেকে স্পষ্ট হয়, তিনি রাজনীতি করছেন তার নিজের এবং দলের নেতা-কর্মীদের স্বার্থের জন্য, জনগণের জন্য নয়। তা নাহলে বলতেন, আওয়ামী লীগ আমাদের সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের জন্য কিছু করেনি, জনগণ কিছুই পায়নি। তিনি এ কথা বলেননি। এই যে রাজনৈতিক দলের গণরাজনীতির পরিবর্তে আত্ম সুবিধা কেন্দ্রিক চাওয়া-পাওয়ার রাজনীতি, এর জন্যই বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশার লাঘব হচ্ছে না। এরশাদ ক্ষোভের বশে এ কথা বললেও, বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের বর্তমান রাজনীতি তার না পাওয়ার আফসোসের মতোই ঘুরপাক খাচ্ছে, যেখানে জনগণের নামে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের রাজনীতি লুকিয়ে রয়েছে। এখন ক্ষমতায় যাওয়া মানেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের উন্নয়ন, ক্ষমতা ভোগ এবং এর ব্যবহারের মাধ্যমে সুখ-স্বাচ্ছন্দে থাকা। বিরোধী দলে যারা থাকে, তাদের দুঃখের অন্ত থাকে না। নিজেদের দুঃখেই দুঃখিত হয়। উভয় ক্ষেত্রেই জনগণের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি উহ্য থেকে যায়। রাজনৈতিক দলের চাওয়া-পাওয়া এবং ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার রাজনৈতিক এই অপসংস্কৃতি কবে শেষ হয়ে শুধু জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণের রাজনীতি চালু হবে, তা কেউই বলতে পারে না।
দুই.
এরশাদের শাসনামলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি যদি নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করা হয়, তবে দেখা যাবে, তখন চাওয়া-পাওয়ার রাজনীতি এতটা প্রবল ছিল না। ছিল সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলের একাট্টা হয়ে স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্য। কে ক্ষমতায় যাবে, কে যাবে না, বিষয়টি মুখ্য ছিল না। যদিও সে সময়ের অন্যতম বিরোধী দল আওয়ামী লীগ আন্দোলন-সংগ্রামের ছন্দপতন ঘটিয়ে হুট করেই এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসেছিল এবং এরশাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করেছিল। অথচ নির্বাচনের আগে দলটি বলেছিল, এরশাদের অধীনে যারা নির্বাচনে যাবে তারা জাতীয় বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত হবে। বলা যায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এরশাদ বিরোধী সব দলের লক্ষ্যের বিপরীতে গিয়ে এবং জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য নিজ স্বার্থকে বড় করে দেখেছিল। এর মধ্য দিয়ে দলটির ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার অভিলাষের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। অন্যদিকে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো মাঠেই লড়তে থাকে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া প্রায় প্রতিদিন দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ঢাকার রাজপথে হেঁটেছেন। ক্ষমতায় যাবেন কি যাবেন না, এ চিন্তা করেননি। একটাই লক্ষ্য ছিল, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে তার শাসন থেকে জনগণকে মুক্ত করা। স্বৈরাচারের হুমকি-ধমকি, টিয়ার শেল-গুলি এবং কোনো ধরনের লোভ-লালসার কাছে তিনি মাথা নত করেননি। এ কারণে তিনি আপসহীন নেত্রীর খেতাব লাভ করেছিলেন। এরশাদের পতনের পর সবদলের সম্মতিতে গঠিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে যখন নির্বাচন ঘোষণা হয়, তখন দলটির নেতা-কর্মীরা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল নির্বাচনে জনগণ হয়তো তাদের বিরোধী দলে বসাবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এক প্রকার নিশ্চিত ছিল, তারাই ক্ষমতায় যাচ্ছে। তার এ ধারণা অমূলক ছিল না। কারণ, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন দলÑযার সংগঠনের বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যন্ত, সেই দল ক্ষমতায় যাবে, এটাই স্বাভাবিক। অন্যান্য বিরোধী দলও তাই মনে করেছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত জেনে সে সময় দলটি একটি ছায়া মন্ত্রীসভাও গঠন করে ফেলে। কে কোন মন্ত্রণালয় পাবে, এমন একটা হিসাবও চলতে থাকে। অন্যদিকে তৃণমূল দূরে থাক, অনেক জেলায় বিএনপির কমিটিও ছিল না। কাজেই এ দলের ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। দলের নেতা-কর্মীরা এ বাস্তবতা স্বীকার করেই বিরোধী দলে বসার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিল। দেখা গেল, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর বিএনপি এক অকল্পনীয় বিজয় লাভ করে। দলটি ক্ষমতায় চলে যায়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হয়ে যায়। দলটির পক্ষে এই অপ্রত্যাশিত পরাজয় মানা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিএনপিকে একদিনের জন্যও স্বস্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। সে যাই হোক, দুর্বল সাংগঠনিক ভিত্তি নিয়ে বিএনপি যে ক্ষমতায় গেল, এর কারণ কি ছিল? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, তখন বিএনপি নামে দল হলেও, তার মূল শক্তি ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। দুর্বল সাংগঠনিক ভিত্তিকে উড়িয়ে দিয়ে নিজেই দলে পরিণত হয়েছিলেন। যাকে বলে জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির ‘নিউক্লিয়াস’। মূল যে বিষয়টি কাজ করেছিল তা হলো, তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতির চিন্তা না করে কেবল জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে অটল ছিলেন। তার এই আপসহীন এবং পরিশ্রমী ও নির্লোভ রাজনীতি জনগণের কাছে এতটাই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে যে, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার কথা চিন্তা না করলেও জনগণ তাদের ন্যায্য বিচার দিয়ে দলটিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। জনগণ দেখেছে, বেগম খালেদা জিয়া দুর্বল সাংগঠনিক ভিত্তি নিয়েও এককভাবে তাদের পক্ষে লড়াই করে গিয়েছেন। কাজেই, তার যথার্থ পুরস্কার হচ্ছে জনগণের শাসন ভার তার হাতে তুলে দেয়া। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চিত বিষয়টি কেন ভেস্তে গেলÑএ প্রশ্নও উঠে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এরশাদের সাথে হাত মিলিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টি জনগণ মোটেও পছন্দ করেনি। জনগণ মনে করেছে, আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে না গেলে এরশাদের পতন দ্রæত হতো এবং নির্বাচনে তারাই বিজয়ী হতো। সে সময় আওয়ামী লীগ দেশের জনগণের সেন্টিমেন্ট ও স্বার্থের বিষয়টি আমলে না নিয়ে নিজেদের ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিল বলেই নিশ্চিত বিজয় হাতছাড়া হয়ে যায়। অথচ আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই ছিল জনগণ সমর্থিত একটি দল। দলটি যখন জনগণের সেন্টিমেন্টের বাইরে গিয়ে উল্টো তাদের ব্যবহার করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করে, তখনই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। রাজনীতির এ ঘটনা থেকে এটাই পরিস্কার হয়, বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক দলের ভুল-ত্রæটি খুব ভাল করে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে। তারা কোনো কিছুই ভুলে যায় না। স্বাধীনভাবে মতের প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ পেলে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে ভুল করে না।
তিন.
বিএনপিকে যতই সেনা ছাউনিতে জন্ম নেয়া দল বা জনবিচ্ছিন্ন দল বলে আওয়ামী লীগ অপবাদ দিক না কেন, দেশের একটি বিরাট অংশের জনগণ কিন্তু তা মনে করে না। মনে করে না বলেই দলটি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে এবং ক্ষমতার বাইরে থাকলেও ক্ষমতায় যাওয়ার শক্তি রাখে। এর কারণ, সেনাবাহিনীর একজন লোক হয়েও জিয়াউর রহমান জনগণের রাজনীতি করে দলটির ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর গড়া ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এবং তাঁর লিগ্যাসি বহন করে বেগম খালেদা জিয়া নিজস্ব কারিশমায় জনগণের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন এবং এখনও তা ধরে রেখেছেন। সরকার যতই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ও অপবাদ উত্থাপন করুক না কেন, সাধারণ মানুষের কাছে তা সরকারের চিরায়ত রাজনৈতিক বিদ্বেষী আচরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে এমন বিদ্বেষমূলক অপবাদ ও মামলা হওয়া নতুন কিছু নয়। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোকে রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত মামলা হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পরিগণিত হওয়া স্বাভাবিক। তাছাড়া এ সরকারের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাট এবং বিদেশে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচারসহ আরও অনেক বড় বড় যেসব দুর্নীতি হয়েছে এবং এর সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার বিষয়গুলোও সাধারণ মানুষের অজানা নয়। কাজেই এসব দুর্নীতির বিষয় আমলে নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি জনগণের সহানুভূতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। বলা বাহুল্য, বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি যে বিশাল সংখ্যক সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে তা সরকারও জানে। জানে বলেই বিএনপি সংসদে না থাকা সত্তে¡ও বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়া সরকারের মূল রাজনৈতিক আক্রমণের নিশানায় পরিণত হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে দেশের অন্য কোনো বিরোধী দলের বক্তব্যের কোনো জবাব দেয়া হয় না। কেবল বিএনপির নেতা ও বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যেরই জবাব দেয়া হয়। এ থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বুঝতে হবে, তাদের দলের গণভিত্তি রয়েছে। তাদের এ ভিত্তিকে ধারণ করতে হবে। এরশাদের শাসনামলে খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বের কথা মনে রাখতে হবে। একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন, শাসন কাজ চালানোর সময় ভুল-ত্রæটি হবেই। কোনো সরকারই ভুলের উর্ধ্বে নয়। তবে ত্রæটিপূর্ণ বা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতার নির্বাচন, যেখানে জনগণের ভোট দেয়ার অধিকার থাকে না, এমন সরকার ক্ষমতায় গেলে তার নৈতিক মনোবল দুর্বল থাকে। সে তখন প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগকে মূল অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়। গায়ের জোরে দেশ শাসন করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের নেতা-কর্মীদের ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতন, গুম, খুন, অপহরণ, হামলা-মামলা নেমে আসে, তা এই ত্রæটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হওয়ার কারণেই হয়েছে। সে সময় বিএনপি যে আন্দোলন করে, তাতে যদি সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হতো, তবে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না। তবে সব অপশাসনেরই একসময় অবসান ঘটে। এরশাদও ক্ষমতায় থাকতে কম চেষ্টা করেনি। বিরোধী দলের মিছিল-মিটিংয়ে গুলি চালানো হয়েছিল। ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছে। এত দমন-পীড়নের পরও শেষ পর্যন্ত এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। এর কারণ, তখন বিরোধী দলগুলো টিয়ারশেল, গুলি, হামলাÑসবকিছু উপেক্ষা করে জনগণের জন্য আন্দোলন চালিয়েছিল। সে সময় খালেদা জিয়া ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির এ প্রজন্মের নেতা-কর্মীদের এ কথা উপলব্ধি করতে হবে, তখন দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে যদি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সফল হওয়া যায়, তবে এখন শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তি নিয়ে কেন পারা যাবে না! আন্দোলনে সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন থাকবে, এটা অবধারিত। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন তারাও নির্যাতিত হয়েছিল। সরকারি দলের নির্যাতনের মুখেও তারা মাঠ ছাড়েনি। দলটির অনেক শীর্ষ নেতাকে রাস্তায় পড়ে পুলিশের মার খেতে হয়েছে। তারা মাটি কামড়ে পড়েছিল। অর্থাৎ রাস্তায় যদি শীর্ষ নেতারা নামেন এবং অত্যাচারের শিকার হন, তখন যত বড় স্বৈরাচার হোক না কেন, তার বুক কেঁপে ওঠে। পুলিশ দিয়ে দমন করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তা পারে না। বিএনপির সমস্যা হচ্ছে খালেদা জিয়া ছাড়া শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতার মধ্যে এ দৃঢ়তা দেখা যায় না। গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা রয়েছে। তবে সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়া পুনরায় মাঠে তার নেতৃত্বের যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তা দলের নেতা-কর্মীদের জন্য অনুসরণীয়। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি যখন আদালত থেকে বাসায় ফিরছিলেন, তখন হাইকোর্টের সামনে পুলিশ বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে আটক করেছিল। খালেদা জিয়া গাড়ি থামিয়ে সেখানেই অবস্থান নেন এবং বলেন, ছেলেদের না ছাড়লে তিনি এখান থেকে এক পা-ও নড়বেন না। তার এই দৃঢ় অবস্থানের কারণে পুলিশ নেতা-কর্মীদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। গত ১ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্তৃপক্ষ সমাবেশের অনুমতি দিয়েও মূল হলে তালা মেরে দেয়। ফলে ছাত্রদল বাইরে অবস্থান গ্রহণ করে। খালেদা জিয়াও উপস্থিত হয়ে সেখানে অবস্থান নেন। তিনি প্রায় ঘন্টা খানেক গাড়িতে বসে থাকেন। তার এই দৃঢ় অবস্থানের কারণে কর্তৃপক্ষ হল খুলে দিতে বাধ্য হয়। । এই দুইটি ঘটনা থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত হওয়ার উপাদান রয়েছে। মার খেতে খেতে যদি কেউ সাহস সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়ায়, তবে মহাশক্তিও থমকে যায়। বেগম খালেদা জিয়া ছোট্ট দুটি ঘটনা দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখন এ ঘটনা থকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা খুঁজে নিতে হবে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দকেও তা উপলব্ধি করতে হবে। খালেদা জিয়া যদি এই বয়সেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, তবে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না? লন্ডন থেকে ফেরার পর বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য এবং সভা-সমাবেশ দেখে প্রতীয়মান হচ্ছে, তিনি সাধারণ নেতা-কর্মীদের নিয়ে একাই মাঠে নেমেছেন। অন্য নেতাদের দিকে তাকাচ্ছেন না। এর কারণ, অতীতে আন্দোলনের সময় যখন তাকে বালুর ট্রাক দিয়ে গুলশানের অফিসে আটকে রাখা হয়, তখন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাউকেই মাঠে নামতে দেখা যায়নি। এতে সরকার আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং ভয়-ভীতি ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। নেতারা যদি তখন বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধারের আন্দোলনে নামতেন, তবে হয়তো আন্দোলনের চিত্র বদলে যেত। সম্ভবত খালেদা জিয়া তার দলের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার এই সুবিধাবাদী চরিত্র বুঝতে পেরেছেন। ফলে তিনি নিজেই ধীরে ধীরে মাঠে নামতে শুরু করেছেন। সেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মতো সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের সাথে নিয়ে আন্দোলন করার মতো।
চার.
বিএনপিকে যদি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে হয়, তবে বেগম খালেদা জিয়ার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের আপসহীন মনোভাবকে ধারণ করতে হবে। গুলি, টিয়ারশেল, হামলা-মামলা, নির্যাতনকে ভয় করলে চলবে না। বেগম খালেদা জিয়া তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে এসব মোকাবেলা করে এসেছেন। শীর্ষ নেত্রী যদি হামলা-মামলা, নির্যাতনের পরোয়া না করেন, তবে তার নেতা-কর্মীরা কেন করবে? এ কথা তো স্বতঃসিদ্ধ, বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে বিরোধী দলকে সরকারি দলের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমন কোনো দল নেই যার নেতা-কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়নি। কাজেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতির ইতিহাস এবং বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ় রাজনৈতিক মনোভাব থেকে অনুপ্রাণিত হতে হবে। এমনকি আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল এবং সে সময় তার শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ নেতা-কর্মীরা যেভাবে সরকারি দলের নির্যাতন মোকাবেলা করেছে, তা থেকেও শিক্ষা নিতে পারে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিএনপি


আরও
আরও পড়ুন