Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

‘বাঘ বিধবা’দের ঠাঁই নেই শ্বশুরবাড়িতে

| প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাতক্ষীরা থেকে আবদুল ওয়াজেদ কচি : তারা ‘বাঘ বিধবা’। স্বামীর মৃত্যুর পুরো দায়ই তাদের। আর সে কারণেই তাদের কপালে জোটে ‘স্বামী খেকো’ অপবাদ। সামাজিক কোনও অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতিই যেন ‘অলুক্ষণে’। ‘অপয়া’ এসব নারীদের বেশিরভাগেরই তাই ঠাঁই মেলে না শ্বশুর বাড়িতে। সমাজে থেকেও তাই তাদের হয়ে থাকতে হয় ‘একঘরে’।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তিদের স্ত্রীদের এমনই পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে সুন্দরবনের আশপাশের এলাকাগুলোতে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ এলাকায় গিয়ে এমনই চিত্র দেখা গেছে। কথা হয়েছে কয়েকজন ‘বাঘ বিধাবা’র সঙ্গেও। তারা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে জীবিত থেকেও মৃতের মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও সংস্থাগুলো বলছে, সুন্দরবনকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার লালন-পালন করে আসা স্থানীয়দের মধ্যে এখন বণতা খানিকটা হলেও কমেছে। এসব বিষয়ে স্থানীয়দের সচেতন করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার আলোচিত মুখ সোনামনি। তার দুই স্বামীকে জীবন দিতে হয়েছে বাঘের আক্রমণে। তার মুখ দেখলে তাই কেউ শুভ কাজে বের হয় না বলে জানান তিনি। সোনামনি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমার স্বামীকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। সে কারণে কোলের একমাস বয়সী বাচ্চাসহ আমার শাশুড়ি আমাকে তাড়িয়ে দেন। তখন আমাকে বাচ্চা নিয়ে পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। পরে আমার দেবর আমাকে বিয়ে করে। ২০০৩ সালে তাকেও বাঘে ধরে। এরপর থেকেই আমাকে ‘অপায়া’, ‘অল²ী’, ‘স্বামীখেকো’ অপবাদ মাথায় নিয়ে থাকতে হয়। কোনও অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেও খেতে দেয় সবার শেষে।’
সোনামনি আরও বলেন, ‘সকালে ওঠে যেন আগে আমার মুখ দেখতে না হয়, তাই শাশুড়ি আমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। এ জীবন তো মৃত্যুর মতোই। স্বামী গেল বাঘের পেটে, আমাকেও মেরে রেখে গেল।’
আরেক ‘বাঘ বিধবা’ বুলি দাশী বলেন, ‘আমার স্বামী অরুণ মন্ডল ২০০২ সালে সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। এর জন্য আমাকেই দায়ী করে নির্যাতন করতে থাকেন শাশুড়ি। এক পর্যায়ে বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দেন। আমার বাবা মারা গেছে অনেক আগে। তাই ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে ওঠি। কিন্তু ভাইও তো গরিব, তাই নদীতে রেণু পোনা ও কাঁকড়া ধরে সংসার চালাতে শুরু করি। এভাবেই ছেলে-মেয়েদের বড় করেছি।’
বুলি দাশী আরও বলেন, ‘আমার মতো এমন অনেক মেয়ে আছে, যাদের স্বামীরা বাঘের হাতে মারা যাওয়ার পর তাদের অপয়া বলে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমার স্বামীর ছোট ভাইও বাঘের আক্রমণে মারা যায়। তার বউ দিপালিকেও বাপের বাড়ি তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
শাহিদা খাতুন নামে আরেক ‘বাঘ বিধবা’ও জানালেন, তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে শশুর বাড়ি থেকে। নদীতে জাল টেনে আর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান এই নারী।
সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় বসবাসরত ‘বাঘ বিধবা’দের সামাজিক মর্যাদা ও পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করছে অনির্বাণ, দুর্জয়, জাগ্রত বাঘ বিধবা, নারী সংঠগন লির্ডাস প্রভৃতি সংগঠন। এসব সংগঠনও বলছে, তারা বিধবাদের নিয়ে কাজ করলেও তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে খুবই ধীরে।
বেসরকারি সংস্থা লিডার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাঘের আক্রমণে মারা গেছে ৫ শতাধিক বনজীবী। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাঘে আক্রমণে কারও নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ২০১৭ সালে তিন জন নিহত ও একজন আহত হওয়ার খবর জানা গেছে। আর সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় প্রায় সাড়ে এগারশ বাঘ বিধবা নারী রয়েছেন বলে জানিয়েছেন লির্ডাসের কর্মকর্তা মোহন কুমার মন্ডল।
তবে সরকারি হিসাবে সুন্দরবনে বাঘের হামলায় প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা অনেক কম। কারণ হিসেবে সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, মধু সংগ্রহ বা মাছ ধরার মতো কাজে যারা সুন্দরবনে যান, তাদের অনেকে সরকারি নিয়ম অনুসরণ করেন না। অনেকেই অন্যের পাস ব্যবহার করে প্রবেশ করেন সুন্দরবনে। তারা সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা গেলেও তাদের নাম সরকারি হিসাবে ওঠে না।
সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ পিযূশ বাউলিয়া পিন্টু বলেন, ‘সুন্দরবনে প্রবেশের আগে বনজীবীরা বনবিবির পূজা করে। এর বাইরেও তাদের মধ্যে আরও অনেক কুসংস্কারই আছে। যেমন, কারও স্বামী সুন্দরবনে গেলে সেই নারী অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, চুল আঁচড়াতে পারেন না, শরীরে তেলও মাখতে পারেন না। বিভিন্ন ধরনের সচেতনতা কার্যক্রমে এসব কুসংস্কার অনেকটা কমেছে। তবে এখনও অনেক পরিবার এসব কুসংস্কার মেনে চলে।’
পিন্টু আরও বলেন, ‘বাঘের হামলায় নিহত হলে পারিবারকে ১ লাখ টাকা ও আহত হলে চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার সরকারি নিয়ম আছে। কিন্তু অনেকেই অন্যের নামের পাস নিয়ে বনে যান। তাদের জন্য সরকারি কোনও সুবিধা নেই।’
তবে ‘বাঘ বিধবা’দের পরিস্থিতি খানিকটা বদলেছে বলে জানালেন মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কাশেম মোড়ল। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকার মানুষের শিক্ষার হার অনেক কম ছিল। আগে স্বামীকে বাঘে ধরলে তার দোষ স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে শ্বশুর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হতো। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। এমন ঘটনার কথা এখন আর শোনা যায় না।’
জানতে চাইলে শ্যামনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমি কিছুদিন হলো এখানে যোগ দিয়েছি। আমি আসার পর বাঘের হামলায় একজন আহত হওয়ার খবর শুনেছি। তবে স্থানীয়দের কাছে জেনেছি এখানকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথার কথা। আমরা এসব কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করছি।’
শ্যামনগরের সাবেক ইউএনও ও খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম বলেন, ‘গত কয়েকবছর এখানে বাঘের আক্রমণে নিহতের ঘটনা খুব একটা শোনা যায়নি। তবে বাঘের আক্রমণে কেউ নিহত হলে তার স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রথা ছিল। সেটি এখন আর আগের মতো নেই।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিধবা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ