শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান
বাংলা ভাষার উৎপত্তি বৌদ্ধপাল শাসনামলে (৭৫০-১১৬২)। তবে সঠিক কাল নিরূপণে পÐিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বিশিষ্ট ভাষাতাত্তি¡ক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের মাঝামাঝি বাংলা ভাষার জন্ম। তিনি বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদের ভাষা, প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিভিন্ন ঘটনা ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রের বর্ণনা থেকে ভাষার জন্মকাল নির্ধারণ করেছেন। অন্যদিকে, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর সুকুমার সেন ও আরো অনেকের মতে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটে। এভাবে ডক্টর শহীদুল্লাহ্র মতানুসারে বাংলা ভাষার বয়স বর্তমানে প্রায় সাড়ে তেরশ’ বছর এবং ডক্টর সুনীতিকুমার প্রমুখের মতানুসারে সহস্রাধিক বছর।
ভাষার উৎপত্তি-কাল নিয়ে মতদ্বৈততা থাকলেও এটা নিশ্চিত যে, পাল শাসনামলকে বাংলা ভাষার নির্মীয়কাল বলা হয়। তখনও ভাষা পুরাপুরি বিকশিত হয়নি। ব্রাহ্মণ্য সেন আমলে (১১৬৩-১২০৩) দেশীয় ভাষার চর্চা নিষিদ্ধ হওয়ায় বাংলা ভাষার বিকাশ ব্যাহত হয়। মুসলিম শাসনামলে (১২০৪-১৭৫৭) বাংলা ভাষার পুনর্জন্ম ঘটে ও রাজ-পৃষ্ঠপোষকতায় এর ব্যাপক চর্চা ও সমৃদ্ধি ঘটে। আদিতে বাংলা ভাষার শব্দ-সম্পদ ছিল সীমিত। মুসলিম শাসনামলে আরবি-ফারসি-তুর্কি, উর্দু ভাষার অসংখ্য শব্দ আহরণ করে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ইংরাজ আমলেও (১৭৫৭-১৯৪৭) ইংরাজি, ফরাসি, ওলন্দাজ, ফরাসি, চীনা ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার শব্দরাজি আহরণ করে বাংলা ভাষা অধিকতর সমৃদ্ধ হয়। পৃথিবীর প্রধান ভাষাসমূহ অন্য ভাষার শব্দ আত্তীকরণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষাও তাই। মূলত বাংলা ভাষার আত্তীকরণ ক্ষমতা প্রবল। এ কারণে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বাংলা ভাষা বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধতর হয়। বলা যায়, বাংলা ভাষার তিন-চতুর্থাংশ শব্দই অন্যভাষা থেকে আগত।
বাংলা ভাষার শব্দরাজিকে সাধারণত চার ভাগে বিভক্ত করা হয়Ñ দেশী, বিদেশী, তদ্ভব ও তৎসম। তদ্ভব-তৎসম শব্দরাজি মূলত সংস্কৃত ভাষা হতে আগত। আরবি-ফারসিসহ পৃথিবীর অন্য সকল ভাষা থেকে আগত শব্দসমূহকে এককথায় বিদেশী শব্দ রূপে আখ্যায়িত করা হয়। সংস্কৃত ভাষার শব্দকে বিদেশী না বললেও মূলত এগুলোও বিদেশী বা অন্য ভাষার শব্দ। দেশি-বিদেশি সব শব্দ নিয়েই বাংলা ভাষার শব্দভাÐার কালক্রমে সুসমৃদ্ধ হয়েছে। বিদেশী ভাষার শব্দ পরিগ্রহণ করা দোষণীয় নয়। শুধু বাংলা ভাষায় নয়, সব ভাষায়ই কমবেশি বিদেশি শব্দ রয়েছে। বিদেশী শব্দ যদি দীর্ঘকাল ধরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত, সর্বজনগ্রাহ্য ও সহজবোধ্য হয়, তাহলে সেটাকে আর বিদেশি বলা যায় না। যে শব্দ সহজে উচ্চারিত ও বোধগম্য সেটাই আমার ভাষা, তার উৎস যাইহোক না কেন। স্বীকরণ প্রবণতা ও আত্মস্থ করার অসাধারণ শক্তির কারণে বাংলা ভাষা আজ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। স্বীকরণ প্রবণতা ও আত্মস্থ করার শক্তি প্রত্যেক প্রধান ভাষারই বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
মুসলিম আমলে বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি, উর্দু, তুর্কি শব্দের আধিক্য থাকায় এ ভাষাকে অনেকেই ‘ফার্সি-বাংলা’ বা ‘মুসলমানি জবান’ অথবা ‘যাবনি মিশাল বাংলা’ নামে অভিহিত করেছেন। ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর উক্ত কলেজের ইংরাজ পাদ্রী ও সংস্কৃত পÐিতগণ বাংলা ভাষায় ইতঃপূর্বে আত্তীকৃত অসংখ্য আরবি, ফারসি, তুর্কি, উর্দু শব্দ বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দরাজি ব্যবহার করে এক নতুন কৃত্রিম বাংলা ভাষা চালু করে তার নাম দেন ‘সাধু বাংলা’। নাম থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত ভাষা সাধারণের নয়, সাধু-সজ্জ্নদের। দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দরাজিতে সাধু বাংলাকে ভারাক্রান্ত করে তোলার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে ‘সংস্কৃতের দুহিতা’ বলে প্রমাণ করা। কিন্তু দুর্বোধ্যতার কারণে তা জনপ্রিয় বা সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি।
পরবর্তীতে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৮৩), পÐিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৮-১৮৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), প্রমথনাথ চৌধুরী (১৮৬৭-১৯৪৬) প্রমুখের হাতে এ সাধু বাংলা অনেকাংশে সহজ ও প্রাঞ্জল হয়ে উঠলেও সংস্কৃতের প্রভাব ও কলকাতা-কেন্দ্রিক ভাষার প্রভাব থেকে তা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়নি। এরফলে ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে বাংলার অন্যান্য ধর্ম ও অঞ্চলের জনমÐলী কলকাতার আনুগত্য করতে বাধ্য হয়। ঐ সময় বাংলার অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায় ও অন্যান্য অঞ্চলের জনগণ শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনগ্রসর থাকায় কলকাতার আধিপত্য সহজেই সর্বব্যাপক হয়ে পড়ে।
বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধিকরণে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান নিঃসন্দেহে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। তিনি কলকাতা-কেন্দ্রিক কথ্য ভাষাকে পরিমার্জিত করে ক্রমান্বয়ে এটাকে তার সাহিত্যের ভাষায় পরিণত করেন। এ ভাষায় তার অমর গ্রন্থাবলী রচিত হওয়ার ফলে এ ভাষা সহজেই সর্বশ্রেণির মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কালক্রমে এটাই প্রমিত বাংলা বা স্টান্ডার্ড বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজে পরিণত হয়। এ ভাষায় গ্রন্থাদি রচিত হয় এবং হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রায় সবশ্রেণির লেখক-কবি-সাহিত্যিক এ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। ফলে উভয় বাংলার বইয়ের ভাষা বা সাহিত্যের ভাষা এক ও অভিন্ন হয়ে পড়ে। এর ভিত্তিতে ভাষার প্রমিত রূপ গড়ে ওঠে। কিন্তু উভয় বাংলার জনগণের মুখের ভাষায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও ভিন্নতা যথারীতি বহাল থাকে। বিশেষত বাঙালি মুসলিমের কথ্য জবানে অসংখ্য আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের ব্যবহার এবং অঞ্চল বিশেষে উচ্চারণ ও বানান রীতিতেও ভিন্নতা পরিদৃষ্ট হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলা বিভক্ত হয়। বাংলার পূর্বাঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। তখন থেকে ঢাকা-কেন্দ্রিক প্রমিত বাংলা বা স্টান্ডার্ড বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ সৃষ্টির চেষ্টা চলে। ঢাকা- কেন্দ্রিক বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক ভাষার শব্দ-সমন্বয়ে ঢাকা-কেন্দ্রিক নতুন প্রমিত ভাষা সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। কেননা, পূর্ববঙ্গে প্রচলিত বাংলা ভাষার বিবিধ আঞ্চলিক রূপ ও বৈচিত্র্য রয়েছে। বানান ও উচ্চারণ রীতিতেও অনেক ভিন্নতা রয়েছে। কলকাতার সাথে তার হুবহু মিল নেই। তিনি ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলা ভাষার নতুন প্রমিত রূপ গড়ে তোলার আহŸান জানান। তিনি বলেন ঃ “আজ বাংলা ভাগ হইয়াছে। এক বাংলা দুইটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের রূপ নিয়াছে। এতে বাংলা সাহিত্য ও ভাষার কি পরিবর্তন হইয়াছে এইটাই আমাদের ভাল করিয়া বিচার করিতে হইবে। এ বিচার সুষ্ঠু ও নির্ভুলভাবে করিতে গেলে আমাদের আগে বিবেচনা করিতে হইবে দুইটা কথা : এক. বাংলা ভাগ হওয়ার আগেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলিম-বাংলার ভাষা ও হিন্দু-বাংলার ভাষায় একটা পার্থক্য ছিল। মুসলমান লেখকরা সামাজিক ও সাহিত্যিক প্রয়োজনের খাতিরে প্রচলিত বহুসংখ্যক মুসলমানী শব্দ সাহিত্যে চালু করিয়াছিলেন। হিন্দু লেখকরা তা মানিয়া লন নাই। দুই. বাটোয়ারার আগে বাংলার রাজধানী সুতরাং সাহিত্যিক কেন্দ্র ছিল কলিকাতা। এখন সে জায়গা দখল করিয়াছে ঢাকা।...এই দুইটা কথার তাৎপর্য আমাদের বুঝিতে হইবে। অবিভক্ত বাংলায় বাংলা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে প্রাধান্য ছিল হিন্দুদের। তার মানে বাংলা সাহিত্য ছিল মূলত এবং প্রধানত হিন্দু কালচারের বাহক। সে সাহিত্য বাংলার মুসলিম কালচারের বাহক তো ছিলই না বরঞ্চ তার প্রতি বিরূপ ছিল।”
পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক ভাষার সমন্বয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি (১৯৫৫ সালে স্থাপিত) বিশিষ্ট ভাষাতাত্তিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সম্পাদনায় ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ রচনা করে। ধীরে ধীরে বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় ভাষার আঞ্চলিক রূপ বিকশিত ও স্বীকৃতি পেতে থাকে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে কলকাতা অঞ্চলের ভাষার পার্থক্য গড়ে ওঠে। এ পার্থক্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে, সন্দেহ নেই। কারণ ভাষার স্বভাব হলো সহজতাÑআঞ্চলিক প্রভাব ও উপকরণে নিজেকে উৎকর্ষমÐিত করে ভাষা নিরন্তর সমৃদ্ধ ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। ভাষাতত্ত¡বিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এটাকে ভাষার গণতন্ত্রায়ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়া কারো ফরমায়েশে নয়, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়। ঢাকা-কেন্দ্রিক বাংলা ভাষায় ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত আঞ্চলিক শব্দ, বিশেষত এদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিমের নিত্য ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দরাজির সমন্বয়ে বাংলা ভাষা বিকশিত হয়ে উঠবে।
ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ববাংলার আঞ্চলিক ভাষার শব্দ, উচ্চারণ ও বানান রীতির ভিত্তিতে বাংলা ভাষার যে প্রমিত রূপ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, দুর্ভাগ্যবশত পরবর্তীতে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর জোর-জবরদস্তির কারণে তাতে ভাটা পড়ে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ঢাকা ও কলকাতার পÐিতদের যৌথ চেষ্টায় যে বাংলা ব্যাকরণ তৈরি হয়, বাংলা ভাষার যে প্রমিত রূপ, উচ্চারণ ও বানান রীতি প্রবর্তিত হয়, তাতে পূর্ববাংলার আঞ্চলিক শব্দ, উচ্চারণ ও বিশেষ বানান রীতিকে মূলত উপেক্ষা করা হয়েছে। ডক্টর এবনে গোলাম সামাদের ভাষায়Ñ“এখন প্রমিত বাংলা বলতে বোঝানো হচ্ছে কলকাতার কথিত বাংলাকে। কিন্তু এই বাংলায় কলকাতার কথিত বাংলার সাধারণ মানুষ কথা বলে না। এটা বর্তমান বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলেরই মানুষের মুখের ভাষা নয়।” (এবনে গোলাম সামাদ : বাংলাদেশে প্রমিত বাংলা)।
দুর্ভাগ্যবশত এখন আমাদের প্রমিত বাংলা ভাষার রূপ বলতে কলকাতার আঞ্চলিক ভাষার শব্দ, বানান ও উচ্চারণ রীতিই বুঝায়। এটা এক ধরনের হীনম্মন্যতা। আমাদের ভাষায় নিত্যব্যবহৃত এমন কিছু সাধারণ শব্দ রয়েছে, যার উচ্চারণ ও বানান রীতি কলকাতার অনুরূপ নয়। নিত্যব্যবহৃত এ ধরনের কিছুসংখ্যক শব্দের উদ্ধৃতি দেয়া হলো। এসব শব্দের উচ্চারণ ও বানান কলকাতায় যেভাবে করা হয় তা ব্রাকেটে উল্লেখ করা হলো : ইংরাজ (ইংরেজ), ইংরাজি (ইংরেজি), হিসাব (হিসেব), নিকাশ (নিকেশ), বিকাল (বিকেল), ছিলাম (ছিলেম/ছিলুম), খেলাম (খেলুম), সন্ধ্যা (সন্ধ্যে), জিজ্ঞাসা (জিজ্ঞেস), অভ্যাস (অভ্যেস), জন্য (জন্যে), কন্যা (কন্যে), উপরে (ওপরে), একলা (একেলা), ইত্যাদি।
উপরে উদাহরণস্বরূপ অল্প কয়েকটি শব্দের উল্লেখ করা হলো। এ জাতীয় আরো অনেক শব্দ রয়েছে, যার উচ্চারণ ও বানান কলকাতা থেকে বাংলাদেশে ভিন্নতর। প্রশ্ন হলো, আমরা কি আমাদের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে কলকাতাকে অনুসরণ করবো? কলকাতাকে যদি তাদের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে আমাদেরটাকে গ্রহণ করতে বলা হয়, তাহলে তারা কি সেটা মেনে নেবে? যদি তা না মানে, তাহলে আমরা আমাদের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে তাদের অনুকরণ-অনুসরণ করবো কেন? আমরা এক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু, বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা, ভাষার জন্য আমাদের ত্যাগ ও সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা, ভাষার চর্চা ও বিকাশে আমাদের অঙ্গীকার সর্বজনবিদিত।
আমাদের প্রমিত ভাষার রূপ আমাদের জীবন-বাস্তবতা, স্বভাব ও অভ্যাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথায়, প্রমিত ভাষার সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হবে। এ দূরত্বের কারণে এমন এক সময় আসতে পারে, যখন প্রমিত ভাষার সাথে জনগণের ভাষার ব্যবধান অনতিক্রম্য হয়ে উঠবে। ভাষার স্বাভাবিক চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই অন্তরায় স্বরূপ। তাই আমাদের জীবন-বাস্তবতা, স্বভাব ও অভ্যাসের সাথে প্রমিত ভাষাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা আবশ্যক। তাছাড়া, ভাষার সাথে ঐতিহ্যিক ও কৃষ্টিক সংযোগ-সম্পর্ক বিদ্যমান। বাঙালি মুসলিমের জীবনে নিত্যব্যবহৃত এমন অনেক শব্দ আছে, যার ঐতিহ্যিক ও কৃষ্টিক তাৎপর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ ঐতিহ্যিক ও কৃষ্টিক তাৎপর্যকে অবহেলা করলে ভাষার মর্যাদা নিদারুণভাবে ক্ষুণœ হবে। যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে পÐিত ও বিশেষজ্ঞগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।