Inqilab Logo

শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

কাতার সংকট : জনশক্তি রফতানি কমার আশঙ্কা

| প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নতুন করে সৃষ্ট উপসাগরীয় সংকট দেশের জনশক্তি রফতানি ও রেমিটেন্স প্রবাহে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সউদী আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইয়েমেন এবং একই সঙ্গে মিশর, লিবিয়া ও মালদ্বীপ সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্টের অভিযোগে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক ও ভ্রমণ সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সউদী আরবের মিত্রদের অন্যতম, উপসাগরীয় রাষ্ট্রজোটের সদস্য এবং সর্বক্ষেত্রে সউদী আরবের নীতি-পদক্ষেপের সমর্থক ও অংশীদার কাতারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের এই তিক্ততা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে এবং হঠাতই বা তার বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নিতে হলো কেন, সেটি ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ঘটনা উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে উত্তেজনার হাওয়া ছড়িয়ে দিয়েছে। সম্পর্ক ছিন্নকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, কাতারকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্ক রহিত করতে হবে। না হলে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অন্যদিকে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে কাতার। এই সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির নিরসন কামনা করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেফ এরদোগান পারস্পারিক আলোচনার মাধ্যমে সংকট মোচনের তাকিদ দিয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করারও আগ্রহ দেখিয়েছেন। কিন্তু গত কয়েকদিনে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। উভয় পক্ষের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। ইতোমধ্যে আরো দেশ কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নকারী দেশগুলোর পক্ষে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ অবশ্য আরোপিত কূটনৈতিক ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার আহŸান জানিয়েছেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রলম্বিত হলে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্কের গুরুতর অবনতি ঘটতে পারে। উন্নয়ন কার্যক্রমও ব্যহত হতে পারে।
সউদী আরব ও কাতারসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ভ্রাতৃবন্ধন ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও বিদ্যমান। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক কর্মী উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মরত রয়েছে। প্রবাসে কর্মব্যাপদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এর ৭০ শতাংশই কর্মরত রয়েছে উপসাগরীয় দেশগুলোতে। সবচেয়ে বেশি রয়েছে সউদী আরবে। যতদূর জানা, কাতারে কর্মরত রয়েছে কমপক্ষে চার লাখ বাংলাদেশি। বিভিন্ন পেশার কর্মীদের পাশাপাশি সেখানে কয়েক হাজার ইমামও রয়েছেন। বায়রার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উদ্ভূত সংকট বাংলাদেশের জন্য এক অশনি সংকেত। ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২২ উপলক্ষে কাতারে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতির সহসা উত্তরণ না ঘটলে এই উন্নয়ন কাজে ভাটার টান লাগতে পারে। এতে বাংলাদেশি কর্মীদের কাতারে কাজের সুযোগ হ্রাস পেতে পারে। অন্যদিকে যারা কাজ করছে তারাও নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে। ইতোমধ্যে কাতারে খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে। কাতার তার খাদ্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে প্রধানত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। কাজেই খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য সংকট ও পণ্যের মূল্য আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। কাতারের বহু কোম্পানি সউদী আরবসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে কাজ করে। একইভাবে সউদী আরবেরও বিভিন্ন কোম্পানি কাতারে কাজ করে। দু’ দেশের এসব কোম্পানিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছে। তাদের মধ্যে সম্পর্ক-সংযোগ দীর্ঘদিন বিছিন্ন থাকলে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তার কর্মীরাও সংকটে পড়বে। একথা কারো অজানা নেই, তেলের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে সউদী আরবসহ উপসাগরীয় অন্যান্য দেশে উন্নয়ন কাজের গতি হ্রাস পেয়েছে। তাদের জনশক্তি আমদানিও হ্রাস পেয়েছে। এতে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সউদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি জনশক্তি রফতানি এক প্রকার বন্ধই রয়েছে। বন্ধ দুয়ার খোলার খবর মাঝে মধ্যে শোনা গেলেও কার্যক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। ইরাক-লিবিয়া প্রভৃতি দেশে তো জনশক্তি রফতানির অনুকূল পরিবেশই নেই। সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতিতে উপসাগরীয় দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, বরং ব্যাপকভাবে হ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ওইসব দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা তুলনামূলকভাবে কম বেতন পায় এবং অনেক সময় কোম্পানিগুলো ঠিকমত বেতন পরিশোধ করে না। এতে কর্মীরা অর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি নানামুখী দুর্ভোগ ও কষ্টের শিকার হয়। তাদের এই বঞ্চনা ও কষ্ট আরো বাড়তে পারে।
কাতার সংকট বাংলাদেশের জন্য মুসলিম উম্মাহর ঐক্য-সংহতি, ভ্রাতৃত্ব-সহযোগিতা ইত্যাদির দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন উদ্বেগজনক, তেমনি একান্ত স্বার্থের দিক থেকেও উদ্বেগজনক। এমনিতেই প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। গত বছর কয়েক লাখ বাংলাদেশি কর্মীর বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান হলেও প্রবাসী আয়ে তার সুপ্রভাব লক্ষিত হয়নি। গত অর্থ বছরে প্রবাসী আয় কমেছে এবং চলতি অর্থ বছরে আরো কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রবাসী আয় আমাদের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অনুরূপ আরেকটি স্তম্ভ হলো রফতানি আয়। সেই রফতানি আয়ও ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। গত ১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ৫০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবাসী আয় ও রফতানি আয়ে এই নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামীদিনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন আকাক্সক্ষা মারাত্মকভাবে চোট খাবে। আশঙ্কার এই দিকটি আমলে নিয়ে এখনই সরকারের উচিৎ প্রবাসী আয় ও রফতানি হ্রাসের কারণগুলো খতিয়ে দেখে তা অপনোদনের পদক্ষেপ নেয়া। সউদী আরবসহ উপসাগরীয় সকল দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক। এ সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে হবে। ওইসব দেশে জনশক্তি রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করতে সম্পর্কের উন্নয়ন অপরিহার্য। অন্যান্য দেশেও জনশক্তি রফতানির তৎপরতা বাড়াতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী আয় যাতে প্রপার চ্যানেলে দেশে আসে তার ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, উৎপাদন ও রফতানি বাড়ানোর দিকেও যথোচিত পদক্ষেপ নিতে হবে। কাতার সংকটের দ্রæত অবসান আমরা স্বাভাবিক কারণেই প্রত্যাশা করি। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইস্পাত-কঠিন ঐক্য ও সংহতি যখন খুবই জরুরি, তখন এতটুকু বিরোধ-বিসংবাদও কাম্য হতে পারে না। ঐক্য-সংহতি, বন্ধুত্ব, ভাতৃত্ব, পারস্পারিক সহানুভূতি ও সহযোগিতা প্রত্যেকটি দেশের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাতার


আরও
আরও পড়ুন